সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক চিলতে রোদ

নুর নাহার নিপা
  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

গ্রামটির নাম সুন্দরপুর। খুব ভোরে শিশির ফোঁটা নরম ঘাসে হাঁটতে অর্ক বেশ পছন্দ। কিছুটা কুয়াশা শীতল ছায়া মিষ্টি হাওয়া কী আমেজ লাগছে দেহে।

ছাদে কার্নিশে বসে দু'টি পাখির কলকলে শব্দ গাছের পাতাগুলো বাতাসে তীব্র রুফ কর্কশে সে পালিয়ে যেতে লাগলো দূরে বহু দূরে।

অর্কদের দু'টি বাড়ি, একটি গ্রামে, একটি শহরে। অর্ক বেশির ভাগ গ্রামে সময় কাটে। প্রকৃতি যেন তাকে হাতছানি দিয়েই ডাকে? অর্ক বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করে। সব সময় আটপৌরে কীটপতঙ্গ ও পশুপাখি, নদী, প্রকৃতি সাধারণ জীবন আগ্রাসী ক্ষুধায় আচ্ছন্ন হৃদয় কোরক একজন যুক্তিবাদী মানুষ। স্পষ্ট মন্তব্যের জন্য কখনো সে বিখ্যাত হলেও জনপ্রিয় ও হয়েছেন।

তবে সেই জনপ্রিয়তার লাভের পথ খুঁজে না, সেই কাজ করে দেশের জন্য ক্ষুধা যে জয় করতে পারে না সে কিসের দেশ প্রেমিক। নেতারা শুধু বড় বড় স্স্নোগান দেয়, সব মুখোশ পরা ভদ্র লোক। রুশ প্রবাদ বলেছিল, টাকা যখন কথা বলে সত্য তখন চুপ করে থাকে। অর্ক বাবা একজন আদর্শ শিক্ষক তিনি কখনো অন্যায় মেনে নেননি সংসারটা ছোট- মা, বাবা, ছোটবোন রিয়া, স্বামী-সন্তান নিয়ে রিয়া বেশ সুখে জীবনযাপন করে। অর্ক চোখে মুখে জল দিয়ে একটু হাত-পা ছাড়িয়ে সোফাতে বসে। এক কাপ গরম গরম কফি খেয়ে মনটা ফুরফুরে অন্যরকম লাগছে। অর্ক মা এসে বলে বাবা মুখটা তোমার শুকনো কেন নাস্তা করনি। মা তো ছেলেকে চোখে হারাই।

বাবা অর্ক আজ তোমার জন্মদিনের সেলিব্রেশন চলছে। সন্ধ্যায় কোথাও যাবে না।

গুধূলি বেলায় আনন্দ মুখর সন্ধ্যা জন্মদিনের আয়োজনে গেস্টরা আসতে লাগল। সবাই ওর খুব কাছের মানুষ। ওর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কবি সাহিত্যক ও শিল্পী গায়ক পরিবেশটা বেশ হই হুলেস্নাড় প্রাণবন্ত, সবাই এসেছে- বেশ ভালো লাগছে। এমন সময় গান পরিবেশন করল মিষ্টি মেয়ে অনন্য।

অর্কের মনটা গানের সুরে ছুঁয়ে গেল। অনন্য ও অর্ক বেশ জমিয়ে আড্ডা দিল। বন্ধুরাসহ... এক বন্ধু রাহুল বলল দোস্ত কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, দুনিয়ার সবচেয়ে মস্ত হেঁয়ালি হচ্ছে মেয়েদের মন। অর্ক হু হু করে হেসে উঠলো।

অর্ক, কয়টা মেয়ের মন নিয়ে নাড়া দিলি রাহুল। সবাই হেসে উঠে। এই রাহুল প্রেম করিস নাকি?

না, তবে টেনিসন বলেছিল, ভালোবাসা যা দেয় তার চেয়ে বেশি কেড়ে নেয়। অর্ক বলে এই রাহুল তুই কী দার্শনিক হয়ে গেলি নাকি?

\হএই অর্ক দেখিস প্রেমে পড়িস না। অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলে যায়, কিন্তু অর্ক দু'চোখ খুঁজে অনন্যকে দেখে ভাবে কী মিষ্টি মেয়ে।

প্রেমে তো পড়ে গেলাম- কী হবে আমার! লেখাপড়ার পাশাপাশি ভালো একটা চাকরি হলেই ভালো হয়। জীবন মানে ধূসর পান্ডুলিপি।

অর্ক ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘের মিছিল দেখছে, টুপটাপ কাঁদছে আকাশ, ঝিরঝির উদাসী বাতাস মনে হয় এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে। অনন্যকে চোখের আড়াল করতে পারছে না। কাল সন্ধ্যায় একবার দেখা করতেই হবে।

অর্ক, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির পর সন্ধ্যায় লেকের কাছাকাছি ঘুরতে গেল সেখানে বন্ধুরা সবাই আসে।

অনন্যকে দেখতে পাই, অর্ক বলে অনন্য পিস্নস একটু কথা ছিল।

অনন্য বলে, আজ সত্যই সময় হবে না; অন্যদিন।

অর্ক কেন কোথায় যাবে?

অনন্য আমি মন্দিরে যাব পূজো দিতেই, অর্ক অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, তুমি হিন্দু! জানতাম না।

তাহলে শুনেন, আমার বাড়ি কলকাতা। বাবা, মা, রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ডা. অশোক চ্যাটার্জি আমার বাবা ছিলেন। আমি অনন্য চ্যাটার্জি এইখানে বেশি সময় মাসিমার সঙ্গে থাকি। আমার ঠাকুর মা ও দিদি ভাই জামাই বাবু এবং মিষ্টি একটা সোনা বউদি আছে। আমাকে কখনো মন খারাপ করতে দেয় না।

আজ আমাদের বড় পূজো আছে মন চাইলে আসুন। এভাবে বেশ কিছুদিন পার হলো, অর্ক কিছুতেই ভুলতে পারে না অনন্যর মুখটা। লেকের ধারে অপেক্ষা করে। অনন্যকে দেখে অর্ক খুশিতে মনটা হেসে উঠে।

লেকের জলে চিক চিক রোদ ভেসে গেল। নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে হাত। অনন্য হাত সরানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারছে না। মন চায়, হাত দু'টি ধরে বসে থাকতে। প্রিয় লেকের পাশে অবিরত না বলা শব্দগুলো আক্রান্ত মনে হিরন্য মায়ায় ঘ্রাণে উড়ে গেল ভালোবাসার ছোঁয়া। উদাসী বাতাস দোলা দেয় লোকোচুরি মনে। অনন্য, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না কোথাও।

অনন্য তা কি করে হয়। তুমি আমি মাঝখানে বিশাল দেয়াল। অর্ক বলে অনন্য তুমি আর কিছু বলো না পিস্নস। আমি শুনতে চাই না। আমি শুধু তোমাকে চাই।

অর্ক বলে তুমি আমার জীবনের নতুন ভাবনা, নতুন অধ্যায়। অনন্য, আমি কী তোমার হতে পারি? অনন্য এত সুখ আমার সহ্য হবে না। অনন্য বলে, মুসলিম পরিবারে তোমার জন্ম। কেউ কি আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে।

অর্ক কেন নয়... আমরা দু'জনে সুখ খুঁজে আপন ভুবনে থাকব।

এই অবুজ মন বুঝে না। হিসাবের ডালি শূন্য নির্জনতার দেহের ক্ষতে সোহাগের প্রলেপ আড়ালে তুমি শুধু আমার। অনন্য হঠাৎ আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে।

আবেগে কেঁদে ফেলে সে। অর্ক বলে, ধুর- বোকা মেয়ে; আমি আছি না। তোমার কিছুই হবে না আমি থাকতে। প্রেম কী মানে- ধর্ম সত্য ন্যায়।

অর্ক আমি তোমার নামে মন্দিরে পূজো দেব। রোজ সকালে মন্দিরে ঠাকুরের কাছে তোমাকে চাইব।

বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলো। এইভাবে দু'পরিবার জানতে পারলো অর্ক আর অনন্য সম্পর্কের কথা।

অনেক দিন তাদের যোগাযোগ হয় না। দু'পরিবার বেশ কড়া শাসনে রাখে দু'জনকে। দূরে থাকলেও কী কাছের মানুষ দূরে চলে যায়? হয়তো না। স্মৃতিরা বড়ই জঞ্জাল। তাই তো শরৎ চন্দ্র বলেছিল, শুধু মাত্র অস্তিত্ব রক্ষার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই।

ওইদিকে তার বোন রিয়ার স্বামী বেশ অসুস্থ। মাথায় টিউমার অপারেশন করা হলো কলকাতা। এত চিকিৎসা কিছুতেই ভালো হলো না। হাস্যময় মুখটা হঠাৎ করে নিভু হয়ে গেল। সৈকত চলে গেল না ফেরার দেশে। রিয়াকে নিয়ে সবার সমস্যা কোন কিছুতেই তার স্বামীর মৃতু্য মেনে নিতে পারে না। রিয়া আগের মতো হাসে না, কথা বলে না। একা থাকতে পছন্দ করে। তার মেয়ে নাম ফুল। ফুলকে আকড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ।

মা-বাবা নতুন করে জীবন সংসার শুরু করতে বলে।

রিয়া রেগে যায়। ফুল তার জীবনের একমাত্র ভরসা। নতুন করে তোমরা আমাকে আর কোনো দিন সংসার করতে বলো না। আমার সব চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দিয়েছি। আমি শুধু ফুলকে নিয়ে বাঁচতে চাই। অর্ক অনন্যর কোনো খবর পায় না। অনলাইনেও তাকে পাই না। ওইদিকে অনন্য ভাবতে থাকে। অর্ক তাকে ভুলে গেছে নতুন চাকরি পেয়ে। হয়তো নতুন বান্ধবী জুটেছে। বেশ অভিমান।

অর্ক নীরবতা মনের ক্যানভাসে ধরে রাখে বুকের মাঝে। একাকিত্ব আর দীর্ঘশ্বাস। সময়কে ধরে রাখা বারবার কক্ষচু্যত হতে বেঁচে থাকা। ঝিরঝির ঢাক নিরবচ্ছিন্ন রাত চরা পাখিগুলো কিছু বলতে চায়।

অর্ক অনেক দিন পর ম্যাসেজ করল অনন্যকে।

তুমি না এলে নেশাচর রাতে ঘর ছাড়া হয় ঘুম

তুমি না এলে অশ্রম্ন 'ভিজছে গোলাপ চারা

তুমি না এলে ইনবক্স আমার খালি

পাই না তোমার দামি ম্যাসেজ।

তুমি কাছে না এলে পৃথিবীটা লাগে পর। তোমার সঙ্গে আমার যাবতীয় অন্তর্বাস'। অনন্য ম্যাসেজটা পড়ে চোখ দু'টি জলে ভরে যায়। মনে হয় অর্ক খুব কাছে, তার সঙ্গে কথা বলছে। সব অভিমান ধুয়েমুছে যাই। এরই নাম ভালোবাসা। এক সময় দু'জনে দেখা করে এক পলক তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে। সব কথা খুলে বলে। অর্ক জানি, খুব মিস করছিলা- তবে মেয়েদের মন তা বলবে কেন?

অনন্য বলে একদম না। অনন্য আমার মধ্যে রসবোধ থাকলে শব্দের মাধুর্য দিয়ে কবিতা তৈরি করে তোমাকে শুনাবো। সেই দক্ষতা আমার নেই। অর্ক তোমার কথার মালাগুলো চুমকির মতো ঝরে পড়ছে। অর্ক অনন্য আমার সঙ্গে কী রসিকতা হচ্ছে।

আমি হবো দিলিস্নর সম্রাট শাজাহান আর তুমি আমার মমতাজ একটা তাজমহল তৈরি করতেই হবে। হা-হা-হা-হা-।

অনন্য, আমি কিছুই চাই না মুঠো মুঠো ভালোবাসা দিও। আর কোনো অভিমান নয়। অভিমান বড্ড চেনা তবুও মাঝে মাঝে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। অনন্য, রিয়ার কথা জানতে চাই। অর্ক বলে সেই এক আবেগী মন। স্বামীর স্মৃতি বুকে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে। অনুভূতির পারদ যত উপরে ওঠে প্রেমও তত গভীর হয়। প্রেমের ক্ষেত্রে নারীর জীবন স্বার্থক। সে অল্পে সন্তুষ্ঠ। তাই সে মিলনের ভারে অবনতা। কিন্তু পুরুষের অনন্ত ক্ষুধা। তাই সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। অর্ক কি ভাবছ? 'আমাদের সম্পর্ক। ভাবনার জগৎজুড়ে একটি চাওয়া, অনন্য... মৃতু্য দিয়ে আমার প্রেম সমাধি হবে। অর্ক এত দূর। কে বড়- জীবন নাকি মৃতু্য। দুজনে চেয়ে থাকি সুন্দর পৃথিবীতে একমুটো রঙিন স্বপ্ন নিয়ে; এক চিলতে রোদ্দুর অপেক্ষাই।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে