শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেকুন ডগ থেকেই মানবদেহে প্রথম ঢুকেছিল করোনাভাইরাস!

যাযাদি ডেস্ক
  ১০ জুন ২০২৩, ০০:০০
নতুন গবেষণা

বিজ্ঞানীদের একটি দল দাবি করেছেন, কীভাবে প্রথম কোভিড-১৯ ভাইরাস মানব শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার 'সবচেয়ে জোরাল প্রমাণ' তারা খুঁজে পেয়েছেন। এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাসটি কীভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছিল, তা নিয়ে নানারকম গবেষণা হয়েছে, যার মধ্যে পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব রয়েছে, যার মধ্যে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। যদিও সেসব থিওরি বা তত্ত্বের কোনোটিই চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত হয়নি। এসব জটিলতার মধ্যে নতুন এই গবেষণার তথ্যকে একটি মোড়-বদলকারী ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে একটি নির্দিষ্ট প্রাণী প্রজাতিকে লক্ষ্য করে সর্বশেষ এই গবেষণাটি করা হয়। তিন বছর আগে চীনের উহানের হুয়ানান বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে সংগ্রহ করা নমুনার ওপর ভিত্তি করে এসব বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। শুরু থেকেই ধারণা করা হয়েছিল, ওই বাজার থেকেই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। এই গবেষণার ফল সম্প্রতি একটি অনলাইন জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।

যখন কোভিড একটি রহস্যময় রোগ হিসেবে বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত ছিল, সেই ২০২০ সালের প্রথমদিকে ওই বাজার থেকে নমুনাগুলো সংগ্রহ করেছিল চীনের 'সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল' (সিডিসি)। সম্প্রতি সেসব নমুনার জেনেটিক তথ্য বের করা হয়েছে, যা সংক্ষিপ্ত ও সর্বজনীন। সেসব তথ্য পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানীদের একটি দল কোভিড-১৯ ভাইরাস বিস্তারের জন্য মধ্যবর্তী বাহক হিসেবে 'রেকুন ডগ' নামে একটি কুকুরজাতীয় প্রাণীকে শনাক্ত করেছে, যেখানে থেকে ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, বাজারের যে জায়গা থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় সার্স কোভ-২ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে এবং যেখানে বন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী মাংসের জন্য বাজারে বিক্রি করা হচ্ছিল, সেখানে এই রেকুন কুকুরের লালাও পাওয়া গেছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের উৎস খোঁজার ব্যাপক অনুসন্ধান এবং দীর্ঘদিন আগেই সেই বাজারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, বিক্রির জন্য আনা প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলার কারণে এ বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই।

তিন বছর আগে এই গবেষণাটি করা হলেও সেটার ফল প্রকাশে এত বেশি দেরি হওয়াকেও অনেক বিজ্ঞানী 'কলঙ্কজনক' বলে অভিহিত করেছেন। 'কোনো গবেষণাগার থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল'- মার্কিন কর্তৃপক্ষের মধ্যে এমন একটি তত্ত্ব যখন জোরাল ভিত্তি পেতে শুরু করেছে, তেমন আভাসের মধ্যেই এ গবেষণার ফল প্রকাশ করা হলো।

চীনের সরকার অবশ্য সে দেশের কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে ভাইরাসটির জন্ম হয়েছিল বলে যে ধারণা করা হচ্ছে, তা জোরালভাবে অস্বীকার করেছে। কিন্তু আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এবং মার্কিন 'ডিপার্টমেন্ট অব অ্যানার্জি' ধারণা করছে, সেটা 'হলেও হতে পারে'।

ভাইরাসের উৎপত্তি রহস্য নিয়ে তদন্ত করে আমেরিকার বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে গত ১ মার্চ এফবিআইর পরিচালক চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে, তারা তদন্তে 'বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা' তৈরি করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, চীনের কোনো গবেষণাগার থেকে ভাইরাসটির বিস্তার তত্ত্বের ব্যাপারে অনেকদিন ধরেই এফবিআই নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সেটা জানার পরও কেন এফবিআই এসব তথ্য প্রকাশ করেনি, তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো বিজ্ঞানী।

কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানে তিন বছর ধরে যারা কাজ করেছেন, এমন কয়েকজন বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, কীভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল, এই নতুন গবেষণা তা বোঝার জন্য সবচেয়ে কাছাকাছি থিওরি বা তত্ত্ব হতে পারে। সেই সঙ্গে চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, তা রহস্য সমাধানের বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

নতুন গবেষণায় কী জানা যাচ্ছে?

চীনে বন্যপ্রাণী বাজার থেকে সংগ্রহ করা নমুনাগুলোর জিনগত বিশ্লেষণ করে দেখেছেন প্যারিসের 'ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ইন্সটিটিউট'র সিনিয়র গবেষক ডক্টর ফ্লোরেন্স ডেবারে। এই গবেষক বলেছেন, যখন তিনি প্রথম জানতে পারেন, এ ধরনের কিছু তথ্য রয়েছে, সেটা পাওয়ার জন্য তিনি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।

বিজ্ঞানীদের এ ধরনের তথ্য শেয়ার করার পস্নাটফর্ম- জিআইএসএআইডি নামে একটি জেনেটিক তথ্য ভান্ডারে এসব জেনেটিক কোড পাওয়ার এবং ডাউনলোড করে নেওয়ার পর তিনি এবং তার সহকর্মীরা বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন যে, চীনের ওই বাজারে ভাইরাসের স্থান থেকে সংগ্রহ করা নমুনার সঙ্গে কোন জাতীয় প্রাণীর নমুনার মিল রয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা কম্পিউটার স্ক্রিনে যেসব ফল পেয়েছি, তা হলো, রেকুন কুকুর, রেকুন কুকুর, রেকুন কুকুর, রেকুন কুকুর'।

রেকুন ডগ হচ্ছে এমন একটি ছোট আকারের কুকুর-সদৃশ প্রাণী, যার সঙ্গে শিয়ালেরও অনেক মিল আছে। পূর্ব এশিয়ার চীন, জাপান, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের বেশকিছু অঞ্চলে এই প্রাণীটির আবাসস্থল রয়েছে।

ডক্টর ডেবারে ব্যাখ্যা করছেন, 'সুতরাং আমরা একই জায়গায় একই সঙ্গে ভাইরাস এবং (বাহক) প্রাণী খুঁজে পেয়েছি। এর মানে এই নয় যে, ওই কুকুরগুলো সংক্রমিত হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা যত ব্যাখ্যা পেয়েছি, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা।'

এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডি হোমসের মতে, ভাইরাসটি কীভাবে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে এসেছে, এটাই তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ। অধ্যাপক হোমস বলেন, 'আমরা আর কখনোই সেই বাহক প্রাণীটিকে খুঁজে পাব না, কারণ সেটি (তথ্যপ্রমাণ) হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটি অসাধারণ যে, জেনেটিক তথ্যের মাধ্যমে সেটাকে খুঁজে পাওয়া গেছে- আর এর মাধ্যমে শুধু সেটা কোনো প্রজাতি তাই নয়, তারা বাজারের ঠিক কোন্‌ জায়গায় ছিল, সেটাও আমরা জানতে পারছি।'

এখন বিজ্ঞানীরা আর কী করতে পারেন?

সর্বশেষ এই গবেষণায় পাওয়া নতুন তথ্যগুলো কোভিড মহামারির উৎস সম্পর্কে আরও জানতে বা গবেষণা করতে মূল ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, সেই গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জটিল হবে।

রটারডামের ইরাসমাস ইউনিভার্সিটিরই অধ্যাপক মেরিয়ন কুপম্যানস বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তদন্তকারী দলের সদস্য ছিলেন, যারা ২০২০ সালে উহানে গিয়েছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলছেন, 'নতুন গবেষণায় এসব প্রাণীর অবস্থান নির্দিষ্ট স্টল বা দোকানে থাকার বিষয়টি চিহ্নিত করে দিয়েছে। সেখানে বিক্রি করা প্রাণীগুলো কোথা থেকে এসেছে, তা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কিন্তু এটা যদি অবৈধ বিক্রির অংশ হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন হলো- আপনি সেসব তথ্য আর খুঁজে পাবেন কিনা।'

যেসব খামারে এসব প্রাণী বড় করা হয়েছে, সেখানেও জৈবিক প্রমাণ থাকতে পারে। গবেষকরা যদি সেসব খামারের প্রাণীতে অ্যান্টিবডি দেখতে পান, যা প্রমাণ করে যে, এসব প্রাণী সার্স কোভ-২ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। সেটাও গবেষকদের আরেকটি সূত্র দিতে পারে। জেনেটিক এসব তথ্য গবেষণার বা তদন্তের ক্ষেত্র অনেক কমিয়ে আনতে পারে। তবে অধ্যাপক হোমস বলছেন, কোনো প্রাণীর মধ্যে আসল ভাইরাসটি খুঁজে বের করা বেশ কঠিন একটা কাজ হবে। তাহলে মহামারি কীভাবে শুরু হয়েছিল? এই গবেষণায় সেটা অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলা যায়নি। হয়তো এটা এমন একটা উত্তর, যা কোনোদিনই জানা যাবে না। সেই উত্তর খোঁজার কাজটি এখন ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক এবং বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে