সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা সেতু এখন সফল ফ্রিল্যান্সার!

মোশারফ হোসাইন
  ২২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

পড়াশোনা শেষ করে ইচ্ছা ছিল একটা সরকারি চাকরিতে ঢুকব। যতদিন সরকারি চাকরির বয়স ছিল ততদিন পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছি। শেষ পর্যন্ত কোনো চাকরিই হয়নি। এই মুহূর্তটাতে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম কারণ পড়াশোনা করা অবস্থা থেকেই স্বপ্ন ছিল কিছু একটা করব। নিজের আলাদা একটা পরিচয় গড়ে তুলব। আলাপচারিতায় এমনটিই বলছিলেন প্রযুক্তির জগতে নিজের পরিচয় গড়ে তোলা সফল ফ্রিল্যান্সার সাজেদা রহমান সেতু!

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে গণিত বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স শেষ করা সফল ফ্রিল্যান্সার সেতু বলেন, নিজে কিছু করার চিন্তা যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনও আমি ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে তেমন একটা জানতাম না। তবে আমার অনেক আগে থেকেই গুগল ঘাঁটাঘাঁটির অভ্যাস ছিল। দিনের বেশির ভাগ সময় ইন্টারনেটে পড়ে থাকতাম। নিজেকে কীভাবে স্বাবলম্বী করা যায় তা নিয়েও রিসার্চ করতে করতে একসময় ফ্রিল্যান্সিংয়ের সন্ধান পেলাম। তবে তখনো ফ্রিল্যান্সিং, মার্কেটপেস্নস এসব নিয়ে ধারণা ছিল খুবই কম। মূলত প্রথমে দেখলাম লেখালেখি করে ইন্টারনেট থেকে আয় করা যায়। ব্যাপারটা নিয়ে খুব কৌতূহল হলো। আর লেখালেখি করা আমার অন্যতম পছন্দের একটি কাজ ছিল। তো গুগল থেকে পড়াশোনা শুরু করলাম কীভাবে লেখালেখি করে আয় করে, কোথা থেকে আয় করা যায় ইত্যাদি। কিছুদিনের মধ্যে একটি বাংলা ওয়েবসাইটের সন্ধান পেলাম যেখানে একদম নতুনদের জন্য লেখালেখি করার সুযোগ থাকছে, সঙ্গে সম্মানীও। আমার ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল সেখান থেকেই। এরপর ইংরেজি আর্টিকেল লেখা শিখলাম এবং মার্কেটপেস্নসে ঢুকলাম। শুরুর দিকের কিছু কাজ মার্কেটপেস্নসে করলেও এরপর থেকে আছি একজন লোকাল ক্লায়েন্টের সঙ্গে। ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অনেক ক্লায়েন্টের সঙ্গেই কাজ করা হয়েছে। তবে একজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে পার্মানেন্টলি কাজ করছি শুরু থেকেই।

শুরুর দিকে প্রতিবন্ধকতা কী ছিল জানতে চাইলে সাজেদা রহমান সেতু বলেন, শুরুর দিকে সবচেয়ে বেশি সমস্যা যেটা হয়েছে ইংরেজি তেমন ভালো লিখতে পারতাম না। অনেক পড়াশোনা এবং প্র্যাকটিস করতে হয়েছে এর জন্য। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল লেখার টোন। লেখায় অ্যামেরিকান টোন আনতে বেশ সময় লেগেছে। প্রথমদিকে যেহেতু বাংলা আর্টিকেল দিয়ে শুরু করেছিলাম তাই বেশি একটা সময় লাগেনি। কারণ বাংলায় লেখালেখি আমি আগেও করতাম। তবে একটা আর্টিকেল কীভাবে লিখতে হয় এটা শেখার জন্য সময় লেগেছিল এক সপ্তাহের মতো। এরপর যখন ইংরেজি আর্টিকেল লেখা শুরু করলাম তখন কাজের সঙ্গে সঙ্গে শিখেছি। আসলে কাজ শিখতে বেশি সময় লাগেনি কিন্তু কোন কাজ দিয়ে শুরু করব এই সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে আমার এক থেকে দুই মাস সময় লেগেছিল।

আপনি যখন এই কাজ শুরু করলেন তখন আপনার পরিবার বিষয়টি কীভাবে নিতো? জানতে চাইলে এই ফ্রিল্যান্সার বলেন, পরিবার প্রথমে আমার মতোই ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে কিছুই জানত না। আর এর থেকে এত ভালো কিছু করা সম্ভব এই সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাও ছিল না। এমনকি বিশ্বাসও করত না যে এটা একটা ক্যারিয়ার হতে পারে।

তবে আমি যাই করতে চাইতাম আমার পরিবার আমাকে অনেক সাপোর্ট করত। এই ব্যাপারটা আমার অনেক মেন্টাল রিলিফ ছিল আমি আমার পরিবার থেকে প্রচুর সাপোর্ট পেয়েছি। আমার বাবার রিটায়ারমেন্টের পর থেকে পরিবারের ফিনান্সিয়াল ব্যাপারটা আমি দেখি। আলস্নাহর রহমতে পরিবারের বড় সন্তানের যা দায়িত্ব থাকে সবই পালন করতে পারি। এখন আমার পরিবার আমাকে নিয়ে গর্ব করে। কারণ আমি আসলে জীবনে যে কিছু করতে পারব তা আমার পরিবার কেন আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারতাম না।

ফ্রিল্যান্সিং-এর বড় প্রতিবন্ধকতা কি বলে মনে করেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ইচ্ছা এবং ধৈর্য। আমার কাছে অনেকেই আসেন যে কীভাবে ফ্রিল্যান্সিং করে, আমি কীভাবে আয় করছি শেখার জন্য। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই আগ্রহটা আসলে বেশিদিন থাকে না। কারণ শুনতে খুব সহজ শোনা যায় যে ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করা যায়। কিন্তু এই কাজের পিছনে কত যে পরিশ্রম, কত রাত জাগা, কত ধৈর্য, কত রিজেকশন, এই ব্যাপারগুলো বেশির ভাগ মানুষই মাথায় আনেন না। যার কারণে খুব দ্রম্নত এই কাজের প্রতি লেগে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল আমার কোনো মেন্টর ছিল না। মনে হাজার হাজারটা প্রশ্ন ঘুরত। কারও কাছে জিজ্ঞেস করব এমন কাউকে চিনতাম না। আর ফেসবুকে কিছু ফ্রিল্যান্সিং গ্রম্নপ ছিল সেখান থেকেও তেমন কারও হেল্প পাইনি নতুন বলে। নতুন হিসেবে কিছু জানতে চেয়ে পোস্ট দিলে বেশির ভাগ মানুষই ডিমোটিভেট করত। তাই নিজেই নিজের ভরসা ছিলাম। যতটুকু শিখেছি নিজে নিজেই শিখেছি।

কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য কতটা ইতিবাচক এই পেশা বলে মনে করেন? জানতে চাইলে সেতু বলেন, নারীদের জন্য এর চেয়ে বেস্ট কিছু হতে পারে না। কারণ আমরা নারীরা যাই করি না কেন একটা তিতা সত্য কথা হচ্ছে সংসার সামলাতেই হবে। তাই ঘরে থেকে অফিস করতে পারলে দুইদিকেই ব্যালেন্স করা যায়। কোনোকিছুই বাদ দিতে হয় না। আমার সফলতার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমি নিজেকেই দেবো। কারণ আজকে আমি যতটুকুই অর্জন করেছি তা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।

যখন শুরু করি তখন আমার নিজের একটা ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটার কিছুই ছিল না। বোনের ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতাম। সেই ল্যাপটপটাও স্স্নো ছিল, কাজ করতে অনেক সময় লাগত। এরপর ইনকাম করা শুরু করি এবং সেই টাকা জমিয়ে একটা ভালো এন্ড্রয়েড ফোন কিনি। এরপর সেই ফোন থেকে কাজ করতাম। এরপর চার-পাঁচ মাস টাকা জমিয়ে একটা নতুন ল্যাপটপ কিনি। এখন আলস্নাহর রহমতে সেই ল্যাপটপ থেকেই কাজ করছি। এবং এখন চাইলে একটা ম্যাকবুকও কিনতে পারব। তাছাড়া পরিবার থেকে সবসময় মেন্টাল সাপোর্ট পেয়েছি, অনুপ্রেরণা পেয়েছি যা আমার চলার পথকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।

তরুণ প্রজন্ম এবং নারীদের ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে পরামর্শ দিয়ে এই সফল ফ্রিল্যান্সার বলেন, নারী এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য পরামর্শ থাকবে চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত না হতে?। ফ্রিল্যান্সিং-এ ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে অবশ্যই ডেসপারেটলি লেগে থাকতে হবে, সময় দিতে হবে, এবং হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। নারীদের জন্য সংসার বাচ্চাকাচ্চা সামলে বাইরে গিয়ে চাকরি করাটা অনেকটা যুদ্ধের মতো। অনেকেই এসব ভেবে চাকরি ছেড়ে দেন। সমস্যা নেই ফ্রিল্যান্সিংয়েও চাকরির চেয়েও ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। তবে ইচ্ছাশক্তি প্রবল হতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে