সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ কার্তিক ১৪৩১

নির্বাচন ঘিরে জোটবদ্ধ রাজনীতি

যাযাদি ডেস্ক
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:২৪
নির্বাচন ঘিরে জোটবদ্ধ রাজনীতি

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট গত কয়েকটি নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবেই অংশগ্রহণ করলেও সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত জোটের বিষয়টি খোলাসা করেনি। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি সরাসরি কোনো জোটের সঙ্গে না থাকলেও সমমনা ত্রিশটিরও বেশি দলকে নিয়ে সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে। এদিকে, সাধারণত নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোট গঠনের একটি প্রবণতা কাজ করে, যার মূল উদ্দেশ্যই থাকে সমমনা দলগুলোকে এক জায়গায় এনে নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করা। অন্যদিকে, অনেক সময় বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও দলগুলোর মধ্যে জোট হয় অভিন্ন লক্ষ্যকে সামনে রেখে। নব্বইয়ের দশকে যেমন জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনের দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট।

তবে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী জোট ১৪ দলকে ধরে রাখলেও বিএনপি তাদের নির্বাচনী জোট চার দলীয় জোট ও বিশ দলীয় ঐক্য জোট থেকে বেরিয়ে আসায় এসব জোট এখন কার্যকর নেই। দেশে নির্বাচনকে ঘিরে জোটের রাজনীতি কখন, কীভাবে কাজ করেছে- সেটিই তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। সূত্র : বিবিসি বাংলা

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালে যে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়েছিল সেখান থেকেই নির্বাচনী জোটবদ্ধ রাজনীতির সূচনা হয়েছিল এই ভূখণ্ডে এবং এটিই এ ভূখণ্ডের বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রথম নির্বাচনী জোট।

মূলত পাকিস্তান হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে প্রচণ্ড অজনপ্রিয় হয়ে পড়া মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে এ জোট গঠন করা হয়েছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন তখনকার আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং কৃষক প্রজা পার্টির এ কে ফজলুল হক। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তফ্রন্ট যে ইশতেহার দিয়েছিল তাতেই মূলত গুরুত্ব পেয়েছিল বাঙালিদের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো।

পরে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে বিপুল জয় পেয়ে সরকার গঠন করেছিল যুক্তফ্রন্ট এবং সেই সরকারের মন্ত্রী ছিলেন পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানও। তবে এরপর আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে এককভাবে নির্বাচন করেই আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

এদিকে, মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভ করা আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করে। তবে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। এর আগেই আওয়ামী লীগ বিরোধী কয়েকটি দলের সমন্বয়ে মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে একটি জোট হয় বায়াত্তর সালের শেষ দিকে। এরপর নির্বাচনের আগেও ভাসানীকে সামনে রেখেই আরেকটি নির্বাচনী জোটও হয়েছিল তখন।

এসব জোটের দাবি ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বদলে একটি জাতীয় সরকার গঠন। কিন্তু পরে বিরোধী দল হিসেবে জাসদ সক্রিয় হয়ে উঠলে এসব জোট ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিন্তু এর মধ্যে আওয়ামী লীগও ন্যাপ-মোজাফফর ও কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ে একটি জোট করে।

পরবর্তীতে এক পর্যায়ে সব দলকে এক ছাতার নিচে আনা হয় বাকশাল গঠন করে, কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পনেরই আগস্টের পর নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং এক পর্যায়ে তিনি রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হন। এরপর ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে জেনারেল জিয়ার জাগদল কয়েকটি দলকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করে।

এরপর দেশে রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের ওপর বিধিনিষেধ উঠে গেলে সক্রিয় হয় আওয়ামী লীগ। দলটি সিপিবিসহ আরও কয়েকটি দলকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করে ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট’।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে এই জোটের প্রার্থী ছিলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানি। নির্বাচনের পর জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট বিলুপ্ত করেন এবং গঠন করেন বিএনপি। ওই সময় বামপন্থী কয়েকটি দলও আলাদা জোট গঠন করেছিল কিন্তু রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা তারা করতে পারেনি।

এদিকে, জেনারেল এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনের দলীয় জোট আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট। তবে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোটগুলোর মধ্যে নানা অসন্তোষ তৈরি হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। তবে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দলীয় জোট। তবে ওই নির্বাচন বামপন্থী পাঁচ দলীয় জোটও অংশ নেয়নি।

পরে আবার আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার পর ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বয়কট করে সব জোট। তখন আবার আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বে আরেকটি জোট গঠিত হয় এবং তারাই সংসদে বিরোধী দল হিসেবে অবস্থান নেন। এ নির্বাচনের পর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন আরও গতি লাভ করে। এক পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান এরশাদ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এরশাদ আমলে দুটি প্রধান জোট গড়ে উঠেছিল আন্দোলনের মাধ্যমেই এবং নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা এরশাদকে পতনে বাধ্য করতে পেরেছিল।

কিন্তু এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় জোটকে ধরে রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ। জোটের অনেককে দলীয় মনোনয়ন দিলেও নির্বাচ কেন্দ্রিক জোট করেনি আওয়ামী লীগ। একইভাবে বিএনপিও অনানুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতা করলেও সেটি জোটের আনুষ্ঠানিকতায় আনা হয়নি তখন।

এমনকি নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলেও জামায়াত সরকারে অংশ নেয়নি। তবে এ সরকারের শেষদিকে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। এক পর্যায়ে জামায়াত, জাতীয় পার্টি এবং বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নিজেদের মতো করে একই দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে।

শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সরকারকে সেই দাবি মেনে নিতে হয়। ১৯৯৬ সালের পনেরই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে গঠিত সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাসের পর ত্রিশে মার্চ খালেদা জিয়াকে পদত্যাগ করতে হয়।

সেই বছর ১২ই জুনের নির্বাচনে জয়লাভ করে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও জাসদের আ স ম আব্দুর রবকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে ঐক্য সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে সেই সংসদে ১২০টি আসন ছিল বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের। যদিও জাতীয় পার্টির সমর্থন আওয়ামী লীগের দিকেই ছিল।

মূলত ১৯৯৬ সালের জুনে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের তিন বছরের মাথায় বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট। পরে এরশাদের জাতীয় পার্টিও তাদের সঙ্গে আসার পর এক পর্যায়ে গঠিত হয় চার দলীয় জোট। যদিও জাতীয় পার্টির আরেকটি অংশ থেকে যায় আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গেই।

তবে এরশাদের জাতীয় পার্টি বেশিদিন এই জোটে থাকেনি। কিন্তু নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি অংশ বিএনপি জোটে থেকে যায়।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে এবং তারা সরকার গঠন করে। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার পর সংসদে বিরোধী দল ছিল শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ।

এ সরকারের মেয়াদের শেষদিকে এসে বিভিন্ন বাম জোটগুলো আর খেলাফত মজলিশকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট গঠন করে আওয়ামী লীগ।

পরে ২০০৬ সালে চার দলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কেন্দ্র করে তুমুল আন্দোলনের সময় একমঞ্চে আসে আওয়ামী লীগ, এরশাদের জাতীয় পার্টি, ডক্টর কামাল হোসেনের গণফোরাম, ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারাসহ আরও কয়েকটি দল। পরে ডক্টর কামাল হোসেন বেরিয়ে অন্য জোট করলেও শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত হয় মহাজোট এবং ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে তারা।

বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জোটবদ্ধ হয়ে এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। এই জোটের নেতৃত্ব দেন দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই বিভিন্নভাবে জড়িত থাকা গণফোরামের সাবেক সভাপতি ডক্টর কামাল হোসেন।

এই নির্বাচনের আগে থেকেই মহাজোট কার্যকর না থাকলেও পুরনো ১৪ দলীয় জোটকে ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ।

জোটের রাজনীতি সব সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষ করে নির্বাচনে গুরুত্ব বহন করে মন্তব্য করে বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন ‘মূলত নির্বাচন আসলে বড় দলগুলো চায় তাদের সমমনা ছোট দলগুলো যেন বিপক্ষ শিবিরে না চলে যায়। আবার কিছু দল আছে যারা আদর্শিক কারণেই এসব জোটে থাকে।’

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে