রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
বই আলোচনা

নীল ফুলের একদিন

-আবরার নাঈম
  ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০

নীল ফুলের একদিন। শৈশবের স্মৃতিঘেরা একটি জীবন্ত আয়না। যেখানে তাকালে দেখা যায় নিকট অতীতে ফেলে আসা আমাদের শৈশবের কত রঙিন বিকাল। বাড়ির চারপাশে হরকিসিমের সবুজ গাছপালা। ভোর হলে পাখিদের কিচিরমিচির মধুর ডাক। বাড়ির পেছনে বিশাল কোনো পুকুর বা খাল-বিলে। যেখানে ফুটে অগণিত শাপলা, পদ্মা। এমন মনোরম নান্দনিক পরিবেশে কেটেছে যাদের শৈশব তারা নীল ফুলের একদিন বইটি পড়ে ভাববে বই পড়ছে না বরং সত্যি সত্যি আবার শৈশবে ফিরে গেছে।

নীল ফুলের একদিন। কিছু স্মৃতিচারণ করাবে আপনাকে। কখনো হাসবেন কখনো কাঁদবেন। একটা সময় গ্রাম-বাংলার ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র ছিল সুবহে মক্তব। কায়দা-রেহাল হাতে নিয়ে দলে দলে মসজিদে যাওয়ার সেই দৃশ্য এখন চোখে পড়ে না।

নীল ফুলের একদিন বইয়ের জনক সা'দ আমির তার শৈশবের পড়াশোনা চিত্রটা তুলে ধরেছেন এভাবে চারদিকে সবুজ প্রান্তর। আমরা ক্ষেতের আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ডেউয়া ফল বাগান পার হয়ে পড়তে যেতাম নূরানী মাদ্রাসা। প্রাণপ্রিয় খোরশেদ আলম সাহেব সুরে সুরে আমাদের বিভিন্ন আদব-কায়দা শেখাতেন। শেখাতেন কায়দার প্রথম পৃষ্ঠায় ঊনত্রিশ অক্ষরের মাখরাজ। আমাদের শিশু মগজে মুখস্থ বিদ্যার দারুণ প্রতিভায় শিকারির ছোড়া তীরের ন্যায় গেঁথে থাকত সেই আলিফ, বা, তা, সা'র মদ মাখরাজ এবং দুই রাকাত নামাজের ষাটটি মাসআলাসহ বিভিন্ন কাজের সমূহ আদব-কায়দা।

আসর থেকে মাগরিব। অল্প সময়। সারাদিন পড়াশোনার ফাঁকে এটুকু সময়ের মূল্য কম কীসে? এই অল্প সময়ের ছুটি পেয়ে এতটাই খুশি হতাম যতটা খুশি হয় খাঁচায় বন্দি কোনো পাখি খাঁচা থেকে মুক্ত হওয়ার পর। ডানা ভাঙা পাখি ডানায় ভর করে ওড়ার শক্তি পেয়ে যেমন খুশি হয়, তেমন। এ সময়টাতে আমরা মেতে উঠতাম নানা রকমর খেলাধুলায়। কখনো ঘুড়ি ওড়ানো, কখনো গোলস্নাছুট কখনো বা দৌড় প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। খেলাধুলা শেষে ক্লান্ত এবং ঘর্মাক্ত শরীরে স্বক্তি ফিরে পেতে ডুব দিতাম কোনো পুকুর কিংবা খাল-বিলে। আহ কি দারুণ অনুভূতি।

শৈশবের এ স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে 'নীল ফুলের একদিন' বইটি পড়ে। বইয়ের প্রতিটি পাতায় লেখক তার শৈশবের উপভোগ্য মুহূর্তগুলোকে খুব আকর্ষণীয়ভাবে চিত্রায়িত করেছেন।

এক জায়গায় তিনি লিখেছেন কোন কোন দিন আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা দিতাম। প্রতিযোগিতা শেষে যখন প্রচন্ড গরমে ঘেমে যেত শরীর তখন ঘর্মাক্ত শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়তাম মাদ্রাসা মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু খালের পানিতে। তারপর মাগরিবের আজান পড়ে যেত। তার আগে আমরা ফিরে আসতাম মাদ্রাসা। কিভাবে ফুরিয়ে যেত আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো কিংবা গোলস্নাছুট খেলার দিন।

ছোটবেলা মা-বাবার কাছে কতশত বায়না ধরেছি। কখনো বাস্তবে কান্না করেছি। কখনো কান্নার বাহানা করেছি বায়না পূরণের জন্য। এটা কিনে দিতে হবে। ওটা কিনে দিতে হবে ইতি ইত্যাদি। নীল ফুলের একদিন বইটি আগাগোড়া পড়ে যাচ্ছি পড়তে পড়তে একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় গিয়ে পেলাম লেখকও তার শৈশবের অগণিত বায়না থেকে খুব স্পর্শকাতর একটি বায়নার কথা তুলে ধরেছেন। সেটা হলো রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি কিনে দেওয়ার বায়না।

দুপুর দিকে বাবার সঙ্গে মেলায় রওনা দিলেন। সঙ্গে আরও অনেকেই। পথিমধ্যে ছোট একটা নদী পড়ল। হাঁটুপানি হবে হয়তো বা। তার ওপর বাঁশের সাঁকো-

অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো।/আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে,/পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,/দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি। নদী পেরিয়ে মেলায় গেলেন। পুরো মেলা পায়চারি করলেন। বিভিন্ন ধরনের মজাদার খাবার খেয়ে সবাই তৃপ্ত। এবার ফেরার পথে। বাবার কাছে লেখকের বায়নার কথাটা সরাসরি বই থেকে পড়ুন। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কিছু কিনব কি না। আমি বললাম আমাকে একটা লাল রঙের রিমোট রিমোটের গাড়ি কিনে দাও। তখন শিশু মনে শিশু শিশু স্বপ্ন। আমার গাড়ি হবে- যা রিমোট দিয়ে কন্ট্রোল করা যাবে। রিমোট গাড়ি তখন সম্ভবত নতুন নেমেছে। দামও অনেক বেশি।

এতোটুকু পর্যন্ত পড়ে মনে মনে আনন্দিত হয়েছিলাম বেশ। কারণ এরকম শত বায়না তো আমিও ধরেছি।

পরের অংশটুকু পড়ে নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। আসলে সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। পড়ুন পরের অংশটুকু বাবা পকেট থেকে টাকা বের করে হিসাব করে দেখলেন রিমোটের গাড়ি কেনার মতো টাকা তার কাছে অবশিষ্ট নেই। আমি বাবাকে বললাম 'চলো বাড়ি চলে যাই, লাগবে না গাড়ি। আরেকবার এসে কিনব নে। বাবার চোখে যেন পানি টলমল করছে। আরেকটু হলেই যেন বেরিয়ে আসবে। গড়িয়ে পড়বে কপাল বেয়ে। আনোয়ার ভাইকে বললেন- ওদের নিয়ে এখানেই দাঁড়া আমি আসতেছি।' বলেই বাবা মানুষের ভিড়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসলেন। বাবার হাতে একটা লাল গাড়ি রিমোটের নয়, তবে ব্যাটারির। দুটো পেন্সিল ব্যাটারি দিয়ে পরিচালিত হয় সেই গাড়ি। কি যে আনন্দ লাগছিল আমার ভেতরে ভেতরে। গাড়ির জন্য নয়, সেইদিন বাবার চোখে আমি মায়া দেখেছিলাম- কঠিন মায়া। আজও বহুদিন পর বাবার কিনে দেওয়া সেই লাল গাড়িটার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাবার মায়া চোখ।

বই : নীলফুলের একদিন, ধরন: স্মৃতিগদ্য, লেখক : সাদ আমির

প্রকাশক : সাহিত্যদেশ, মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা, ছাড়মূল্য : ১৪০ টাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে