সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

আগস্টে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৬ আগস্ট ২০২৩, ০৯:২৮
আপডেট  : ১৬ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩৮

গত জুলাই মাসে ঢাকায় ২৩ হাজার ১২১ জন এবং ঢাকার বাইরে ২০ হাজার ৭৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ হিসাবে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৭৪৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬৬৮ জন রোগী আক্রান্ত হয়েছে। আগস্টের প্রথম ১৩ দিনে ঢাকায় ১৯ হাজার ৬২৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ২১ হাজার ৯৩২ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৫০৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৬৮৭ জন আক্রান্ত দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে রোগী বেড়েছে ৭৬৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৯ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার দেওয়া এ তথ্য পর্যালোচনায় জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, চলতি মাসে ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে গত মাসের তুলনায় আগস্টে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগী কমেনি। অথচ এ চিত্র সঠিকভাবে উপস্থাপন না করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ঢাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে বলে ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি রোগীদেরই শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত হিসাবে দেখানোর পদ্ধতিও সঠিক না বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

প্রসঙ্গত, গত ১৩ আগস্ট একটি অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দাবি করেন, সারা দেশে কিছুটা বাড়লেও ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য হাসপাতালে শয্যার সংকট হবে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ঢাকা শহরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য প্রায় তিন হাজার শয্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজারের বেশি রোগী ভর্তি আছেন। ঢাকার বাইরে পাঁচ হাজার শয্যা করা হয়েছে।

এর আগে গত ২ আগস্ট ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল, আক্রান্তের হার কমছে। তবে ঢাকার বাইরে বাড়ছে।

তবে ডেঙ্গু স্থিতিশীলতার দাবি প্রচারের পর থেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর ঘোর বিরোধিতা করছেন। চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ‘স্বাচ্ছন্দ্য’ বলে মেনে নিতে তারা জোরালো আপত্তি তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, সংক্রমণের উচ্চ হার অব্যাহত থাকলে একটি স্থানকে রোগের দিক থেকে স্থিতিশীল বলার কোনো সুযোগ নেই। রোগী বেশি হলে ধরে নিতে হবে সংক্রমণ এখনো আছে।

এছাড়া আগস্ট থেকে নভেম্বর এই চার মাসে যেহেতু ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, তাই এখনই পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলার সময় আসেনি।

সংশ্লিষ্ট অনেকের দাবি, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা সংকট ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিপুল সংখ্যক রোগী ভর্তি হতে পারছে না। এছাড়া অগ্নিমূল্যের বাজারে সংসার চালাতে হিমশিম নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের গলাকাটা ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য না থাকায় তাদের একটি বড় অংশ বাসা-বাড়িতে অবস্থান করছে। এদের পরিসংখ্যান তুলে না ধরে শয্যা সংকটে থাকা সরকারি হাসপাতালের চিত্রে ডেঙ্গু স্থিতিশীল দেখানোর হিসাবে পুরোটাই ‘শুভংকরের ফাঁকি’ বলে তারা মনে করছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত- এসব বিষয়গুলো সিমুলেশন মডেলের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। এখনো সেখানে স্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। শঙ্কার দিন এখনো বাকি। ঢাকায় রোগীর প্রকৃত সংখ্যা কেউ জানে না বলে দাবি করে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ঢাকার হাসপাতালগুলোর রোগীর সক্ষমতা বাড়েনি। তাই এটা স্থির প্রদর্শিত হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ বলেন, অনেক রোগী থাকলে এবং সংখ্যা স্থিতিশীল থাকলে জনস্বাস্থ্যের সমস্যা হয়। অন্য কথায়, আরও কেস ইঙ্গিত দেয় যে ডেঙ্গু সংক্রমণের বিভিন্ন প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। প্রতিদিন কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই।

সরকারের ইনস্টিটিউট অফ প্যাথলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ, আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, এক জায়গায় সংক্রমণের হার বেশি হলে তাকে রোগের দিক থেকে স্থিতিশীল বলা যাবে না। বর্তমানে ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়। যদি এটি হ্রাস পায় এবং স্থির থাকে, তবে এটি ধ্রুবক। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর এই চারটি মাস ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করে তিনি আরও বলেন, যখন পরপর দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ হ্রাস পায়, তখন সংক্রমণ কমে গেছে বলে জানা যায়। ঢাকায় সেই পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলেন, হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে এনএস-১সহ অন্যান্য টেস্ট করা হচ্ছে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হলে বোঝা যেত ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্থিতিশীল, নাকি ভয়াবহ। অথচ তা করা হচ্ছে না। শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর হিসাব ধরে ডেঙ্গু আক্রান্তদের সংখ্যা ঘোষণা করা হচ্ছে। ঢাকার যে কোনো এলাকায় খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, বাসাবাড়িতে শত শত মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী রয়েছে। তাদের কেউ কেউ ডেঙ্গুতে নন, ইনফ্লুয়েঞ্জা কিংবা ভাইরাল ফ্লুতে আক্রান্ত বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার আহমেদুল কবির বলেন, গত কিছুদিন ধরে ব্যাপক হারে জ্বরের রোগী বাড়ছে। পরীক্ষায় কিছু মানুষের ডেঙ্গু আসছে, আবার কিছু মানুষের ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ভাইরাল ফ্লু আসছে। তবে হঠাৎ করেই এত সংখ্যক জ্বরের রোগী বেড়ে যাওয়াটা অবশ্যই আশঙ্কার বিষয়। হাসপাতালগুলোতে রোগী যদি এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে সেটি সামাল দেওয়া কষ্টকর হবে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে চিকিৎসকরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। যেখানে একজন চিকিৎসকের ১০ জন রোগী ম্যানেজ করার কথা, সেখানে তাদের বর্তমানে ২০ থেকে ৩০ জন রোগী ম্যানেজ করতে হচ্ছে। ডাক্তার-নার্স রাতারাতি বাড়ানো যায় না। তাই এ অবস্থায় সবচেয়ে জরুরি হলো, যে কোনো মূল্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমানো।

পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ উল্লেখ করে ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, হাসপাতালের পরিসংখ্যান দিয়ে বাস্তব চিত্রটা বোঝা যাবে না। কারণ ডেঙ্গু জ্বর হলেও সর্বোচ্চ ১০-১২ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে আসে। অর্থাৎ সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। অধিকাংশ মানুষের জ্বর হয়ে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। সব ডেঙ্গু জ্বর সিভিয়ার হয় না। আর যারা সিভিয়ার কন্ডিশনে চলে যায়, সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনাটাও কঠিন হয়ে যায়। তাই বর্তমানে ডেঙ্গু হলে যেহেতু মৃত্যু ভয় আছে, এজন্য জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া জরুরি। শুরুতেই যদি ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায়, তাহলে চিকিৎসা করতেও সহজ হয়। এমনকি জ্বর নিয়ে আতঙ্কটাও কমে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে এবং আগস্ট থেকে কমতে থাকে। কিন্তু এবার এখনো যে হারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তা ভয়াবহতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডাক্তার রশিদ-ই মাহবুব বলেন, পরিস্থিতি যে মাত্রায় পৌঁছেছে, তাতে এটাকে মহামারি না বলা গেলেও ভয়াবহ বলতেই হচ্ছে।

তার মতে, সরকারি পরিসংখ্যান থেকে বাস্তবে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। অনেকে এখনো সরকারি নজরদারির বাইরে থাকতে পারেন বলে তার ধারণা।

যাযাদি/এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে