রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অভিনয়ের জাদুকর

ঠিক যেন জাদুকরের মতোই হাতের মুঠোয় অভিনয়ের সব কলাকৌশল রেখে দেন তিনি। যে কোনো চরিত্র সাবলিল ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। এক নাটকে কয়েকটি চরিত্র নিয়ে অনায়াসে খেলেন- মাতান দর্শক। তাইতো তাকে বলা হয় অভিনয়ের ফেরিওয়ালা। বলা হচ্ছে, অভিনেতা মোশাররফ করিমের কথা। মঞ্চ নাটক থেকে টিভি পর্দা এমনকি চলচ্চিত্র অথবা ওটিটি পস্ন্যাটফর্ম- সবখানেই অভিনয়ের কারিশমা দেখিয়েছেন তিনি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে তার অভিনয়ের সৌরভ ছড়িয়ে গেছে ওপার বাংলায়। আলোচিত এই তারকাকে নিয়ে লিখেছেন মাসুদুর রহমান
নতুনধারা
  ০৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

নাটক-সিনেমা নিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় থাকলেও সম্প্রতি নেট দুনিয়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন অভিনেতা মোশাররফ করিম। ২৩ জুলাই তার নতুন একটি সিনেমার পোস্টার মুক্তি পেয়েছে। মাত্র ১১ সেকেন্ডের এই মোশন পোস্টারে মোশাররফ করিমের লুক রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে। মোশাররফ করিমের এই নতুন সিনেমার নাম 'হুব্বা'। এটি কলকাতার সিনেমা। পরিচালনা করেছেন কলকাতার আলোচিত নির্মাতা ব্রাত্য বসু। যিনি এর আগে এই অভিনেতাকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের 'ডিকশনারি' নির্মাণ করেছিলেন। এই ছবির মাধ্যমেই কলকাতার সিনেমায় অভিষেক হয়েছিল মোশাররফ করিমের। ওপার বাংলার দর্শক বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের এ অভিনেতাকে। আর তাই মোশাররফ করিমকে নিয়ে নতুন সিনেমার ঘোষণা দিয়েছিলেন ব্রাত্য বসু। তার বাস্তবায়ন ঘটালেন 'হুব্বা' দিয়ে। কলকাতায় গত বছরের অক্টোবরে 'হুব্বা' ছবির শুটিং করেছিলেন মোশাররফ করিম। ছবিটি তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কুখ্যাত গ্যাংস্টার হুব্বা শ্যামলের জীবন অবলম্বনে। হুগলি জেলার অপরাধ জগতের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই হুব্বা শ্যামল। যিনি 'হুগলির দাউদ ইব্রাহিম' নামে পরিচিত ছিলেন। খুন, জখম, মাদকপাচারসহ বহু অপরাধে অপরাধী। অজস্র পুলিশ কেস ছিল তার নামে। ২০০৫ সালে সল্ট লেক থেকে হুব্বার অতিনাটকীয় গ্রেপ্তারির কথা আজও মনে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। শোনা যায়, ৭০টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করত হুব্বা। এই ডন ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে স্বাধীনভাবে ভোটেও দাঁড়িয়েছিলেন। যাতে বেজায় বিপাকেও পড়েছিল শাসকদল। পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন তিনি। যতবারই তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, প্রতিবারই জামিন পেয়ে গেছেন। ২০১১ সালে বেশ কিছুদিন নিখোঁজ থাকার পর বৈদ্যবাটির খালে হুব্বা শ্যামলের পচাগলা দেহ ভেসে উঠে, গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃতু্য হয়েছিল তার। ১১ সেকেন্ডের মোশন পোস্টারে দেখা গেছে, গলায় গাঁদা ফুলের মালা, এক হাতে পিস্তলসহ দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন মোশাররফ করিম! চারজন করে তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে আটজন। তাদের চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা! শিগগির ছবিটি মুক্তি পাবে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে। ছবিটি নিয়ে পরিচালক ব্রাত্য বলেন, 'থ্রিলার ও কমেডির মিশেলে তৈরি করা হয়েছে এই ছবি। এই ছবির মাধ্যমে আমি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অপরাধ জগতের চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।' সুপ্রতিম সরকারের 'আবার গোয়েন্দাপীঠ' অবলম্বনে ছবির চিত্রনাট্য করেছেন পরিচালক নিজেই।

'হুব্বা' নিয়ে মোশাররফ করিম বলেন, 'চরিত্রটি দারুণ, এর প্রতি দর্শকের আলাদা আগ্রহ আছে। সত্য ঘটনা থেকে নেওয়া। হুগলির গ্যাংস্টার হুব্বার চরিত্র ছিল বর্ণাঢ্য। আমি সেই চরিত্র করছি। শুটিংয়ের বেশ আগেই এর চিত্রনাট্য হাতে পেয়েছিলাম। এই ছবি ভালো হবে, আশা করছি।' এর আগে ২০২১ সালে ভারতীয় হইচই ওটিটি পস্ন্যাটফর্মে মুক্তি পায় মোশাররফ করিম অভিনীত ওয়েব সিরিজ 'মহানগর'। তার আগে মুক্তিপায় 'ডিকশনারি'। এই কাজ করার পরপরই কলকাতার একাধিক ছবির কাজের প্রস্তাব পায় বাংলাদেশের এই অভিনেতা। ওটিটি ও সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় টেলিভিশন নাটকে আগের মতো নেই মোশাররফ করিম। বলেন, 'আগে যে খুব বেশি নাটকে অভিনয় করা হতো বিষয়টি এমনও ছিল না। অভিনয় নিয়মিত করা হয়, তবে সেটি এখন নাটক, ওটিটি- যা ওয়েব ফিল্ম নামে হয়তো বলা হয়। আসলে আমি অভিনয়ের সব মাধ্যমেই কাজ করছি। সব মাধ্যমে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়াই হয়তো টিভি নাটকে কম দেখা যাচ্ছে।'

ঈদে মোশাররফ করিমের নাটকে দর্শকের একটা বাড়তি আগ্রহ থাকে। ওটিটির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ঈদের সময় ছোট পর্দার দর্শকের সঙ্গে থাকতে সময় বের করে কাজ করেন এই অভিনেতা। তারই ধারাবাহিকতায় গত ঈদে বেশ কিছু নাটকে দেখা গেছে এই অভিনেতাকে। তার অভিনীত ঈদের নতুন নাটকগুলো দর্শক মহলেও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল মোশাররফ করিমের। অভিনয়ের সূত্রধরেই মঞ্চ নাটকের সঙ্গে জড়িত হন তিনি। ঢাকার মঞ্চ নাটকের দল 'নাট্যকেন্দ্র'র সঙ্গে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। এরপর অভিনয় করেন টিভি নাটকে। মঞ্চের সঙ্গে টেলিভিশনের পার্থক্য নিয়ে এই অভিনেতা বলেন, 'সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে টেলিভিশন ঘরে বসে দেখা যায়, আর মঞ্চে সরাসরি দেখতে হয়। শিল্পের ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্নের উত্তর সংজ্ঞায়িত করে বলা মুশকিল। আর অনেকে বলতে চায় যে অভিনয়ের ধরনে পার্থক্য আছে। এটাকে নির্দিষ্ট করে, সীমিত করে বলা যায় না।' আজকাল অনেকেই অভিনয় করেন মঞ্চের অভিজ্ঞতা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই। অভিনয়ের জন্য মঞ্চের গুরুত্ব এড়িয়ে চলেন। কিন্তু ভালো অভিনেতা হওয়ার জন্য মঞ্চের ভূমিকা নিয়ে মোশাররফ করিম বলেন, 'অনেক বড় ভূমিকা আছে মঞ্চের। মঞ্চ চরিত্রায়ন বুঝতে শেখায়। কোন অভিনয়টা যুক্তিসংগত, কোনটা আসল, কোনটা নকল, কোন অভিনয়টা পুরনো ধরনের, কোন অভিনয়টা ক্লাসিক্যাল, কোন অভিনয়টা যুগোত্তীর্ণ- এই যে ধরনগুলো, সেগুলোর সঙ্গে পরিচয় করায় মঞ্চ। নাটক বা শিল্পকলাবিষয়ক, সাহিত্য ইত্যাদি সবকিছু, সবক্ষেত্র পড়া হয়, জানা হয় এখানে।'

অভিনয়ের বিস্ময় এই অভিনেতা ক্যারিয়ারে অসংখ্য চরিত্রে কাজ করেছেন। রাস্তার ফকির থেকে শুরু করে শিল্পপতি, বড় কর্মকর্তার চরিত্রেও মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। এত সব চরিত্রের মধ্যে তার প্রিয় বা পছন্দের চরিত্র নিয়ে মোশাররফ করিম বলেন, 'অনেক চরিত্রই আমার পছন্দ। '৪২০' নাটকের চরিত্রটাও পছন্দ। তারপর 'তোমার দোয়ায় ভালো আছি মা' সেটা পছন্দ। একক নাটক 'অভিনেতা', 'লাইসেন্স', 'নো কোয়েশ্চেন নো অ্যানসার' তারপর কচি খন্দকারের বেশ কিছু নাটক।' নাটক, চলচ্চিত্রের সফল এই অভিনেতা অনেক নাম-যশ-খ্যাতি অর্জন করেছেন। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মননা। তবে তার কাছে জীবনের সেরা পুরস্কার দর্শকের ভালোবাসা। বলেন, 'একবার একজন পরহেজগার দাড়িওয়ালা ব্যক্তি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'বাবা, তোমার অভিনয় আমার খুব ভালো লাগে।' এটা আমার কাছে অনেক বড় পুরস্কার পাওয়ার মতো ছিল। কারণ, এ ধরনের লোকরা সাধারণত অভিনয় পছন্দ করেন না। ওনার কাছ থেকে এমন কথা শোনা অনেক বড় ব্যাপার। দর্শকদের কাছ থেকে যে এতটা ভালোবাসা পাই, আমি অনেক সময় ভাবি, আমি কি আসলেই এতটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য! এই ভালোবাসাটা আসলেই অনেক বড় পুরস্কার।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে