রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

জারি পর্যায়ে পারিবারিক আদালত খোরপোশের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারেন কি?

বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতগুলোতে ডিক্রি জারি মামলা চলমান থাকার একপর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে ডিক্রিদার খোরপোশ বৃদ্ধির প্রার্থনা করেন। কখনো কখনো খোরপোশের দায় থেকে অব্যাহতি বা খোরপোশের পরিমাণ হ্রাসের প্রার্থনায় দায়িকও আদালতের শরণাপন্ন হন। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে চাইলে আদালতকে ডিক্রিপরবর্তী ঘটনা- যেমন: তালাক, দায়িকের আর্থিক সঙ্গতির হ্রাস-বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি প্রভৃতি বিবেচনায় নিতে হয় এবং মূল ডিক্রিতে কিছু রদবদল আনতে হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক ডিক্রির এরকম সামান্য রদবদল বিশ্বব্যাপী একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও আমাদের দেশে এ ধরনের আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতগুলোর মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করে। বিষয়টি নিয়ে দুই পর্বে লিখেছেন বিচারক মারুফ আলস্নাম। আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব
মারুফ আলস্নাম : জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী
  ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

দৃশ্যপট-১

পারিবারিক মামলায় গত ২৩ বছর ধরে কন্যাসন্তানের খোরপোশ পরিশোধ করে আসছেন বাবা। সম্প্রতি তিনি আদালতে এসেছেন খোরপোশ প্রদানের দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন নিয়ে। তার দাবি, ডিক্রিদার-কন্যাসন্তানের বর্তমান বয়স ২৮ বছর। এই কন্যার পাঁচ বছর বয়স থেকেই ডিক্রির অধীনে খোরপোশ দিয়ে আসছেন তিনি। মাসিক খোরপোশের পরিমাণ বর্তমানে ৫,০০০ টাকা। দায়িক-বাবা পেশায় গাড়িচালক। কিছুদিন আগে দূরারোগ্য ব্যাধি ধরা পড়েছে তার। এ কারণে নিয়মিত কাজে যেতে পারছেন না এবং আয়ও কমে গেছে। নিজের চিকিৎসা ও খোরপোশের অর্থ জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

অন্যদিকে, ডিক্রিদার-কন্যাসন্তান ইতোমধ্যে পড়াশোনা শেষ করে মোটা বেতনের চাকরি করছেন। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত কন্যার খোরপোশ পরিশোধের আদেশ আছে ডিক্রিতে। দায়িকের প্রার্থনা- তার বর্তমান আর্থিক-শারীরিক অবস্থা এবং কন্যাসন্তানের বয়স ও সচ্ছলতা বিবেচনায় নিয়ে তাকে যেন এই মামলায় খোরপোশ প্রদানের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মেয়ের ২৮ বছর পর্যন্ত খোরপোশ দিয়ে এসেছেন তিনি; এখন আর পারছেন না।

দৃশ্যপট-২

ডিক্রিদার-কন্যাসন্তান তার বাবার কাছ থেকে প্রতি মাসে ৮০০ টাকা হারে খোরপোশ পেয়ে আসছেন। ডিক্রিতে বার্ষিক বৃদ্ধির কোনো আদেশ নেই। আট বছর আগে যে সময় ডিক্রিটি প্রচারিত হয়, তখনকার চাহিদা ও টাকার মূল্যমান বিবেচনায় ওই অর্থ হয়তো পর্যাপ্তই ছিল। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ৮০০ টাকায় বাচ্চার শিক্ষাও হয় না বলে দাবি করছেন ডিক্রিদারের মা। আদালতের কাছে তিনি এসেছেন খোরপোশের পরিমাণ বৃদ্ধির আবেদন নিয়ে। বাবার আর্থিক সঙ্গতি বেড়েছে মর্মে সুনির্দিষ্ট তথ্যও আছে তার আবেদনে।

বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতগুলোতে এ ধরনের আবেদন প্রায়ই এসে থাকে। এসব আবেদনের অধিকাংশই নিয়ে আসেন ডিক্রিদার, যিনি খোরপোশ বৃদ্ধির প্রার্থনা করেন। কখনো কখনো খোরপোশের দায় থেকে অব্যাহতি বা খোরপোশের পরিমাণ হ্রাসের প্রার্থনায় দায়িককেও আসতে দেখা যায়।

এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে চাইলে আদালতকে ডিক্রিপরবর্তী ঘটনা- যেমন: তালাক, দায়িকের আর্থিক সঙ্গতির হ্রাস-বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি প্রভৃতি বিবেচনায় নিতে হয় এবং মূল ডিক্রিতে কিছু রদবদল আনতে হয়। কিন্তু ডিক্রিতে রদবদল আনার ক্ষেত্রে আইনজীবীরা বাদ সাধেন এই যুক্তিতে যে, 'জারি আদালত ডিক্রির বাইরে যেতে পারেন না।'

ডিক্রিপরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মূল ডিক্রিতে যে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়ে, তাকে 'সংশোধন' না বলে 'সামান্য রদবদল' বলা যেতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক ডিক্রির এ রকম সামান্য রদবদল বিশ্বব্যাপী একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও আমাদের দেশে এ ধরনের আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতগুলোর মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করে।

ডিক্রিপরবর্তী ঘটনা বিবেচনায় মূল ডিক্রিতে পারিবারিক আদালত প্রয়োজনীয় রদবদল আনতে পারবেন কিনা। এর নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। পারিবারিক আদালতের উদ্দেশ্য ও ন্যায়বিচারের মূলনীতি বিবেচনায় নিয়ে এ সম্পর্কে একটি প্রগতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

'জারি আদালত ডিক্রির বাইরে যেতে পারেন না'- এই নীতি পারিবারিক মামলায় প্রয়োগ করা অযৌক্তিক

'জারি আদালত ডিক্রির বাইরে যেতে পারেন না (অহ ঊীবপঁঃরহম ঈড়ঁৎঃ পধহহড়ঃ মড় নবযরহফ :যব উবপৎবব), এটি মূলত দেওয়ানি আদালতের ডিক্রি সম্পর্কিত একটি নীতি। এ কারণে দেওয়ানি মামলায় জারি আদালত ডিক্রির বাইরে যেতে পারেন না। কিন্তু প্রকৃতিগত ভিন্নতার কারণে পারিবারিক ডিক্রিগুলোর ক্ষেত্রে এই নীতি প্রয়োগ করা যৌক্তিক ও সমীচীন নয়।

পারিবারিক আদালতের ডিক্রিগুলোর প্রকৃতি এমন যে, ডিক্রি প্রচারের পর দীর্ঘকাল যাবত আদালত কর্তৃক ডিক্রির বাস্তবায়ন নজরদারি করতে হয়। পরিস্থিতিগত নানা পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সময়ে সময়ে মূল ডিক্রি রদবদলের প্রয়োজন পড়তে পারে। যেমন- হেফাজতের মামলায় আদালত ডিক্রি দিলেন যে, সন্তানের সঙ্গে তার বাবা একটি নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময় দেখা করবেন। কয়েক বছর পর দেখা গেল, নতুন চাকরিতে যোগদানের কারণে ডিক্রিতে উলিস্নখিত সময়ে বাবার পক্ষে সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়েছে কিংবা সন্তানের স্কুলের সময়সূচি পরিবর্তনের কারণে সন্তানের পক্ষেও আগের সূচির আলোকে বাবার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। এরকম ক্ষেত্রে মূল ডিক্রিতে রদবদল এনে সময়সূচি পুনর্নির্ধারণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

খোরপোশের ডিক্রিতেও এরকম রদবদল প্রয়োজন হতে পারে। ১০ বছর আগের ডিক্রিতে সন্তানের জন্য যে খোরপোশ নির্ধারিত ছিল, ১০ বছর পর মুদ্রাস্ফীতি কিংবা বাবার আর্থিক সক্ষমতার প্রচন্ড হ্রাসবৃদ্ধির কারণে খোরপোশের পরিমাণে রদবদল আনা প্রয়োজন হতে পারে।

বহির্বিশ্বে মূল মামলার অধীনে পারিবারিক ডিক্রির রদবদল হয়ে থাকে

ডিক্রিপরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক ডিক্রির রদবদল বহির্বিশ্বে একটি নিয়মিত ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এমনকি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও মূল পারিবারিক মামলার অধীনে পক্ষগণকে এ ধরনের প্রতিকার দেওয়া হয়। এজন্য নতুন মামলা করার বাধ্যবাধকতা এসব দেশে নেই।

ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে পারিবারিক ডিক্রির এই রদবদলকে 'পোস্ট-ডিক্রি মডিফিকেশন] (চড়ংঃ উবপৎবব গড়ফরভরপধঃরড়হ) বলে অভিহিত করা হয়। শব্দটি বহুলপ্রচলিত বিধায় গুগল-সার্চে এ-সম্পর্কে প্রচুর নিবন্ধ পাওয়া যায়। 'পোস্ট-ডিক্রি মডিফিকেশন' নিয়ে বিখ্যাত ফাইন্ড ল' ওয়েবসাইটেও বেশ কিছু নিবন্ধ রয়েছে। এতে দেখা যায়- যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো দেশগুলোতে বিয়েবিচ্ছেদ, সন্তানের হেফাজত ও খোরপোশ সম্পর্কিত পারিবারিক ডিক্রিগুলো পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মূল মামলার অধীনেই রদবদল করার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে আবেদনকারী মূল মামলায় একটি 'মোশন' উপস্থাপন করেন- যা উভয়পক্ষের শুনানি-অন্তে নিষ্পত্তি হয়।

ভারতের জাকির হুসেন মোহম্মদ ইছাক শেখ বনাম রোশান জাকির হুসেন (মিস সিভিল অ্যাপিস্নকেশন ৩০১৩/২০১৬) মোকদ্দমার আদেশেও মূল মামলার অধীনে আগের ডিক্রি সংশোধন হয়েছে মর্মে দেখা যায়। সন্তানের সঙ্গে বাবার সাক্ষাৎ-সম্পর্কিত যে সময়সূচি আদালত পূর্বে নির্ধারণ করেছিলেন, এই আদেশ দ্বারা মূল মামলার অধীনেই সেটি রদবদল করা হয়েছে।

পাকিস্তানের সুপ্রিমও কোর্টও ২০১৬ সালের এক রায়ে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, সন্তানের খোরপোশবৃদ্ধিতে পৃথক মামলার প্রয়োজন নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মূল মামলাতেই পারিবারিক আদালত এ ধরনের আবেদন নিষ্পত্তি করতে পারেন। ২০১৬ এসসিএমআর ১৮২১ দ্রষ্টব্য।

আমাদের আইন কী বলে? ডিক্রি রদবদলে 'নতুন মামলা' নাকি আগের মামলাতেই 'নতুন আবেদন'?

আদালতের খোরপোশ সম্পর্কিত আদেশ বহাল থাকাবস্থায় পারিবারিক আদালতে পুনরায় খোরপোশবৃদ্ধির আবেদন আনার সুযোগ রয়েছে আমাদের আইনে। খোরপোশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন মামলা করা যাবে- মর্মে সিদ্ধান্ত এসেছে কাওসার চৌধুরী বনাম লতিফা সুলতানা ৫৪ ডিএলআর ১৭৫ মামলায়। তবে শর্ত দেওয়া হয় যে, এ ধরনের মামলা রক্ষণীয় হতে হলে 'মামলার নতুন কারণ (ভৎবংয পধঁংব ড়ভ ধপঃরড়হ)' দেখাতে হবে।

উচ্চ আদালতের উলিস্নখিত সিদ্ধান্ত দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, উপযুক্ত আদালত থেকে খোরপোশের চূড়ান্ত আদেশ বহাল থাকার পরও নতুন কারণের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারিক আদালত কর্তৃক খোরপোশ বৃদ্ধির নতুন আদেশ দেওয়া যেতে পারে।

এক্ষেত্রে পৃথক মামলা করতে হবে নাকি আগের মামলার অধীনেও প্রতিকারটি দেওয়া যাবে- সে সম্পর্কে উচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ, এই ঘটনাটিতে আগের মামলার অধীনে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ ছিল না। পূর্বের মামলাটি হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। খোরপোশ বৃদ্ধির প্রার্থনায় পরবর্তী সময়ে বাদী যখন আদালতের দ্বারস্থ হলেন, সে সময় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের খোরপোশ প্রদানের ক্ষমতা ছিল না। ইতোমধ্যে পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ওই ক্ষমতা খর্ব হয়েছিল। সে কারণে পারিবারিক আদালতে নতুন মামলা আনয়ন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তটিতে সে মোতাবেক পারিবারিক আদালতে নতুন মামলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

খোরপোশ বৃদ্ধির জন্য নতুন মামলাই 'একমাত্র উপায়' এবং আগের মামলায় এই প্রতিকার দেওয়া যাবে না- এরকম কোনো বিধান এই সিদ্ধান্ত থেকে অনুমান করার সুযোগ নেই। আগের মামলার অধীনে এ ধরনের প্রতিকার প্রদানকে উচ্চ আদালতের কোনো সিদ্ধান্তে বারিত করা হয়েছে বলে জানা যায় না।

'আগের মামলার অধীনে অনুরূপ প্রতিকার দেওয়া যাবে না'- এমনটি দাবি করতে হলে প্রমাণ করতে হবে যে, এভাবে প্রতিকার দিলে মামলার পক্ষবৃন্দ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বরং উভয়পক্ষকে নোটিশপূর্বক আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে এ ধরনের আবেদন নিষ্পত্তি করা হলে কোনো পক্ষেরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

খোরপোশ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নতুন মামলা আইনত রক্ষণীয় হলে আগের মামলার অধীনেও খোরপোশ বৃদ্ধির আবেদন রক্ষণীয় হওয়া উচিত। বরং এ ধরনের প্রতিকার 'আগের মামলার অধীনেই' অধিকতর কার্যকর পন্থায় প্রদান করা যেতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে