রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চঞ্চলের বৃহস্পতি তুঙ্গে

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

আসলেই তো! অবিকল সে-ই মৃণাল সেন! বিংশ শতাব্দীর সেরা সংযোজন হিসেবে যিনি ছিলেন টলিউডের একজন অবিসংবাদিত চলচ্চিত্র নির্মাতা। একজন মানুষের চেহারায় আরেকজন মানুষের এরকম অবিকল মিল থাকতে পারে সে কি বাস্তবে নাকি কল্পনায় সম্ভব! তাও আবার আগামীতে ঢালিউডের আরেক কিংবদন্তি হতে যাওয়া অভিনেতার সঙ্গে! গত বছরের একেবারে শেষে দর্শকদের চমকে দিতে মৃণাল সেনের বায়োপিকের প্রথম পোস্টার সামনে এনেছিলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। তখনই প্রথম জানা গেছে, এই কিংবদন্তি পরিচালকের ভূমিকাতে অভিনয় করবেন চঞ্চল চৌধুরী। পরে তার লুক প্রকাশ্যে আসে। ছবিটিতে মৃণাল সেনের তরুণ বয়সের চরিত্রে থাকছেন কোরক সামন্ত। ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় চঞ্চল চৌধুরীর কিছু ছবি পোস্ট করা হয়েছে। যেখানে পরিচালক হয়ে ওঠা মৃণাল সেনের চরিত্রে চঞ্চলকে দেখে চমকে যান দর্শক। নেটিজেনদের মন্তব্য, এ তো হুবহু মৃণাল সেন! এভাবে প্রথম লুকেই ছক্কা হাঁকালেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়।

অথচ ছবিটিতে অভিনয় করবেন কি করবেন না- ভড়কে গিয়ে আমতা-আমতা করছিলেন চঞ্চল। তিনি বলেন, 'মাস ছয়েক আগেই মৃণাল সেনের ভূমিকায় অভিনয় করার প্রস্তাব দেন সৃজিত। আমি প্রথমটায় খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি- করে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি তো নাছোড়বান্দা। আমাকে একাধিকবার অভয় দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। অনেকবার বুঝিয়েছেন যে আমিই এই চরিত্রের জন্য যথোপযুক্ত। এরপর আমিও ভাবলাম, কাজটা যখন করতেই হবে, তখন শুরু করে দেওয়াই ভালো। যা হয় পরে দেখা যাবে।'

চঞ্চল এখন গোটা কলকাতাতেই হার্টথ্রব অভিনেতা। এর আগে ফেরদৌস আহমেদও এত আলোড়ন তুলতে পারেননি। কথায় বলে 'সবুরে মেওয়া ফলে'। চঞ্চলের বেলায় কথাটি হুবহু খাটে। কারণ কলকাতায় পা রেখেছেন তিনি নায়ক বয়সে নয়, চরিত্রাভিনেতার বয়সে। ভারতের মিডিয়া চঞ্চলকে নায়ক বয়সে না চিনলেও চরিত্রাভিনেতা বয়সে চিনতে পেরেছে। এক 'হাওয়া'ই নিয়ে গেছে তাকে অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের অভিনয়ে বৈচিত্র্যমুখী জাতঅভিনয় প্রতিভা এমনিতেই দেখা গেছে হাতেগোনা কয়েকজন। সেই স্রোতের হাওয়ায় গা ভাসানো অভিনয় শিল্পীর মধ্যে যারা ব্যতিক্রম তার মধ্যে চঞ্চল চৌধুরী অন্যতম। অভিনেতা মামুনুর রশীদের হাত ধরে হাতেখড়ি হয় তার। আরণ্যকের হয়ে মঞ্চই ছিল তার অভিনয়ের পাঠশালা। গুরু মামুনুর রশীদের লেখা 'সুন্দরী' নাটকে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। প্রথমে টুকিটাকি, ছোটখাটো রোলে অভিনয় আর শুধু অপেক্ষায় থাকা কিছু একটা করে দেখানোর। এরপর মুঠোফোনের 'মা' বিজ্ঞাপনের একটি জিঙ্গেলে 'পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মা গো কবে শীতল হবো'... এই মডেল হওয়ার জিঙ্গেলটিই তাকে পৌঁছে দেয় এ দেশের প্রতিটি ঘরে-ঘরে। সেই থেকে তাকে আর পায় কে! মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, সালাহউদ্দিন লাভলু প্রমুখের নাটক ও বিজ্ঞাপনের নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন তুমুল আলোচিত চঞ্চল।

এক সময়ের থিয়েটারের অভিনেতা ছোটপর্দা থেকে শুরু করে সিনেমা, ওটিটি- একেকটি পথ পেরিয়ে আজ সর্বত্রই সমান দাপটে শাসন করা এক লড়াকু অভিনেতা চঞ্চল। অভিনয়ের সব মাধ্যমেই বাঁক বদল করা এক অভিনেতার নাম। ছিলেন বাংলাদেশ চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আর হয়ে গেলেন কী না পুরাদস্তুর একজন ঝানু চৌকস অভিনেতা! যে অভিনয় গুণের জন্য নিজের নামকে ছাপিয়ে দর্শকের কাছে হয়ে ওঠেন কখনো রুপালি পর্দার 'সোনাই' কখনো 'কালু' কখনো বা 'সোলেমান', কখনো বা শরাফত করিম আয়না বা 'চান মাঝি'। 'বোঝ নাই ব্যাপারটা'খ্যাত সময়ের দাপুটে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী এরকম আরও কত চিত্তাকর্ষক সংলাপ দিয়ে দর্শকের মন ভোলাবেন কে জানে। যার এই সংলাপটি মনে করিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণী সিনেমার আরেক দাপুটে অভিনেতা রজনীকান্তের সেই সংলাপটিকেও, 'কীভাবে বা কখন কী করব, তা কখনোই তোমাকে বলব না। যখন করব, তখনই বুঝবা।'

তবে তার সংলাপ ছোড়ার এই সক্ষমতার কথা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। ইতোপূর্বে বাংলাদেশের আর কোনো অভিনয় শিল্পীই প্রতিবেশী দেশ ভারতে এতটা জনপ্রিয়তা পাননি। তাকে এখন সেখানকার আনন্দবাজারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়াতেও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। নাটক, সিনেমা কিংবা ওয়েব ফিল্ম-সিরিজ সব জায়গাতেই শতভাগ সফল তিনি। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রতিক্ষণে যেভাবে নিজেকে ভেঙেছেন সেভাবেই অভিনয়ের বিভিন্ন শাখায় তার উপস্থিতির বাঁকবদল যেমন দেখা গেছে।

চঞ্চলের অভিনয়ের প্রধান গুণ শেকড়ের মানুষের কাছাকাছি থাকা। গ্রামের সব ধরনের চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারাই হচ্ছে তার অভিনয়ের প্রধান গুণ। তাই তো তার অভিনয়ের শুরুতেই গ্রামের লাখ লাখ মানুষ তার নাটকের সিডি কিনে দেখতে থাকে। শুধু তাই নয়, পাবনার আঞ্চলিক ভাষাকেও সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছেন তিনি। ওটিটি পস্ন্যাটফর্মেও দেখালেন, এখানেও তার কোনো জুড়ি নেই। 'তকদির' মুক্তি পেতে না পেতেই হইচই পড়ে যায়। এরপর একটি-একটি করে তার মাথায় প্রশংসার পালক গাঁথা হতে থাকে। চরকির 'উনলৌকিক', 'মুন্সিগিরি' আর হইচইয়ের 'বলি' বা 'কারাগার' তাকে নতুনভাবে চেনাল। 'কারাগার' এ তার অভিনয় তো রীতিমতো হইচইয়ের ঝড় তোলে। চরিত্র নিয়ে যেমন নিবিড় ভাবনাচিন্তা করতে পারেন চঞ্চল হাল সময়ে আর কোনো অভিনেতা এমন পারেন না! একেবারে নিরাভরণ ও আটপৌরে অভিনয় প্রতিভার জন্যই তো

চঞ্চলের এতদূর পর্যন্ত আসা। সময়ই বলে দেবে তার এই

যাত্রা কোথায় গিয়ে থামে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে