শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর

ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার পথিকৃৎ

রুহুল ইসলাম টিপু
  ১৪ জুন ২০২১, ০০:০০

প্রয়াত নিলুফার মঞ্জুর বাংলাদেশের শীর্ষ ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সানবিমসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। সাধারণ শিক্ষা, প্রোফেশনাল শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের দেশে রয়েছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা যেটি ব্রিটিশ কারিকুলামে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত 'ও' লেবেল (গ্রেড-১০) এবং 'এ' লেবেল (গ্রেড-১২)। আমাদের দেশের বিত্তবান অর্থশালী ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের প্রতিবেশী ভারতে পাঠিয়ে 'ও' লেবেল এবং 'এ' সম্পন্ন করাতেন এবং এখনো করিয়ে থাকেন। কেউ কেউ এখনো আরও উন্নত দেশে সন্তানদের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এটি সক্ষমতা এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। তবে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে ইংরেজি বিকাশ-প্রকাশ জানা, পারদর্শী মানুষের সংখ্যা সে বিচারে আশানুরূপ নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর বই-পুস্তক, শিক্ষা আয়ত্তের মাধ্যম এখনো ইংরেজি। বিশ্ব পরিমন্ডলে আমাদের সাফল্য ও গৌরব বৃদ্ধিতে ইংরেজিকে আরও বেশি আলিঙ্গন করে শিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা এমন মতই প্রকাশ করেন।

সেই ধারাবাহিকতায় শিক্ষাবিদ নিলুফার মঞ্জুর ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সানবিমস ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সানবিমস গড়ে ওঠে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাকে কেন্দ্র করে; ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়। ছাত্রছাত্রীরা গড়ে উঠবে বাংলাদেশি আদর্শে, শিক্ষা হবে বাংলা সংস্কৃতির আবহে, সনদপ্রাপ্তির সঙ্গে তারা হবে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ। দেশ এবং জাতি গঠনে রাখবে মহান অবদান। অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর সনাতনী শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিবিষ্ট করলেন জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার চর্চা। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোতে আরও যে সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুল রয়েছে; তাদের সঙ্গে সানবিমসের মৌলিক পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য দ্বারা আজ প্রমাণিত যে, অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর এক মহীয়সী কিংবদন্তি শিক্ষাবিদ যিনি বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার পথিকৃত। তিনি শিক্ষাদানের পাশাপাশি সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির (এসএমসি) সাবেক পরিচালক ছিলেন। নিলুফার মঞ্জুরের স্বামী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ছিলেন দুইবার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী। তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাকালীন বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান ছিলেন। নিলুফার মঞ্জুরের পিতা ডক্টর মফিজ আলী চৌধুরী ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের কেবিনেটের একজন মন্ত্রী।

জানা যায়, তার ছাত্রছাত্রীরা দেশে-বিদেশে অসামান্য সাফল্যমন্ডিত। তাদের একজন নাহিদ ইজাহার খান। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন-৫ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তার পিতা শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর-বিক্রম। নাহিদ ইজাহার খান এমপি হওয়ার জন্য নিলুফার মঞ্জুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নিলুফার মঞ্জুর তার ছাত্রী নাহিদ ইজাহার খানের স্কুলজীবনে অভিভাবকের মতো দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নাহিদ ইজাহার খান জানান, ঢাকার স্কুলগুলো তাকে ভর্তি করতে চাননি। কারণ তিনি ছিলেন কর্নেল নাজমুল হুদা বীর-বিক্রমের কন্যা। যিনি ১৯৭৫ সালের সেনা অভু্যত্থানে নিহত হয়েছিলেন। তখন তিনি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত ছিলেন। কিন্তু নিলুফার মঞ্জুরের সানবিমস স্কুল তাকে লেখাপড়ার আশ্রয়টুকু দিয়েছিলেন। তিনি এ স্কুলে ভর্তি হয়ে মানসিক আঘাত উপশম করতে পেরেছিলেন। তিনি শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ২০ বছর এ স্কুলের গর্বিত শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার তিন সন্তান এ স্কুলের শিক্ষার্থী। নাহিদ ইজাহার খান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় নিলুফার মঞ্জুরের আশীর্বাদ বার্তা ছিল, ছাত্রী তাকে আজ গৌরবান্বিত করেছে। সানবিমসের শিক্ষক হিসেবে তার (নিলুফার মঞ্জুর) স্বপ্ন পূরণ করেছে ছাত্রী। এদিকে পর্দা কাঁপানো সারা জাকের, সুবর্ণা মুস্তাফা, ইরেশ জাকের, মেহের আফরোজ শাওন, নাভিদ মাহবুব, এলিটা করিম, সাফায়েত মনসুর রানা এবং আরও অনেকে বিমার্স মানে সানবিমসের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

সানবিমস স্কুলের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক সাঈদা কামাল জানান, 'একবার আমি স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাই এক বছরের একটা কোর্স করার জন্য। ফিরে এসে স্কুলে যোগ দেব কিনা ভাবছি, নানা কারণে মনটা কিছুটা বিক্ষিপ্ত, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি, অবশেষে স্কুলে যোগ দিলাম। মাস শেষে নিলুফার আপা হাতে বেতনের চেক তুলে দিলেন। বাড়ি এসে খাম খুলে আমি তো থ। আপা তার সই করা একটা বস্ন্যাঙ্ক চেক দিয়ে দিয়েছেন, কোনো টাকার অঙ্ক লেখা ছাড়াই। সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন করে বললাম, আপা, আপনি ভুল করে আমাকে বস্ন্যাঙ্ক চেক দিয়েছেন, কোনো অঙ্ক লেখা হয়নি। আপা হেসে বললেন, 'ভুল করে দিইনি, ইচ্ছে করেই দিয়েছি, তোমার যত দরকার তত লিখে নিও। তুমি যে আবার আমার স্কুলে ফিরে এসেছ, আমি এতে খুশি।' ইতোপূর্বে বস্ন্যাঙ্ক চেকের বাস্তব গল্পের অভিজ্ঞতা আমার ঘটেনি। এটি জানার পর থেকে অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুরের প্রতি আমার ভক্তি ও শ্রদ্ধা কয়েক লাখ গুণ বেড়ে যায়। আমাদের দেশের শিক্ষাবিস্তার প্রসারে প্রয়োজন অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুরের মতো আরও অনেক মহান শিক্ষাবিদের।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, শিক্ষা গবেষক ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে মানসম্পন্ন স্কুল শিক্ষার একজন পথপ্রদর্শক প্রয়াত নিলুফার মঞ্জুর। তার প্রধান লক্ষ্যই ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রচলন। তাকে আমি বর্ণনা করব একজন ব্যতিক্রমী শিক্ষা উদ্যোক্তা হিসেবে যিনি মূল্যবোধকে কখনই জলাঞ্জলি দেননি।' তিনি আরও জানান, তার তিন সন্তানের সবারই প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছে সানবিমসে। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সানবিমসে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত পাঠদান করা হতো। বর্তমানে আইএ স্তর (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অফাধহপবফ খবাবষ) পর্যন্ত পরিচালনা করে। রাশেদা কে. চৌধুরী আরও বলেন, 'একজন অভিভাবক হিসেবেও আমি দিনের পর দিন দেখেছি কীভাবে নিলুফার বাচ্চাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল হলেও তিনি সবসময় চেয়েছেন তার ছাত্রছাত্রীরা যেন দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি না ভোলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তিনি কখনো ভোলেননি।'

\হঅধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার পথিকৃত। গত ২৬ মে ২০২১ তারিখে তিনি মৃতু্যবরণ করেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসা। প্রতিটি দিনের শুরু নতুন আনন্দ এবং প্রতিজ্ঞার মধ্যদিয়ে। আমরা বৃষ্টির পরিবর্তে রংধনু দেখতে চাই। এটি অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুরের কথা। অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর লোকান্তরিত হয়েছেন। তিনিই আমাদের রংধনু। তার শিখানো শপথ প্রতিদিনের নতুন আনন্দ এবং প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে শিক্ষা, সাফল্য, গৌরবগাঁথা আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে জীবনকে রংধনুকে রাঙাতে চাই। সেই সঙ্গে রাঙা হোক আমাদের দেশ, সফল বাংলাদেশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে