রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁধাধরার বাইরে বাঁধন

সময়টা ২০১৮ সাল। তরুণ নির্মাতা রায়হান রাফির পরিচালনায় 'দহন' সিনেমায় কাজের কথা ছিল লাক্স তারকা আজমেরী হক বাঁধনের। জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত এই সিনেমার জন্য প্রস্তুতি নিলেও পরে আর এ কাজটি করেননি তিনি। এরপর বেশ লম্বা সময়ে কোনো কাজে দেখা পাওয়া যায়নি ছোট পর্দার এই তারকাকে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছিলেন অনিয়মিত। বছর তিনেক পর হঠাৎ করেই চমকে দিলেন বাঁধন। নতুনরূপে হাজির হলেন। ২০২১ সালের মাঝ সময়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'রেহেনা মরিয়ম নূর' সিনেমা দিয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিলেন এই অভিনেত্রী। এই সিনেমা দিয়ে প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন। এছাড়া সম্প্রতি 'গুটি' ওয়েস সিরিজ দিয়েও আলোচনায় বাঁধন। তাকে নিয়ে লিখেছেন মাসুদুর রহমান
নতুনধারা
  ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

এক সময় টিভি নাটকের নিয়মিত অভিনেত্রী থাকলেও এখন সেখানে নেই বাঁধন। ভিন্ন মাধ্যমে বেছে বেছে কাজের মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য এক উচ্চতায়। অল্প কাজেই করছেন বাজিমাত। শোরগোল ফেলে দিচ্ছেন একের পর এক চরিত্রে নিজেকে হাজির করে। 'দহন' সিনেমা থেকে সরে গিয়ে নিভৃতে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন বড় এক সাফল্যের জন্য। সেই চেষ্টার ফলাফল বয়ে আনল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুনাম। 'রেহেনা মরিয়ম নূর' সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে ২০২১ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে তার হাতে উঠতে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এই সুখবরের সঙ্গে আলোচনায় ভাসছে বাঁধনের আরেকটি চমক। ৫ জানুয়ারি 'চরকি'তে মুক্তি পাওয়া শঙ্খ দাসগুপ্ত পরিচালিত ওয়েব সিরিজ 'গুটি'তে নতুন চরিত্র দিয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন এই অভিনেত্রী।

সুলতানা একজন মাদক পাচারকারী। বছর কয়েক ধরে স্থানীয় মাদক চোরাচালান নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত সে। এই সময়ের মধ্যে প্রচুর অর্থসম্পদ করেছে ঠিকই, তবে হারাতে হয়েছে কাছের মানুষ, সম্পর্ক, বিশ্বাস ও আশা। এ কাজে পালানোর কোনো পথ নেই; তবে সুলতানা স্বপ্ন দেখে... মেয়ের জন্য সুন্দর একটি পৃথিবীর স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয় কি? এমন টান টান উত্তেজনা নিয়ে এগিয়ে যায় 'গুটি'র গল্প। এখানে সুলতানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাঁধন। চরিত্রটির জন্য প্রশংসায় ভাসছেন বাঁধন।

সুলতানা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে বাঁধন আরও বলেন, 'আমি বিভিন্ন সাময়িকীর সাহায্য নিয়ে বাস্তব কিছু চরিত্রের সাহায্যে পর্দার সুলতানাকে সাজিয়েছি। অনেক কিছু করেছি। আবার দেশের প্রেক্ষাপটের কারণে অনেক কিছু করা সম্ভব হয়নি। শরীরের মধ্য দিয়ে মাদক পাচার করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ ঘটনায় অনেকে মারাও গিয়েছেন। একটা সময় আমার কাছে প্রশ্ন ছিল, জীবনে কি আর কিছু করার নেই। এখানেই সুলতানা বাধার মধ্যে পড়ে যায়। আসলে তার আর কিছু করার নেই। একজন নারীর কঠিন সংগ্রাম আমি অনুভব করেছি।'

'গুটি' দেখে দর্শক সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ভালো লাগা প্রকাশ করছেন। কেউ আবার অন্যভাবেও মন্তব্যও করছেন। আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও। দর্শকের কোন কোন মন্তব্য বাঁধন শেয়ার করছেন। বাঁধন বলেন, 'একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক ধরনের। আমার মতে, প্রত্যেকের দেখার জায়গা আলাদা। নিজেকে ভালোভাবে গড়তে হলে সমালোচনা সইতে হবে। সমালোচনা শুনলে পরের কাজটি আরও ভালো করার চেষ্টা করা যায়। আমি সবার মতামতকে সম্মান জানাই।' বাঁধনের প্রথম ওয়েব সিরিজে কাজ করেন সৃজিত মুখার্জির 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি'তে। রেহানা মরিয়ম নূর'-এর পর এটি ছিল তার প্রথম কাজ। স্বাভাবিকভাবেই তাই বাংলাদেশি দর্শকদের আলাদা আগ্রহ ছিল। বাংলাদেশের একজন লেখকের উপন্যাস অবলম্বনে ভারতে বানানো ওয়েব সিরিজ, কৌতূহলের এটিও একটি কারণ। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীনের থ্রিলারের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত ওয়েব ধারাবাহিক 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি' মুক্তির আগেই যথেষ্ট প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। গত বছর মুক্তির পরও ভালো সাড়া ফেলে ওপার বাংলার এই ওয়েব সিরিজটি। এরপর বাঁধন কাজ করেন দেশীয় ওটিটি পস্ন্যাটফরম চরকির 'গুটি'তে। দুই দেশের দুই প্রজেক্টের কাজ। দর্শকের প্রতিক্রিয়ার ধরনটাও তাই আলাদা। বাঁধন বলেন, 'দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। যখন সৃজিতের কাজটি করি তখন এক রকম ছিলাম; এখন আরেক রকম। হইচই'র কাজটির মাধ্যমে দেশের বাইরে পরিচিতি পেয়েছি। কলকাতার দর্শক আমার নতুন কাজ 'গুটি' দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমাদের কাজের দর্শক তৈরি হয়েছে দেশের বাইরেও। আসলে গেস্নাবালাইজেশনের যুগে ঘরের মধ্যে বসে থাকব এ ভাবনা অমূলক।'

'রেহানা মরিয়ম নূর' থেকে শুরু করে 'গুটি' পর্যন্ত প্রতিটি কাজে নিজেকে আলাদাভাবে ভেঙ্গেছেন বাঁধন। সামনে আরও নতুন চরিত্রের আরেকটি চমক নিয়ে আসছেন তিনি। মুক্তির অপেক্ষায় আছে এই অভিনেত্রীর বিশাল ভরদ্বাজের ফিকশন নেটফ্লিক্সের 'খুফিয়া'। যেখানে তার চরিত্রের নাম অক্টোপাস।

এ নিয়ে বাঁধন বলেন, 'প্রত্যেকটি আলাদা চরিত্র হিসেবে প্রকাশ করতে পেরেছি। 'একেকটি চরিত্রের অভিজ্ঞতা একেক রকম। 'রেহানা মরিয়ম নূর' করতে গিয়ে যা শিখেছি তা কাজে লেগেছে পরবর্তী কাজগুলোতে। একেকটি চরিত্র বহনে সে চরিত্রের ভালো-মন্দ বহন করতে হয়। এ কাজটি করতে ভালো লাগছে। যতদিন এ ভালো লাগা থাকবে, ততদিন চরিত্রের সঙ্গে দর্শক সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেশে দেখা যায়, একটি চরিত্র সফল হলে নির্মাতারা সে চরিত্রেই অভিনয়শিল্পীকে বেশি কাস্ট করতে চান। এখানে অভিনয়শিল্পীর দোষ নেই। যারা তাকে নিয়ে কাজ করেন তারা অলসতা ও ঝুঁকি না নেওয়ার প্রবণতা থেকে এমনটি করেন।'

অভিনয়ের নানা পস্ন্যাটফরমে এখন চাহিদা বেড়েছে বাঁধনের। শুটিংয়ের বাইরে নানা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে এই অভিনেত্রীর। তেমনই এক আয়োজন ১০ম ঢাকা লিট ফেস্ট। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এই উৎসবের তৃতীয় দিনের আয়োজনে 'ধরা বাঁধার বাইরে' শীর্ষক সেশনে অংশ নিয়েছিলেন বাঁধন। বন্যা মির্জার সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানে বাঁধন জানান, সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণা ভাঙতে এখন ভারী মেকআপ করেন না তিনি।'

আগের তুলনায় সর্বত্রই এখন অবদান রাখছেন নারী। কোথাও কোথাও পুরুষদের ছাপিয়ে যাচ্ছেন তারা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একজন নারীকে সফলতার পথ দেখতে হয়। তাদেরই একজন বাঁধন। আজকের এই অবস্থানে আসতে তাকেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য বিদ্যমান নিয়ে এই অভিনেত্রী বলেন, 'সমাজ আমাদের মাথায় বীজবপন করে দেয়, মেয়েদের বয়স বলা যাবে না, বাচ্চা হয়েছে বলা যাবে না, বিয়ের কথাও বলা যাবে না। ইদানীং আবার আমাকে অনেকে বলেন, তুমি কালো হয়ে গেছ। কারণ আমার যে স্কিন টোন, সেটাতেই এখন মেকআপ করি বা মেকআপ ছাড়াই বাইরে আসি। কারণ এটাই আমি বাঁধন। একটা সময় পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করছি ফর্সা থাকার। এর পেছনে মিডিয়াও অনেক প্রভাব বিস্তার করেছে। বিজ্ঞাপন, নাটকে মেয়েদের যেভাবে দেখানো হয়। আমি সেই জায়গা থেকে উতরে এসেছি। কিন্তু এ অবস্থানে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আসলে প্রত্যেকটা মানুষ তার মতো সুন্দর।' নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে বাঁধন বলেন, 'আমাদের সমাজে পুরুষকে হিরো হিসেবে দেখতে পছন্দ করে সবাই। এই ভূমিকায় নারীকে দেখতে চান না কেউ। অথচ নারীকেন্দ্রিক গল্পে অনেক কাজ বিখ্যাত হয়েছে'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে