রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ এর অধীনে অভিযোগ কে নেবে?

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ এর অধীনে কি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অভিযোগ গ্রহণ করতে পারবেন? নাকি এই ক্ষমতা শুধু দায়রা আদালতের? এই আইনের অধীনে আরো কিছু বিধানের প্রয়োগ নিয়ে আইনাঙ্গনে বেশ আলোচিত বিষয় নিয়ে দুই পর্বে লিখেছেন বিচারক চন্দন কান্তি নাথ। আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব।
চন্দন কান্তি নাথ, বিচারক, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), বরিশাল।
  ২২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা প্রদানের লক্ষ্যে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু ওই আইনে অভিযোগ কে নেবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (বস্নাস্ট) বনাম বাংলাদেশ মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের পর তা আরও বেড়েছে।

উলেস্নখ্য, ১৯৯৮ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে মারা যান রুবেল। এরপর তৎকালীন সরকার রুবেল হত্যা তদন্তের জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের সমন্বয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে।

এ সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (বস্নাস্ট) হাইকোর্টে রিট করে। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এ ব্যাপারে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর ২০০৪ সালে আপিল বিভাগ সরকারের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। তবে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনাগুলো স্থগিত করেননি।

দীর্ঘদিন পরে ২০১৬ সালের ১৭ মে আপিল শুনানি শেষে ২৪ মে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। এরপর একই বছরের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়। রায়ে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ১০ দফা নীতিমালা করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। একইসঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য ৯ দফা নীতিমালা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। আর ৮ ও ৯ নম্বর দফায় বলা হয়-

৮) যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে বা তার হেফাজতে নেন, তখন তার দায়িত্ব হচ্ছে নির্ধারিত সময় শেষে তাকে আদালতে হাজির করা। যদি পুলিশি প্রতিবেদন বা অন্য কোনোভাবে জানা যায় যে, গ্রেপ্তার ব্যক্তি মারা গেছেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির (ভিকটিম) শারীরিক পরীক্ষার নির্দেশ দেবেন। যদি দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির দাফন হয়ে গেছে, সে ক্ষেত্রে মরদেহ উঠিয়ে মেডিকেল পরীক্ষার নির্দেশ দেবেন। যদি মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নির্যাতনের কারণে মৃতু্য হয়েছে, তবে ম্যাজিস্ট্রেট ২০১৩ সালের হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইনের ১৫ ধারা অনুযায়ী ওই কর্মকর্তা, সংশিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যার কাস্টডিতে মৃতু্যর ঘটনা ঘটেছে, তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেবেন।

৯) যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপাদান বা তথ্য থাকে যে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ এর ধারা ২-এ বর্ণিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি হেফাজতে নির্যাতন বা মৃতু্যর শিকার হয়েছেন, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। আর মৃতু্যর ক্ষেত্রে আঘাত বা মৃতু্যর কারণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ডে পাঠাবেন। যদি মেডিকেল পরীক্ষায় দেখা যায় যে আটক ব্যক্তিকে নির্যাতন করা হয়েছে অথবা নির্যাতনের কারণে মৃতু্য হয়েছে, এ ক্ষেত্রে বিচারক সংশিষ্ট আইনের ৪ ও ৫ ধারায় মামলা দায়েরের জন্য অপেক্ষা না করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ১৯০ (১)(সি) ধারা অনুযায়ী অপরাধ আমলে নেবেন।

এখানে লক্ষণীয় যে, ৪ ও ৫ ধারায় মামলা দায়েরের জন্য অপেক্ষা না করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ১৯০ (১)(সি) ধারায় অপরাধ আমলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট আইনের ৪ ধারায় বর্ণিত একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দ্বারা অবিলম্বে ভিকটিমের দেহ পরীক্ষার আদেশের বিপরীতে আপিল বিভাগ ভিন্ন পদ্ধতি তথা মেডিকেল বোর্ড গঠন কিংবা নিকটস্থ চিকিৎসক ইত্যাদির কথা বলেছেন।

তাহলে ৪ ও ৫ ধারায় কে অভিযোগ আমলে নেবে? এর সহজ উত্তর হচ্ছে দায়রা জজ আদালত নেবেন। তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের কথা মহামান্য আপিল এনেছেন কেন? নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ আইনে কোথাও ম্যাজিস্ট্রেট কথাটি নেই। শুধু দায়রা জজ আদালতের কথা আছে। সেটা ১৪ ধারায় বিচারিক এখতিয়ার বা ৭ ধারায় অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার হোক দুক্ষেত্রেই দায়রা আদালতের কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু ৯ ধারায় একথাও বলা হয়েছে যে, এই আইনে ভিন্নরূপ কিছু না থাকলে, কোন অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ঈড়ফব ড়ভ ঈৎরসরহধষ চৎড়পবফঁৎব ১৮৯৮ (অপঃ ঠ ড়ভ ১৮৯৮)-এর বিধানসমূহ প্রযোজ্য হবে। আর এই আইনের অধীন দন্ডনীয় সব অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণীয় (ঈড়মহরুধনষব) হবে। আর এই রকম বিধান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ সব আইনে থাকে।

ফৌজদারি কার্যবিধিতে ১৯০ (১)(সি) ধারা ছাড়াও ১৯০ (১)(এ) ও ১৯০ (১)(বি) ধারা রয়েছে।

এই আইনে ধারা ৪ থেকে ৭ ধারায় ১৯০ (১)(এ) ও ১৯০ (১)(বি) ধারার বিধান রয়েছে কিন্তু ১৯০(১)(সি) ধারার মতো বিধান নেই। সে কারণে মহামান্য আপিল বিভাগ হয়তো উক্ত নির্দেশনা দিয়েছেন অনুমান করা যায়।

কেননা, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ আইনে সংজ্ঞায় আদালতের নাম উলেস্নখ না করলেও 'এই আইনের এখতিয়ারধীন কোনো আদালতের সামনে কোনো ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে শব্দাবলি' উলেস্নখ করে ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ঈড়ফব ড়ভ ঈৎরসরহধষ চৎড়পবফঁৎব ১৮৯৮, অপঃ ঠ ড়ভ ১৮৯৮)-এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, তা সত্ত্বেও এই আইনের এখতিয়ারাধীন কোনো আদালতের সামনে কোনো ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে- তা হলে ওই এখতিয়ারাধীন আদালত তাৎক্ষণিকভাবে ওই ব্যক্তির জবানবন্দি গ্রহণ করবেন। তারপর একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দ্বারা অবিলম্বে তার দেহ পরীক্ষার আদেশ দেবেন।

অভিযোগকারী মহিলা হলে রেজিস্টার্ড মহিলা চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করবার ব্যবস্থা করবেন।

চিকিৎসক অভিযোগকারী ব্যক্তির দেহের জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন এবং নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উলেস্নখপূর্বক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উহার একটি রিপোর্ট তৈরি করবেন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক প্রস্তুতকৃত রিপোর্টের একটি কপি অভিযোগকারী অথবা তাহার মনোনীত ব্যক্তিকে এবং এই আইনের এখতিয়ারাধীন আদালতে পেশ করবেন। চিকিৎসক যদি এমন পরামর্শ দেন যে, পরীক্ষাকৃত ব্যক্তির চিকিৎসা প্রয়োজন, তা হলে এই আইনের এখতিয়ারাধীন আদালত ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করবার নির্দেশ প্রদান করবেন।

৫ ধারা মতে বিবৃতি লিপিবদ্ধ করবার পর এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালত অনতিবিলম্বে বিবৃতির একটি কপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কাছে বা ক্ষেত্রমতো, তদূর্ধ্ব কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করবেন এবং একটি মামলা দায়েরের নির্দেশ প্রদান করবেন। পুলিশ সুপার ওই আদেশ প্রাপ্তির পর পরই ঘটনা তদন্ত করে চার্জ বা চার্জবিহীন রিপোর্ট পেশ করবেন। সংশ্লিষ্ট সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি মনে করেন যে পুলিশ দ্বারা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি যদি এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালতে আবেদন করেন এবং আদালত যদি তার আবেদনে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন যথার্থ- সেক্ষেত্রে এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন। রিপোর্ট দাখিলের সময় তদন্ত কর্মকর্তা, ক্ষেত্রমতে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তা বিবৃতি প্রদানকারী অভিযোগকারী ব্যক্তিকে তারিখসহ রিপোর্ট দাখিল সম্পর্কে অবহিত করবেন।

নোটিশপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি নোটিশ গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে নিজে ব্যক্তিগতভাবে অথবা আইনজীবী মারফত আদালতে আপত্তি জানাতে পারবেন। তখন আদালত সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির পদমর্যাদার নিম্নে নয়, এমন পদমর্যাদার কোনো পুলিশ অফিসারকে মামলার তদন্ত অনুষ্ঠানের নির্দেশ প্রদান করবেন।

চন্দন কান্তি নাথ, বিচারক, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল

(যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), বরিশাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে