সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
ইন্দিরা গান্ধীর ইলেকশন কেইস

যেসব আইনি প্রশ্নে এগোতে থাকল উপমহাদেশের অন্যতম আলোচিত মামলা

হাবিবুর রহমান
  ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

দ্বিতীয় পর্ব

এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধীকে সমন দেওয়ার পরে তার পক্ষ থেকে রিটেন স্টেটমেন্ট (লিখিত জবাব) জমা দেওয়ার প্রয়োজন হলো। ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন দিলিস্ন থেকে সবচেয়ে বিখ্যাত আইনজীবী নানী পালকিওয়ালাকে আনবেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর আইনজীবী সতীশ চাঁদ খারে আপত্তি করলেন। তিনি বললেন, পালকিওয়ালা আমার দুই বছরের জুনিয়র। পালকিওয়ালা এই কেসে এলাহাবাদ হাইকোর্টে এলে আমি থাকতে পারব না।

পালকিওয়ালা তখন ভারতের এক নাম্বার আইনজীবী, প্রধানমন্ত্রী তাকে নিজের পক্ষে উকিল নিয়োগ করতে চান। কিন্তু সতীশ খারের কাছে তিনি তার দুই বছরের জুনিয়র। একসঙ্গে কাজ করা যাবে না। একটা ধারণা প্রচলিত আছে, একজন নারীর কাছে চেস্টিটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইনজীবীর কাছে সিনিয়রিটি তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।

ইন্দিরা গান্ধী চিন্তা করলেন, সতীশ চাঁদ খারে দীর্ঘদিনের আইনজীবী। কেসের সব ব্যাপারে তার জানাশোনা আছে। অন্যদিকে, পালকিওয়ালা ভীষণ ব্যস্ত। দিলিস্ন থেকে বারবার এলাহাবাদ হাইকোর্টে আসতেও সময় লাগবে। তাই তিনি শেষপর্যন্ত সতীশ খারেকেই নিজের আইনজীবী রাখলেন।

ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালের ০৫ আগস্ট এলাহাবাদ হাইকোর্টে রিটেন স্টেটমেন্ট জমা দেওয়া হলো। রিটেন স্টেটমেন্টে ইন্দিরা গান্ধী তার বিরুদ্ধে আনা নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের সব অভিযোগ অস্বীকার করলেন।

জাস্টিস ব্রম্নম ইসু্য ফ্রেমের জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য করলেন ০৫ আগস্ট, ১৯৭১।

১৯ আগস্ট, ১৯৭১, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বেঞ্চ ইসু্য গঠন করেছে।

ইসু্যগুলো হচ্ছে:

১. সরকারি কর্মচারী থাকা অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধী ইয়াশপাল কাপুরকে নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত করেছেন কিনা;

২. ইয়াশপাল কাপুর ঘুষ দিয়ে স্বামী আদিত্যনান্দকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে কিনা;

৩. এয়ারফোর্স নির্বাচনী সফরে ইন্দিরা গান্ধীর জন্য সরকারি বিমানের ব্যবস্থা করেছে কিনা। যদি করে, তাহলে তা আরপিএ এর ১২৩(৭) ধারায় করাপ্ট প্র্যাকটিস হবে কিনা;

৪. জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং এসপি ইন্দিরা গান্ধীর জনসভার জন্য পুলিশ বেষ্টনী এবং মঞ্চ তৈরি করেছে কিনা। যদি করে, তাহলে তা আরপিএ এর ১২৩(৭) ধারায় করাপ্ট প্র্যাকটিস হবে কিনা;

৫. ইন্দিরা গান্ধীর লোকজন ভোটারদের ধুতি, লেপ, কম্বল, ড্রিংকস দিয়েছে কিনা;

৬. ইন্দিরা গান্ধীর মার্কা গাভী ও বাছুর ধর্মীয় প্রতীক কিনা। যদি হয়, তাহলে তা আরপিএ এর ১২৩(৩) ধারার লঙ্ঘন হবে কিনা;

৭. ইয়াশপাল কাপুরের আয়োজনে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে বিনা ভাড়ায় আনা নেওয়া হয়েছে কিনা।

কোর্ট আরও বলেছে, ব্যালট পেপার টেম্পারিং এর অভিযোগের ক্ষেত্রে ইনভেস্টিগেশন হবে। এবার রাজনারায়ণের আইনজীবী কোর্টে সিপিসির অর্ডার ১১ অনুযায়ী ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশ্যে ইন্টারোগেটিস জমা দিলেন। ইন্টারোগেটরি মানে লিখিত প্রশ্ন। গান্ধীর আইনজীবী খারে আদালতে বললেন, ইন্টারোগেটরি সিভিল সু্যটে দেওয়া যায়, ইলেকশন পিটিশনে দেওয়া যাবে না। কিন্তু জাস্টিস ব্রম্নম ইন্টারোগেটরি এলাও করলেন।

মিস্টার খারে এই আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেন। সুপ্রিম কোর্টে মিস্টার খারে সুবিধা করতে পারেননি। তিনি আপিল প্রত্যাহার করে নেন।

ওদিকে রাজনারায়ণ তার আইনজীবী শান্তিভূষণের উপরে অসন্তুষ্ট ছিলেন। শান্তিভূষণ ব্যালট টেম্পারিংয়ের বিষয়টি সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। রাজনারায়ণ একজন সাইন্টিস্ট এনে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখালেন একই ব্যালটপেপার আলট্রা ভায়োলেট রশ্মিতে একরকম, ইনফ্রারেডে অন্যরকম দেখায়। কিন্তু শান্তিভূষণ সন্তুষ্ট হলেন না। জাস্টিস ব্রম্নম রাজনারায়ণ এর পক্ষে সিল দেওয়া ২০০ এবং ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সিল দেওয়া ৬০০ ব্যালট পরীক্ষা করে দেখলেন ব্যালটে ক্যামিক্যাল টেম্পারিং এর কোনো সত্যতা নেই।

কয়েকদিন পরেই ইন্দিরা গান্ধীকে ৩১টা লিখিত প্রশ্ন দেওয়া হয়। মিসেস গান্ধীর আইনজীবী প্রথমেই বললেন, এই প্রশ্নগুলো টহৎবধংড়হধনষব, াবীধঃরড়ঁং, ড়ঢ়ঢ়ৎবংংরাব, ঁহহবপবংংধৎু ধহফ রৎৎবষবাধহঃ.

ইন্দিরা গান্ধীর আইনজীবী মিস্টার খারে কয়েকটি ইসু্য বাদ দেওয়ার আবেদন করলেন। কারণ, ইসু্যগুলোতে সুনির্দিষ্ট কোনো সময়ের উলেস্নখ নেই। ইন্দিরা গান্ধী ঠিক কবে এবং কখন থেকে ক্যান্ডিডেট বিবেচিত হবেন, কখন তিনি ইয়াশপাল কাপুরকে এজেন্ট নিয়োগ করেছেন, কবে কখন কাকে ধুতি, কম্বল, লেপ, পানীয় দিয়েছেন তা স্পষ্ট করে পিটিশনে উলেস্নখ করা হয়নি।

রাজনারায়ণের আইনজীবী মিস্টার শান্তিভূষণ বললেন, ২৭ ডিসেম্বর যখন লোকসভা বিলুপ্ত করা হয়েছে তখন থেকেই ইন্দিরা গান্ধী ক্যান্ডিডেট। তারপরে তিনি যা যা করবেন সবক্ষেত্রেই ইলেকশনের আচরণবিধি প্রযোজ্য হবে। তাই সুনির্দিষ্ট করে সময়ের উলেস্নখ করার প্রয়োজন নাই।

কিন্তু হাইকোর্ট করাপ্ট প্র্যাকটিস বিষয়ক ইসু্যগুলোকে বাদ দিয়ে দেয়। রাজনারায়ণের পক্ষে পিটপশন এমেন্ডমেন্ট করার পারমিশন চাওয়া হয়। মিস্টার খারে আপত্তি তোলেন, এমেন্ডমেন্ট করে নতুন এলিগেশন আনা হচ্ছে। হাইকোর্ট পিটিশন এমেন্ডমেন্ট করার আবেদন খারিজ করে দেয়।

রাজনারায়ণ এবার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেন। সুপ্রিম কোর্টের তিনজন বিচারকের বেঞ্চ আপিলটি শুনে আপিল মঞ্জুর করলেন। রায় লিখেছেন বিচারপতি হেডজ। তিনি বলেছেন, ইঁঃ রভ :যব ঢ়বঃরঃরড়হ রং ৎবধফ ৎবধংড়হধনষু, ধং রঃ ংযড়ঁষফ নব, রঃ রং পষবধৎ :যধঃ :যব ধষষবমধঃরড়হ ড়ভ :যব ঢ়বঃরঃরড়হ রং :যধঃ :যব ংবৎারপবং ড়ভ ণধংযঢ়ধষ কধঢ়ড়ড়ৎ বিৎব ড়নঃধরহবফ নু :যব ৎবংঢ়ড়হফবহঃ যিবহ ংযব যধফ ধষৎবধফু নবপড়সব ধ পধহফরফধঃব ধহফ যিবহ ঝযৎর ণধংযঢ়ধষ কধঢ়ড়ড়ৎ ধিং ংঃরষষ ধ মধুবঃঃবফ ড়ভভরপবৎ. ওঃ রং :ৎঁব :যধঃ :যব রহমৎবফরবহঃং ড়ভ :যব পড়ৎৎঁঢ়ঃ ঢ়ৎধপঃরপব ধষষবমবফ রং হড়ঃ ংঢ়বপরভরপধষষু ংবঃ ড়ঁঃ রহ :যব ঢ়বঃরঃরড়হ নঁঃ ভৎড়স :যব ধষষবমধঃরড়হং সধফব রঃ ভষড়ংি ধং ধ হবপবংংধৎু রসঢ়ষরপধঃরড়হ. ডযরষব ধ পড়ৎৎঁঢ়ঃ ঢ়ৎধপঃরপব যধং মড়ঃ :ড় নব ংঃৎরপঃষু ঢ়ৎড়াবফ রঃ ফড়বং হড়ঃ ভড়ষষড়ি :যধঃ ধ ঢ়ষবধফরহম রহ ধহ বষবপঃরড়হ ঢ়ৎড়পববফরহম ংযড়ঁষফ ৎবপবরাব ধ ংঃৎরপঃ পড়হংঃৎঁপঃরড়হ . . . গড়ৎবড়াবৎ, হড় ড়নলবপঃরড়হ ধিং :ধশবহ :ড় :যব রংংঁব ধনড়ঁঃ ণধংযঢ়ধষ কধঢ়ড়ড়ৎ যিবহ রঃ ধিং ড়ৎরমরহধষষু ভৎধসবফ নু :যব :ৎরধষ লঁফমব. ঙনলবপঃরড়হ ধিং ড়হষু :ধশবহ যিবহ :যব ঢ়বঃরঃরড়হ :ড় ংবঃ ধংরফব :যব রহঃবৎৎড়মধঃড়ৎরবং ধিং যবধৎফ. ঞযবৎবভড়ৎব, রঃ রং পষবধৎ :যধঃ :যব ৎবংঢ়ড়হফবহঃ ধিং হড়ঃ রহ :যব ফধৎশ ধনড়ঁঃ :যব ধষষবমধঃরড়হ ড়ভ :যরং ঢ়ধৎঃরপঁষধৎ পড়ৎৎঁঢ়ঃ ঢ়ৎধপঃরপব.

এলাহাবাদ হাইকোর্টের জাস্টিস ব্রম্নম ইয়াশপাল কাপুরকে নিয়ে যে ইসু্যটা বাতিল করে দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট সেই ইসু্যটাও এভাবে একটু মডিফাই করে পুনরুজ্জীবিত করে দিয়েছে- ডযবঃযবৎ জবংঢ়ড়হফবহঃ ঘড়. ১ ড়নঃধরহবফ ধহফ ঢ়ৎড়পঁৎবফ :যব ধংংরংঃধহপব ড়ভ ণধংযঢ়ধষ কধঢ়ড়ড়ৎ রহ ভঁৎঃযবৎধহপব ড়ভ :যব ঢ়ৎড়ংঢ়বপঃং ড়ভ যবৎ বষবপঃরড়হ যিরষব যব ধিং ংঃরষষ ধ এধুবঃঃবফ ঙভভরপবৎ রহ :যব ংবৎারপব ড়ভ এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ওহফরধ. ওভ ংড়, ভৎড়স যিধঃ ফধঃব?

মামলা শুনানির জন্য আবার এলাহাবাদ হাইকোর্টে এলো। কিন্তু হাইকোর্টে যে বিচারপতির কোর্টে এতদিন মামলা চলছিল তিনি অবসরে চলে গেছেন। এরপরে মামলাটি এলো বিচারপতি কে এন শ্রীবাস্তব এর কোর্টে। মাঝখানে দেড় বছর চলে গেল।

এবার বাদীপক্ষের মৌখিক সাক্ষ্য নেওয়া হবে। প্রথম মৌখিক সাক্ষ্য শুরুর দিন ধার্য করা হলো ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩।

বাদীপক্ষের সাক্ষী হিসেবে তলব করা হলো মিস্টার এস এস সাক্সেনাকে। তিনি উত্তরপ্রদেশ সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি। মুখ্য সচিবের পক্ষে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন। কিন্তু তিনি বস্নু বুক (প্রাইম মিনিস্টারের সিকিউরিটি প্রটোকল সংক্রান্ত নথি), রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র সরকারের মধ্যে পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে আদান-প্রদান হওয়া চিঠিপত্র এবং প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া চিঠিপত্র আদালতে উপস্থাপন করতে অস্বীকার করলেন। তিনি দাবি করলেন, এগুলো অতি গোপনীয় রাষ্ট্রীয় করেসপন্ডেন্স। এগুলো আদালতে তোলা যাবে না। তিনি সাক্ষ্য আইনের-১২৩ ধারার প্রিভিলেজ দাবী করলেন।

মিস্টার শান্তিভূষণ এই দাবির বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন, এই নথিগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর করাপ্ট প্র্যাকটিসের তথ্য রয়েছে। এখানে এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর ১২৩ ধারার প্রিভিলেজ প্রযোজ্য হবে না। জাস্টিস শ্রীবাস্তব পরবর্তী তিন কার্যদিবস এই বিষয়ের উপরে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনলেন। শেষ পর্যন্ত জাস্টিস শ্রীবাস্তব স্টেট প্রিভিলেজের আর্গুমেন্ট প্রত্যাখ্যান করে ডকুমেন্টসগুলো কোর্টে উপস্থাপনের নির্দেশ দিলেন। মিস্টার খারে বললেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবেন। তার দুই দিন সময় দরকার। মিস্টার খারে দুই দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে লিভ টু আপিল করে হাইকোর্টের দেওয়া প্রোডাকশনের অর্ডার স্টে করে নিলেন।

এবার দুই পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের শুনানি অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি করা হলো। ওই তিনটা ডকুমেন্টস কোর্টে প্রডিউস করা যাবে কিনা এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টে মামলা চালানো যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টে আপিল পেন্ডিং থাকা অবস্থায় বিচারপতি শ্রীবাস্তবও অবসরে চলে গেলেন। এবার মামলাটির দায়িত্ব পেলেন বিচারপতি জাগমোহন লাল সিনহা।

(চলবে)

হাবিবুর রহমান, তরুণ আইনজীবী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে