সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাহিত্যে প্রথম নোবেল জয়ী সু্যলি প্রম্নদোম

শিল্পী নাজনীন
  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তি- এই পাঁচটি বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে নোবেল পুরস্কারের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতেও নোবেল প্রদানের রীতি চালু হয়। নোবেলকে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে গণ্য করা হয়। সাহিত্যে প্রথমবার এই সম্মানজনক পুরস্কারটি পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক সু্যলি প্রম্নদোম। পুরো নামর্ যনে ফ্রঁসোয়া আরমঁ (সু্যলি) প্রম্নদোম। তিনিই ১৯০১ সালে প্রথমবারের মতো সাহিত্যে নোবেল পেয়ে পৃথিবীতে চির অমর হয়ে আছেন। সু্যলি প্রম্নদোম ১৮৩৯ সালের ১৬ মার্চ ফ্রান্সের প্যারিসে খুব সাধারণ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবার মৃতু্যর পর তার শৈশব কাটে মা আর বড় বোনের স্নেহসান্নিধ্যে। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী প্রম্নদোমের পাঠ্য বিষয় ছিল গণিত। স্কুল জীবন শেষে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর গণিতে স্নাতক শেষ করেন। পরে বাল্যকাল থেকে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখা সু্যলি প্রম্নদোম সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রকৌশল বিষয়ে ভর্তি হন। কিন্তু চোখে অপথ্যালমিয়া নামক রোগের আক্রমণে শেষপর্যন্ত তিনি সেখানে আর পড়তে পারেননি। ফলে তিনি পড়ালেখায় সেখানেই ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একটি কারখানার করণিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সে সময় তিনি সারাদিন নিজেকে অফিসের কাজে ব্যস্ত রাখতেন আর গভীর রাত জেগে কবিতা লিখতেন। কিন্তু শিগগিরই এই জীবনে ক্লান্তি এলো তার, একঘেয়ে মনে হলো জীবন। নিজের লেখা কবিতাগুলোকে তার নিজের কাছেই শিল্পোত্তীর্ণ মনে হলো না আর। ফলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুনরায় পড়াশোনায় ফিরতে চাইলেন তিনি। ফলে তার পরিবার তাকে তার এক খালার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তিনি প্রথমে সাহিত্যে ও পরে আইনশাস্ত্রে ভর্তি হন। সফলতার সঙ্গে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে তিনি কিছুদিন সিনিয়র আইনজীবীদের সহকারী হিসেবে কাজও করেন। কিন্তু এখানে থাকতেই এই খালার সুন্দরী মেয়ে লিওনের প্রেমে পড়ে যান প্রম্নদোম। লিওনের সঙ্গে সবসময় ওঠাবসা ও চলাফেরা করতে করতে তার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন প্রম্নদোম। কিন্তু যখন তিনি লিওনকে প্রেম নিবেদন করেন, তখন লিওন তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। প্রম্নদোম এতে মানসিকভাবে ভীষণ আঘাত পান এবং জীবনে কখনো বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতেও লিওন প্রম্নদোমকে প্রেমিক হিসেবে গ্রহণ না করে বরং অন্য একজনকে বিয়ে করেন। প্রম্নদোম লিওনকে তবু মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি এবং বাকি জীবন তিনি অকৃতদার অবস্থায় কাটান। লিওনকে না পাওয়ার এই বেদনা, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা প্রম্নদোমকে করে তোলে একজন প্রকৃত কবি। এই বেদনা তাকে দেয় কবিত্বের আশীর্বাদ। জীবনের যত অপ্রাপ্তির বেদনা, বঞ্চনার হাহাকার, অতৃপ্তির বিষণ্নতা সব তার লেখার মাধ্যমে কবিতা হয়ে ঝরে পড়তে থাকে অজস্র ধারায়। প্রম্নদোম তার সব যন্ত্রণা ও বিষাদকে তার লেখার মাধ্যমে কবিতায় রূপান্তরিত করেন, সৃষ্টি করেন অমর সব কাব্য। নিজের কবিতার মান নিয়ে হতাশ, বিফল মনোরথ হয়ে যে প্রম্নদোম সু্যলি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, তিনিই অতঃপর একের পর এক লিখতে থাকেন অমর সব প্রেমকাব্য। লিওনকে না পাওয়ার হাহাকার আর বিরহ বিষাদ তাই তার প্রথমদিকে রচিত প্রায় সব কাব্যগ্রন্থজুড়ে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। যৌবনে রচিত প্রম্নদোমের সব কবিতাই তাই প্রেমপ্রধান। সু্যলি প্রম্নদোমের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্তঁস এ পোয়েমস' প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি দিয়েই তিনি তৎকালীন সাহিত্য সমালোচকদের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হন। বিশেষ করে ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সাঁতে বোভ তরুণ কবি প্রম্নদোমকে কাব্য জগতের 'উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক' হিসেবে অভিহিত করেন এবং সাহিত্যাঙ্গনের সবার সঙ্গে তাকে পরিচিত করে তুলতে সচেষ্ট হন। তার প্রথমদিকের অন্যান্য উলেস্নখযোগ্য রচনার মধ্যে 'লেস ইপরিউভিস' (১৮৬৬) এবং 'লেস সলিটিউড' (১৮৬৯) কাব্যগ্রন্থ দুটিও প্রেম ও প্রেমের করুণ পরিণতিকে উপজীব্য করে রচিত। চলিস্নশের পরে এসে সু্যলি প্রম্নদোমের সাহিত্যচর্চার দিক পরিবর্তিত হয়। এ সময় তিনি মানব-মানবীর চিরন্তন সম্পর্ক তথা প্রেম-বিরহের জগৎ ছেড়ে বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন এবং সাহিত্যচর্চাতে আরো বেশি নিবেদিত হন। নিজের ভেতরের আবেগের সুতোয় তিনি লাগাম পরান এবং বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক বিতর্ককেই তিনি তার প্রধান পাঠ ও রচনার বিষয়বস্তু করে নেন। কিন্তু এখানেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো ধর্মের ব্যাখ্যাই তার মনঃপূত হয়নি। ফলে তিনি এ নিয়ে আরো পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। তার কবিতার বিষয়বস্তু ছিল অনেক জটিল। বাস্তব জীবনের নানা অভিজ্ঞতার সূক্ষ্নাসূক্ষ্ন ব্যাখ্যা তার কবিতায় পাওয়া যায়। অচেনা বাস্তব এবং চেনা অভিজ্ঞতা তার কবিতার অন্যতম অনুসঙ্গ। তিনি মনোবিজ্ঞান এবং দর্শনের ওপরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন- যেগুলো তার গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি ফ্রান্সের আলোচিত সাহিত্য আন্দোলন 'পার্নাসাস'-এর অন্যতম নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন। 'শিল্পের জন্য শিল্প' এই মতবাদ প্রচার করা এবং শিল্প-সাহিত্যে এই বিশ্বাস পুরোপুরি অনুসরণপূর্বক মানুষের উপযোগী শিল্প সৃষ্টি করাই ছিল এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। প্রম্নদোম কাব্যচর্চা থেকে রোমান্টিকতার আধিক্য বিসর্জন দিয়ে সেখানে মানুষের সাধারণ দর্শন প্রতিস্থাপন করা এবং মানুষের জন্য একটি সুস্থ ও মঙ্গলজনক শৈল্পিক পরিসর বিনির্মাণ করায় বিশ্বাস করতেন। ১৮৭০ সাল ছিল প্রম্নদোমের জীবনের সবচেয়ে করুণ বছর। এ বছরই তার মা, বড়বোন এবং যে চাচার আশ্রয়ে তিনি ছিলেন তারা সবাই একে একে মৃতু্যবরণ করেন। ফলে প্রম্নদোম পুরোপুরি একা ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এ বছরেই তিনি ফ্রাঙ্কো-প্রম্নশিয়ান যুদ্ধে যোগ দেন। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি 'আঁপ্রেসিও দ্য লা গের' নামক কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন। ১৮৭০ সালেই ভুল চিকিৎসায় তিনি চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে যান। ১৮৮৮ সালে তার সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টি 'ল্য বোনর' প্রকাশিত হয়- যা অমর মহাকাব্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তার কবিতা পাঠ করে প্রখ্যাত কাব্য সমালোচক জঁ-আলবের বেদে বলেছিলেন, 'সু্যলি প্রম্নদোমের কবিতা চরম হতাশাগ্রস্ত মানুষকে শেখাতে পারে, আনন্দ বা যন্ত্রণা আসে আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার পথ ধরেই।' ১৯০৬ সালে তার জীবনের শেষ গ্রন্থ 'লা সাইকোলজি দু্য লিব্র-আর্বিত্র' প্রকাশিত হয়। সু্যলি প্রম্নদোম তার সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ফরাসি সাহিত্য একাডেমি কর্তৃক স্থায়ী সদস্যপদ এবং ১৮৮১ সালে ফরাসি একাডেমির পরিচালক নির্বাচিত হন। তিনি আমৃতু্য এই একাডেমির সদস্য ছিলেন। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরের ১০ তারিখে প্রম্নদোম বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ এই প্রাপ্তি নোবেল পুরস্কার ও সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময়ে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুইডিশ একাডেমি কমিটির অনুরোধে কবির পক্ষ থেকে একজন ফরাসি মন্ত্রী প্রম্নদোমের নোবেল পুরস্কার ও সনদ গ্রহণ করেছিলেন। মৃতু্যর আগে প্রম্নদোম তার নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ দিয়ে একটি অনুদানমূলক পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন- যা নবীন লেখকদের উৎসাহ দানের উদ্দেশ্যে করা হয় এবং এটি এখন পর্যন্ত ফ্রান্সে প্রচলিত আছে। ১৯০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি ফ্রান্সের শাতনে-মালাব্রি শহরে ৬৭ বছর বয়সে মৃতু্যবরণ করেন। সু্যলি প্রম্নদোমের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে নোবেল কমিটি বলেন, 'তার নোবেল প্রাপ্তির কারণ হলো তার কবিতার অসাধারণ বাক্য গঠন রীতি- যা আমাদের উচ্চ আদর্শবাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এছাড়া, তার লেখার যথার্থ শৈল্পিক সৌন্দর্যবোধ, অনুভূতির মননশীল বিকাশ এবং বুদ্ধিদীপ্ততার অপূর্ব মিলন আমাদের মন ও চিন্তার জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।' ১৯০১ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদানকালে সুইডিশ একাডেমির তৎকালীন স্থায়ী সচিব সি ডি আফ ওয়্যারসন বলেন, 'সুইডিশ একাডেমির কাছে এই নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের জন্য অসংখ্য উচ্চ পর্যায়ের সুপারিশ এসেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আরও যত সমমানের সাহিত্যিক আছেন তাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে বিচার বিশ্লেষণ করে সু্যলি প্রম্নদোমকেই এই সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মানের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে মনে হয়েছে আমাদের কাছে। কবি, দার্শনিক ও ফরাসি একাডেমির সদস্য সু্যলি প্রম্নদোমই হলেন বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম নোবেল বিজয়ী গৌরবদীপ্ত সৌভাগ্যবান।' সু্যলি প্রম্নদোমের অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, 'সু্যলি প্রম্নদোম ১৮৬৫ সালে তার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্তঁত এ পোয়েমস' দিয়েই ভবিষ্যতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কে নিজেকে প্রবেশ করান। এই কাব্যগ্রন্থটি বিশ্বের বহুসংখ্যক কবি, সাহিত্যিক ও কবিতা প্রেমিক ও দার্শনিকদের দ্বারা পঠিত ও সমাদৃত হয়েছে। সু্যলি প্রম্নদোম আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি; তার বহুসংখ্যক কবিতা মণিমুক্তার চাইতেও অমর-অক্ষয় হিসেবে যুগ যুগ টিকে থাকবে। পরিশেষে আমি উলেস্নখ করব, সু্যলি প্রম্নদোমকে পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে মূলত আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। কেননা, আলফ্রেড নোবেল নিজেও এই আদর্শবাদের ঐকান্তিক পূজারি ছিলেন। সু্যলি প্রম্নদোম এই পুরস্কারের মাধ্যমে সারা বিশ্বে অমর হয়ে থাকবেন, এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।' সু্যলি প্রম্নদোম পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও রেখে গেছেন তার অমর সাহিত্যসম্ভার। 'লেস ডিসটাইন' (১৮৭২), 'ল্য ফ্রান্স' (১৮৭৪), 'লেস ভেইনস ট্রেন্ডরেসস' (১৮৭৫), 'ল্য জিনিথ' (১৯৭৬), 'ল্য জাস্টিস' (১৯৭৮), 'পোয়েসার' (১৯৮৮), 'ল্য প্রিজম' (১৯৮৬), 'ল্য বনোর' (১৮৮৮), 'ইপাভস' (১৯০৮) প্রভৃতি তার উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়াও তার কয়েকটি প্রবন্ধ সংকলনও রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে