বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে সংলাপের হাওয়া

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৮ জুন ২০২৩, ১১:৩৮

বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা নিয়ে চাঞ্চল্য বাড়ছে। বইতে শুরু করেছে সংলাপের হাওয়া। এতদিন যেখানে সংলাপের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একরোখা নীতিতে অবস্থান করেছে এখন সেখানে শর্তসাপেক্ষে সংলাপে বসার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সংলাপে কোন দল কীভাবে নিজেদের স্বার্থের পক্ষে সিদ্ধান্ত আনতে পারেÑ সেই কৌশল নিতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি মার্কিন তৎপরতার কারণে নানা মহলের গুঞ্জনের শাখা-প্রশাখা প্রসারিত হচ্ছে। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক দৌড়ঝাঁপের কারণে প্রকাশ্যে না হলেও সংকট নিরসনে পর্দার অন্তরালে সংলাপ হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর সম্প্রতি বলেছেন, সরকার প্রকাশ্যে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করলেও নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তলে তলে বিভিন্ন সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঘটনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন তৎপরতার বিষয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়। এনিয়ে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর নানা আলোচনা সমালোচনা-গুঞ্জন ছিল। এমনি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে গত ২৪ মে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর ঢাকার কূটনীতিকপাড়ায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়। একইসঙ্গে বেড়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের তৎপরতাও। ২৫ মে গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় পিটার হাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা একত্রে বৈঠক করেন। বৈঠকে থাকা একাধিক সূত্রে জানা যায়, ওই বৈঠকে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে সব দলের সংলাপ আয়োজন ছাড়া সমাধানের পথ দেখছি না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও সে কথাই বলেছেন।’

এছাড়া গত রোববার পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এরপর গত মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। একইদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গেও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে তা পিটার হাসকে অবহিত করেন দলের মহাসচিব। বৈঠকে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী নির্বাচনসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও পিটার হাস বিএনপির বক্তব্য জানতে চান বলে মির্জা ফখরুল গণমাধ্যমকে বলেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন তৎপরতার মধ্যে গত মঙ্গলবার ১৪ দলের এক সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বিএনপিকে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। প্রয়েজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আমরা তাদের সঙ্গে মুখোমুখি সংলাপ করতে চাই। তবে বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জাতিসংঘের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপ করতে হবে- এমন কোনো রাজনৈতিক সংকট দেশে এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করব- এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করব।’

অন্যদিকে বুধবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে ‘স্বাধীনতা পুরষ্কার-২০২৩ উদযাপন’ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘সংলাপ’ নিয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘জনগণের ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে হলে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাই আলোচনার বিকল্প কিছু নাই।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি পপুলার পার্টি। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে জনগণের ক্ষমতায় চলতে হবে।’

আমির হোসেন আমুর বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান প্রসঙ্গে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি এই বিষয়টা গুরুত্ব দিতে চাই না। এ নিয়ে আমি কথাও বলতে চাই না।’ পরে বিকালে এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না। উনি আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল স্পোকসম্যান কিনা এটা আমি জানি না। আমরা উনার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেবো কেন? আই ডোন্ট মেক এ্যানি কমেন্ট।’

এদিকে বুধবার প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা আমির হোসেন আমুর বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে সংকট সমাধান নিয়ে ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ক্ষমতাসীন দলে নেতামন্ত্রীদের বক্তব্য এলোমেলো। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন বিএনপি হলো একটি সন্ত্রাসী দল, এরা সন্ত্রাস করে এদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় বসার প্রশ্নই ওঠে না। এবার আমির হোসেন আমু বলেন যে, বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করার জন্য প্রস্তুত আছে জাতিসংঘের সমঝোতার মাধ্যমে। আবার ওবায়দুল কাদের বলেছেন, না এটা সঠিক না।

একই বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘কোথায় কোন সমাবেশে কে কী বলছেন- সেটার জবাব দেওয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আমরা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করছি। আমাদের কাছে কেউ লিখিত প্রস্তাব দিলে সেটার জবাব দেওয়ার জন্য ভাবব।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসা এবং বাংলাদেশের জন্য মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার প্রেক্ষিতে দাবি বাস্তবায়নে আন্দোলনের পাশাপাশি কূটনৈতিক চ্যানেলে তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বিএনপি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্যরা। ওই বৈঠকগুলোতে কেন এই সরকারের অধীনে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না-বিএনপি তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর স্বপক্ষে দলীয় সরকারের অধীনে বিগত দুটি নির্বাচন কেমন হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে কীভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে- লিখিত ও অলিখিত ফরম্যাটে সেগুলো তুলে ধরেন নেতারা। বিএনপি যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, সেটিও স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে দলটির পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের জানানো হয়, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে সংলাপের আহ্বান আসলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি।

এর আগে গত ৮ মে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। বৈঠকে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতিসংঘ যে বারবার উদ্যোগ নিয়েছে সেটা উল্লেখ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও বিশ্ব সংস্থাটি বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন দলটির নেতারা।

এ সময় তারা বাংলাদেশে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে জাতিসংঘের তৎকালীন সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। এছাড়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ডক্টর কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি। ওই সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সংলাপে প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কথাই রাখা হয়নি। ওই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এবার সরকারের সঙ্গে এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে যেতে আগ্রহী নয় বিএনপি।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে