শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতির মণিমালা শারমিন সুলতানা রীনা

নতুনধারা
  ০৪ জুন ২০২১, ০০:০০

খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে দীবা। গালিবের সঙ্গে সংসার বাঁধার পর থেকেই অভ্যাসটা ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। সকালে চা নাশতা আর রাতের ডিনার। বাচ্চারা যার যার মতো খেয়ে নেয় দীবা অপেক্ষা করে গালিবের জন্য। আগে দিনে বিশ-পঁচিশ কাপ চা খেতো দীবা ডায়েট কন্ট্রোল করার কারণে দুকাপে নামিয়ে এনেছে এবং অনেক আইটেম খাবার থেকে বাদ দিয়েছে। কফি তার পছন্দ নয় চা না পেলে তখন কফি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে খায়। গালিব অফিসে যাওয়ার আগে এককাপ কফি তাকে বানিয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে পুরো কফিটা না খেয়ে দীবার জন্য কিছুটা রেখে যায়। ফেলে না দিয়ে খেয়েই নেয় দীবা। অবশ্য এর পিছনে দীবার একটা যুক্তি আছে। আগে দীবা প্রচুর খেতো দশ বছর খাবার কমিয়ে প্রায় নয়-দশ কেজি ওজন কমিয়েছে। মেয়েকে স্কুলে হেঁটে আনতে যাওয়া। সন্ধ্যার পর গুলশান মার্কেটে হাঁটতে হাঁটতে কিছু কেনাকাটা করা এভাবে ঘরের কাজ নিজের হাতে করা। যার প্রধান কারণই হলো ওজন কমানো। গালিবকে হাজারবার বলেও লাভ হয়নি অনন্ত সকালে একটু হাঁটার অভ্যাস না শোনার ফলে দিনে দিনে ওজন বেড়েছে। আসলে ওকে বলেই বা কী। সাংবাদিকতার চাকরি সকালে গেছে এসেছে দুটো-তিনটেয় ঘুমাতে গেছে আরও দু-তিন ঘণ্টা পর। আসলে ব্রেনের তো একটা রেস্টের দরকার। যাই হোক- খাবার নিয়ে বসে আছে দীবা। গালিবের পছন্দের রান্না। দীবারও ভীষণ খিদে পেয়েছে। গালিব এলেই একসঙ্গে খাবে। এত দিনের অভ্যাস সহজে যায় না। আবার রাত করে খাবার খেলে দীবার সমস্যা হয়। তবু কিছু করার নেই। সারাদিন বাইরে থেকে কি খায় না খায়। একসঙ্গে বসে সারাদিনের জমানো কথাগুলো শেয়ার করা যায়। আড়াইটা বেজে গেছে। গালিবের আসার কোনো লক্ষণ নেই। বাচ্চারা খেয়ে শুয়ে পড়েছে। এবার দীবার ধৈর্যচু্যতি ঘটে। আর কত অপেক্ষা করা যায় মোবাইলটা হাতে গালিবের নাম্বারে ফোন দেয়। খুব কাছ থেকে ফোনটা বেজে ওঠে রিসিভ হয় না। আবারও ফোন করে। হঠাৎ টের পায় ফোনটা ড্রয়ারে বাজছে। এতক্ষন দীবা একটা ভ্রমের মধ্যে ছিল। গালিব আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। বলবে না ম্যাডাম সারাদিন কি করে কাটালে। বুকের মধ্যে একটা পাথরচাপা পড়ল। গালিবকে ছাড়া তার জীবন কীভাবে কাটবে সে ভাবনা নয়। গালিবের অকাল প্রয়াণ ভাবতে গেলে এক অন্ধকার গহ্বরে ডুবে যায় সেখান থেকে কোনোদিন তার মুক্তি নেই। নিজেকে আর আটকাতে পারে না দীবা। গুমোট বাতাসের মতো তার বুকের ভাঁজে ভাঁজে থাকা অমলিন স্মৃতি কান্না হয়ে ভেঙে দেয় বন্ধ জানালা-দরজা। আহা জীবন কত সহজে কাছের মানুষটাকে মুহূর্তে আড়াল করে ফেলে। সংসারে অভাব থাকলেও সুখে-দুখে আনন্দ বেদনায় কেটে গেছে দীর্ঘ বিবাহিত জীবন। তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে মোটামুটি ভালোই কাটছিল। তিন ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছে দেশের সেরা স্কুল-কলেজে। কোনো সেভিংস নেই তাদের। গালিব বলত ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে ক্যারিয়ার গড়লে তারাই হবে বড় অ্যাসেট এবং সেভিংস। মাঝেমধ্যে দীবা রাগ করে বলত তোমার সঙ্গে যারা চাকরি করে তারা অনেকেই গাড়ি বাড়ির মালিক তুমি তো কিছুই করতে পারলে না। গালিব হেসে উড়িয়ে দিত কোনো কথা না বলে ফোন নিয়ে বসত। গালিবের উপর, দীবার রাগ বন্ধ হত না। অবশেষে বুকের মধ্যে টেনে রিমির রাগ ভাঙাতো। বুঝিয়ে বলত সবাইকে দিয়ে সব হয় না। ছেলেমেয়েরাই একদিন তোমার বড় সম্পদ হবে। মৃতু্যর কিছুদিন আগে একাই একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাড়ি গেল। সেটাও একটা প্যাথেটিক ঘটনা। একমাত্র বোনের একমাত্র বারো বছর বয়সি সন্তানের মিলাদ মাহফিলে যোগ দিতে বাড়ি গেল। শাশুড়িমায়ের কাছ থেকে এটা-ওটা নিয়ে এল। এসে বলছে তুমি হাঁসের মাংস পছন্দ করো তাই মা দিয়েছে। সেই হাঁসের মাংস দীবার জীবনে শেষ খাওয়া। তারপর কতবার রান্না হলো। দেখলেই গালিবের কথা মনে পড়ে। খাওয়া বন্ধ করে দিল দীবা। গালিব যা পছন্দ করত খেতে রিমি সে সব খাবার থেকে দূরে সরে গেল। শাড়ি রিমি খুব পছন্দ করত মেয়ে, ভাগনি বড় বোনেরাসহ গালিব প্রায় তাকে শাড়ি কিনে দিত। একবার দেশি-দশে স্বল্প বাজেটে গালিবের জন্য পাঞ্জাবি কিনতে গেল। আড়ংয়ের পাঞ্জাবি গালিব ভীষণ পছন্দ করত। যাই হোক পাঞ্জাবি দেখতে দেখতে একটা কালো শাড়ির দিকে নজর পড়ে রিমির। শাড়িটা দশ হাজার টাকার উপরে দাম। গালিব বুঝতে পারে শাড়িটা রিমির পছন্দ হয়েছে। পাঞ্জাবি কিনে বের হলো দুজনই গালিব অফিসে চলে গেল দীবা বাসায়। সন্ধ্যায় হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দেখে গালিব সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। তুমি, এখন চাকরিটা আছে তো। আছে আছে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে আসলাম দেখ কি এনেছি। প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে প্যাকেটটা খুলে দেখে সেই শাড়িটা। : তোমার টাকা নেই শাড়ি কেন আনলে : তোমার পছন্দ হয়েছে বুঝেছিলাম ধার করে শাড়িটা কিনেছি। এমন কত ঘটনা এই ছোট্টজীবনে স্রোতের মতো বয়ে গেছে। কেউ কি গিফট করলে বাসায় ছেলেমেয়েকে ভাগ করে দিত কী আত্মতৃপ্তি ছিল সেখানে। কোনো অনুষ্ঠানে খাবার পার্সেল দিলে সেটাও বাসায় এনে বাচ্চাদের দিত। কোথাও গেলে দীবাকে ছাড়া যেতে চাই তো না হোক তা মাছের বাজার। শেষবার গিয়েছিল ২০২০ টাঙ্গাইল কবিতা অনুষ্ঠানে। তখন সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে করোনা নামক এক ভয়ংকর মহামারি। মহামারি এমন পর্যায়ে চলে গেল সরকার তখন লগডাউন দিতে বাধ্য হলো। গালিব অফিসের গাড়িতে আসা-যাওয়া করে। সাংবাদিকতার চাকরি কোনো ছুটি নেই। সংবাদপত্রসহ ব্যক্তিগত ফেসবুকে মানুষকে সতর্ক করা হলো। বাড়িতে মাকেসহ আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে সতর্ক করা হলো করোনার থেকে বাঁচতে। একদিন দীবা বলে আজ তুমি অফিসে যেও না। একটা ভালো পদে চাকরি করতে গালিব। : অফিসে না গেলে নিউজ কে দেখবে তা ছাড়া এই মুহূর্তে অফিসে না গেলে বেতন কেটে রাখবে। হায়রে জীবন হায়রে জীবিকা। রমজান শুরু হওয়ার আগে গালিবের জন্য প্যান্ট বানাতে দেয় দীবা। ভেবেছে পরে আড়ং থেকে একটা পাঞ্জাবি আর বাটার জুতো কিনে দেবে। হঠাৎ তিন-চার দিনের জ্বর ও ঠান্ডায় করোনার কাছে হার মেনে চলে গেল মৃতু্যর ওপারে। মৃতু্যর পর ধরা পড়ল করোনা। রিমি ও ছেলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাইশ দিন হসপিটালে থেকে বাসায় আসে। বাসায় এলেও পাড়া-প্রতিবেশীরা ভালো চোখে দেখলো না তাদের। গালিবের মায়েরও একই অবস্থা। ঢাকা থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হলেও মাকে শেষ মুহূর্তে সন্তানের মুখ দেখতে দেওয়া হলো না। অভাগী মা আজও বুক চাপড়ে কাঁদে সন্তানের অকাল প্রয়াণে। আর রিমিকে দিয়ে গেল এক বুক দীর্ঘশ্বাস আর কান্না। যে কান্নার শেষ নেই যতদিন বেঁচে থাকবে। রাতে ঘুম আসে না গালিবকে নিয়ে গল্প, কবিতা সাজায় বুকের রক্তে। দীবা ভাবে শুধু, কোনোদিন কোনো পৃথিবীতে সেকি তার গালিবকে খুঁজে পাবে? বিধির কাছে তার একটাই নিবেদন পৃথিবীর বুকে তাদের দুজনকে জাতিশ্বর করে পাঠালে যে কথাগুলো বলা হয়নি সে কথায় প্রাণ জুড়াবে। রিমি জানে তার চাওয়া কোনোদিন পাওয়ায় পরিণত হবে না। গালিবের অকাল প্রয়াণ তাকে দিয়ে গেছে একরাশ হাহাকার আর ধোঁয়াবিহীন আগুন। যে আগুন চোখে দেখা যায় না একটু একটু করে তিল তিল করে শেষ করে দেয় বাঁচার ইচ্ছা। তবু বেঁচে আছে বেঁচে থাকতে হয় ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়ে। একদিন তারা তাদের বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে এটাই জীবনের এখন একমাত্র লক্ষ্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে