বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী ২০২৫ সালের ২৫ মে পালিত হচ্ছে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে। তিনি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, মঙ্গলবার, ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, সাংবাদিক, দার্শনিক ও সমাজচিন্তক এক কথায় বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাসে যাঁর স্থান চিরভাস্বর। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সঙ্গীতশিল্প আজও যুগকে অনুপ্রাণিত করে, সামাজিক পরিবর্তনের পথ দেখায়। তাই তিনি শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন এক আন্দোলনের নাম, এক জীবন্ত আদর্শ।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের সূচনা হয়েছিল দারিদ্র্য আর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। ছোটবেলায় পিতৃহারা নজরুল মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করেছেন, লেটো গানে অংশ নিয়েছেন, সেনাবাহিনীতেও যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এই কঠিন জীবনসংগ্রাম তাঁকে দমাতে পারেনি। তিনি সাহিত্য ও সংগীতের মাধ্যমে সমাজের বৈষম্য, শোষণ, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যজীবনের সূচনা ঘটে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী”, যা বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি করে নতুন এক ধারা। এই কবিতায় কবি নিজের আত্মাকে রূপ দিয়েছেন এক বিরাট শক্তিতে, যিনি অন্যায়, শোষণ ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেন সাহসের ঘোষণা:
“আমি চির-বিদ্রোহী বীর –/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা,/শুনিনি কাহার ভয়,/দেখিনি কাহার চোখে কভু পরাজয়!”
এই কবিতা কবি কাজী নজরুল ইসলামকে শুধু সাহিত্যের জগতে নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনেও পরিচিত করে তোলে। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, কবিতা ও গল্প ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গণচেতনাকে উজ্জীবিত করে।
কাজী নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টির আরেকটি দিক হলো তাঁর গান। প্রায় চার হাজার গান লিখে ও সুর দিয়ে নজরুল বাংলা সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর গানে আছে প্রেম, প্রতিবাদ, ধর্মীয় ভাব, আধ্যাত্মিকতা এবং সাম্যবাদের স্পষ্ট প্রকাশ।
কাজী নজরুল ইসলামের গানে ইসলামী ভাবধারা যেমন আছে, তেমনি আছে হিন্দু দেবদেবীর বন্দনার সুর। এই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে করে তোলে অসাধারণ।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গদ্য সাহিত্যে তুলে ধরেছেন সমাজে বিদ্যমান কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। তাঁর উপন্যাস “মৃত্যুক্ষুধা” ও “কুহেলিকা” প্রগতিশীল চিন্তার ধারক।
একইভাবে, যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী, রাজবন্দীর জবানবন্দি প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থে তিনি সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতির নির্ভীক সমালোচনা করেছেন।
আজকের পৃথিবীতে যখন বিদ্বেষ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও বৈষম্য বাড়ছে, তখন তাঁর অমর সৃষ্টি আমাদের জন্য আলোর দিশারি। তাঁর লেখা আমাদের শিখায় কিভাবে সাহসিকতা, মানবতা ও ভালোবাসা দিয়ে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব।
তাই তিনি বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর দ্যুতি । ২০২৫ সালে তাঁর ১২৬তম জন্মবার্ষিকী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কবির আদর্শ ও ভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক। বৈষম্য, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সামাজিক অবিচার যখন বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের বিষয়, তখন তাঁর জীবনদর্শন নতুন করে আলো জ্বালাতে পারে। তাঁর সাহসী কণ্ঠ, তারুণ্যের অগ্নিশিখা ও মানবতাবাদের মন্ত্র আমাদের আগামী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
তাঁর সাহিত্য ও সংগীত শুধু অতীত নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতেরও পাথেয়। কবির জন্মদিনে আমরা তাঁকে শুধু স্মরণই করি না, তাঁর আদর্শ বাস্তব জীবনে অনুসরণ করাই হোক আমাদের শ্রদ্ধার প্রকৃত প্রকাশ।