শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে নারীর আত্মহনন

আত্মহননকারীরা জীবনের নানামুখী সমস্যা সংকট থেকে মুক্তি পেতেই নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেয়। প্রকৃতপক্ষে নিজেকে ধ্বংস করার ভেতর কোনো বীরত্ব নেই, নেই কোনো কৃতিত্ব। চিকিৎসকদের মতে, আত্মহত্যাকারীদের ৯৫ শতাংশই মানসিক রোগে ভোগেন। দেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এর মধ্যে নারী ৪০ ভাগ। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। গভীর হতাশা বিষণ্নতার কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে সব চেয়ে বেশি। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষকে সঙ্গ দেওয়া, বিনোদনমূলক ও প্রকৃতিনির্ভর কোনো জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া উচিত। আর এটা করতে হবে বন্ধ,ু আত্মীয়স্বজনকেই। আত্মহত্যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, এই প্রভাব নেতিবাচক
ম মার্জিয়া খাতুন
  ২২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

সমাজে আত্মহত্যা করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। শুধু আমাদের দেশেই নয় বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই আত্মহত্যা প্রবণতা চোখে পড়ে। যদিও প্রচলিত আইনে আত্মহত্যা অপরাধ হিসেবে গণ্য। আত্মহত্যা জীবনের একটি অমীমাংসিত সমাধান। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, 'যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/মরিবার হ'লো তার সাধ।' মরিবার সাধ- এই কথাটির মধ্যে অনেক তাৎপর্য বহন করে। স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দেয় ভীরুকাপুরুষ যারা তারা। এই কথাও সমাজে প্রচলিত রয়েছে। অথবা এটাও বলা যেতে পারে যে যারা জীবনকে ভালোবাসে না কেবল তারাই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা মহাপাপ। ধর্ম এটাকে সমথর্ন করে না বরং এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে।

বাংলাদেশের অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যা। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মৃতু্যর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ এটি। প্রতি বছরই তা বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা বিশ্বে আত্মহত্যার হারে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। সাধারণত দরিদ্র দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর বিশ্বে ১৫ লাখ অস্বাভাবকি মৃতু্য হয়। এর মধ্যে শুধু আত্মহননের ঘটনাই ৮ লাখ। প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মহননের ২৫ শতাংশ ঘটনাই ঘটে ধনী দেশগুলোয়। এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় ইউরোপ এবং এশিয়ায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি করে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন- যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক কলহ, নিযার্তন, ভালোবাসায় ব্যথর্তা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, যৌন নিযার্তন, অপ্রত্যাশিত গভর্ধারণসহ বিভিন্ন কারণে নারীর আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। ইদানীং পুরুষের চেয়ে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আত্মহত্যার ৯৭০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নিযার্তন এবং ইভ টিজিংয়ের ঘটনা বাড়ায় অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হওয়া অথবা স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর গভর্ধারণের কারণে অনেকে আত্মহত্যা করেন। বেশির ভাগ নারী আত্মহত্যা করেছেন গলায় দড়ি দিয়ে, পুরুষরা কীটনাশক খেয়ে। আবেগতাড়িত ও পরিকল্পিত এ দুই ধরনের আত্মহত্যা হয়। তবে দেশে আবেগতাড়িত আত্মহত্যার পরিমাণ বেশি, এটি একটি মানসিক সমস্যা। সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে এ ধরনের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো সম্ভব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর নেহাল করিম বলেছেন, নারীর প্রতি নানা ধরনরে নির্যাতন, সহিংসতা, নিরাপত্তাহীনতা, নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করা আত্মহত্যার প্রধান কারণ। নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি নারীকে আত্মহননের পথে হাঁটতে বাধ্য করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, পরিবারের যে কোনো ঘটনাতেই নারীকে দায়ী করা হয়। তাদের কলঙ্কিত আখ্যা দেওয়া হয়। নারীরা নানা ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতন সহ্য করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছান, যখন তাদের সামনে আর কোনো পথ থাকে না। বেছে নিতে হয় আত্মহত্যার পথ। তিনি আরও বলনে, নারীকে মনে রাখতে হবে, নিজের জীবনের থেকে মূল্যবান কিছু নেই। যা-ই ঘটুক না কেন, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।

আত্মহননকারীরা জীবনের নানামুখী সমস্যা সংকট থেকে মুক্তি পেতেই নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেয়। প্রকৃতপক্ষে নিজেকে ধ্বংস করার ভেতর কোনো বীরত্ব নেই, নেই কোনো কৃতিত্ব। চিকিৎসকদের মতে, আত্মহত্যাকারীদের ৯৫ শতাংশই মানসিক রোগে ভোগেন। দেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এর মধ্যে নারী ৪০ ভাগ। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। গভীর হতাশা বিষণ্নতার কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে সব চেয়ে বেশি। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষকে সঙ্গ দেয়া, বিনোদনমূলক ও প্রকৃতিনির্ভর কোনো জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া উচিত। আর এটা করতে হবে বন্ধু আত্মীয়স্বজনকেই। আত্মহত্যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, এই প্রভাব নেতিবাচক।

মৃতু্যর রং কালো কিনা জানি না। খ্রিষ্টের জন্মেরও বহু আগে গ্রিক দার্শিনক সক্রেটিস হ্যামলক (এক ধরনের বিষ) পান করার আগে বলেছিলেন, 'আই টু ডাই ইউ টু লিভ, হুইচ ইজ বেটার অনলি গড নোজ।'

অনেকেই মনে করেন, রাতের অন্ধকার মৃতু্যর রঙের মতো। পৃথিবীতে অন্ধকার না থাকলে মানুষের মৃতু্য হতো না। অন্ধকার হচ্ছে মৃতু্যর প্রতীক। এ কথা সত্য, আমাদের দেশে বিনোদনকেন্দ্রের অভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ হচ্ছে না। বিষাদময় জীবন কাটাচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। তারা অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া আত্মহত্যা মানসিক রোগ হিসেবে না দেখে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক ও বন্ধুত্বের সম্পর্কে আরও দায়িত্ববান হতে হবে। সরকারেরও কিছু উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যনীতিতেও আত্মহত্যাকে দেখতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। পরিবারের উচিত বিষয়টি খোলামেলাভাবে আলোচনা করা।

মানসকি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। আমাদের দেশে সেভাবে আত্মহত্যা বা আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি অথবা কোনো সংস্থা এ বিষয়ে গবেষণার জন্য এগিয়ে আসেনি। সময় এসেছে এ বিষয় নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনার।

বিশ্বসাহিত্যে শতাধিক খ্যাতনামা কবি-লেখকের খোঁজ মিলবে, যারা আত্মহত্যায় নিজেদের জীবনের ছেদ টেনেছেন। খোঁজ নিলে আরও দেখা যাবে, তাদের লেখালেখিতে নিজেদের মনোজগতের ছাপ পড়ুক বা না-ই পড়ুক, তারা প্রত্যেকেই ব্যক্তিজীবনে প্রবল মানসকি চাপ বয়ে বেড়িয়েছেন- যা প্রায়ই তাদের এক দুঃসহ বিষণ্নতা ও মনোবৈকল্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নারী লেখক হিসেবে ভার্জিনিয়া উলফ্‌, সিলভিয়া পস্নাথ তাদের অন্যতম।

জীবনকে জীবন দিয়েই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আমরা বাংলাদেশের মতো একটি শান্তিপূর্ণ দেশে বাস করি। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষের মন হরণ করা ব্যবহার, অতিথিপরায়ণতা এবং আহার-বিহার সবই আকষর্ণীয় নজরকাড়া। সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ এ বাংলা। বাংলার সম্পদ, এর সবুজ-শ্যামল, নদনদী, পাহাড়-হ্রদ-জলপ্রপাত, সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন, সবুজ প্রকৃতি সবই সৃষ্টিকর্তার অশেষ দান। এমন দেশে বাস করে আত্মহত্যার চিন্তা করতে হবে কেন? যে দেশ ও মানুষকে ভালোবাসে, আত্মীয়স্বজনকে ভালোবাসে তারপক্ষে আত্মহত্যা করা কঠিন।

এটা মনে রাখা জরুরি যে, জীবন সংগ্রামশীল স্বপ্নময় স্মৃতিকাতর ভয়াবহ এক নরককুন্ড অথবা সুখের হাতছানি। জীবন জীবন নয় কিংবা জীবন ক্ষণিকের। এই জীবন টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিজের।

এ সমাজে এমন অনেক নারী আছেন, তাদের জীবন সম্পর্কে কোনো গভীর উপলব্ধি নেই। তারা মনে করেন জীবন একভাবে কেটে গেলেই হলো। অথবা গভীর হতাশাবাদী- নৈরাশ্যবাদীরাভাবে এ ক্ষুদ্র জীবনের কী মূল্য আছে? নানা দুঃখ কষ্ট হতাশায় অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনায় অনেকেই জীবনকে তুচ্ছভাবে। আত্মহননের মাধ্যমে জীবনের মায়া ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে চলে যায়, ঘটাতে চায় জীবনের পরিসমাপ্তি। এটা কোনো সমাধান নয়। ভালোবাসাহীন জীবন কোনো জীবন নয়। ভালোবেসে বেঁচে থেকেই জীবনের সমাধান খুঁজতে হবে। জীবনের সমাধান জীবনের মধ্যেই নিহিত, আত্মহননের মধ্যে নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে