সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
মণিপুরে সহিংসতা

কবে সমাধান, জানা নেই কারও

কুকিদের প্রধান দাবি, তাদের জন্য আলাদা প্রশাসন করতে হবে। মেইতেইদের দাবি, এটা কিছুতেই করা যাবে না। এই সমস্যার কীভাবে সমাধান হবে? কোনো সমাধান সূত্র এখনো সামনে নেই। কীভাবে ও কবে মাদক সমস্যার সমাধান হবে, অনুপ্রবেশ নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করবে না, জানা নেই। কবে উদ্বাস্তু মানুষরা ত্রাণশিবির থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, তার উত্তরও জানা নেই। দুই পক্ষের মধ্যে বৈরিতা, বিদ্বেষ, সন্দেহ, অবিশ্বাস, লড়াইয়ের ইচ্ছা কবে কমবে, সেটাও জানা নেই। এমনকি সরকার কবে সমাধান সূত্র নিয়ে আসতে পারবে, তাও জানা নেই মণিপুরের মেইতেই ও কুকিদের...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
সহিংসতার আগুনে পুড়ছে ভারতের মণিপুর -ফাইল ছবি

গত ৯ আগস্ট রাতের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে গেলেন ভারতের উত্তর-পূর্বঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরের ৪০ বিধায়ক। মণিপুর বিধানসভার আসন সংখ্যা ৬০, তার মধ্যে বিজেপির বিধায়ক ৩২ জন। বিজেপির নেতৃত্বে এই বিধায়করা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মীদের কাছে একটা স্মারকলিপি দিয়ে আসেন। সেখানে তাদের দাবি, মণিপুর থেকে অবিলম্বে আসাম রাইফেলসকে সরিয়ে দিতে হবে, কুকিদের সঙ্গে যে 'সাসপেনশন অব অপারেশন' বা এসওও চুক্তি করা হয়েছিল, তা বাতিল করতে হবে, এনআরসি চালু করতে হবে, কুকিদের আলাদা প্রশাসনের দাবি মানা যাবে না এবং সব অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করতে হবে।

মণিপুরে যে কোনো মেইতেইয়ের সঙ্গে কথা বললে তারাও সবাই ঠিক এই দাবিগুলোই জানাবে। আর যদি কুকিদের সঙ্গে কথা বলা হয়, তাহলে শোনা যাবে- আসাম রাইফেলসকে কোনোভাবেই সরানো যাবে না, মণিপুরের পুলিশ ও কমান্ডোদের পাহাড় থেকে সরাতে হবে, কুকিদের জন্য আলাদা প্রশাসন দিতে হবে এবং মেইতেইদের হাত থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং এসওও বাতিল করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

আসাম রাইফেলস এবং মণিপুর পুলিশ ও কমান্ডো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তব, মণিপুরের এই সংঘাতে আসাম রাইফেলস এবং মণিপুর পুলিশ ও কমান্ডোদের নাম বারবার উঠে আসছে। কয়েক দিন আগে আসাম রাইফেলসের ৯ নম্বর ব্যাটালিয়ানের বিরুদ্ধে মণিপুরের পুলিশ একটি এফআইআর করে। সেখানে বলা হয়েছে, আসাম রাইফেলস পুলিশকে তাদের কাজ করতে দিচ্ছে না। তারা সাঁজোয়া যান দিয়ে রাস্তা আটকে দিচ্ছে। অভিযুক্ত কুকি সন্ত্রাসীরা মেইতেইদের হত্যা করে পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

কিছুদিন আগে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে পুলিশের সঙ্গে আসাম রাইফেলসের উত্তেজিত বাক্য বিনিময় ছিল। সেই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশের এফআইআর পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। তার সঙ্গে আসাম রাইফেলসের প্রতিক্রিয়াও বলে দিচ্ছে, পরিস্থিতি কোন জায়গায় চলে গেছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কিছু শত্রম্নভাবাপন্ন কেন্দ্রীয় বাহিনী, বিশেষ করে আসাম রাইফেলসের ভূমিকা, অভিপ্রায় ও ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে বারবার বেপরোয়া ও ব্যর্থ অভিযোগ করছে। আসাম রাইফেলস ৩ মে'র পর থেকে মানুষের জীবন বাঁচানো ও শান্তি ফেরানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, মণিপুরের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। সেখানে 'গ্রাউন্ড লেভেলে' (মাঠ পর্যায়) মাঝেমধ্যে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে কৌশলগত পর্যায়ে মতবিরোধ হতেই পারে। এ রকম ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং বিষয়টি মিটিয়ে ফেলা হয়। সবাই মিলে মণিপুরে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে কাজ করছে।

এক কুকি নেতাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করা হয়েছিল। আসাম রাইফেলসকে আপনারা সম্পূর্ণ সমর্থন করেন, আর মেইতেইরা কেন বিরোধ করে? তিনি বলেছিলেন, আসাম রাইফেলসের 'ক্যাচলাইনটা' একবার দেখবেন, সেটা হলো- 'ফ্রেন্ডস অব হিল পিপল'।

ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের শহর মোরে। কয়েকদিন আগেই সেখানে কুকি মেয়েদের সঙ্গে আসাম রাইফেলসের বিশাল ঝামেলা হয়েছিল। কুকি মেয়েদের অভিযোগ ছিল, আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা তাদের হেনস্তা করেছে। মোরেতে কুকি নারীদের সংগঠনের প্রধান আনচিনকে প্রশ্ন করা হলো- তবে কি আপনারা চান, আসাম রাইফেলস চলে যাক? সঙ্গে সঙ্গে আনচিনের জবাব, 'প্রশ্নই ওঠে না। আমরা চাই মণিপুরের কমান্ডোরা এখান থেকে চলে যাক। আমরা আসাম রাইফেলসের বিরুদ্ধে নই। মণিপুরের পুলিশ ও কমান্ডোর বিরুদ্ধে।'

রাজধানী ইম্ফলে নামপ্রকশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিকের অভিযোগ, 'আসাম রাইফেলস কুকিদের সাহায্য করছে। তারা অনেক দিন মণিপুরের পাহাড়ে আছে। তাদের সরিয়ে দেওয়া হোক। তাদের জায়গায় সেনাবাহিনীর অন্য ব্রিগেড মোতায়েন করা হোক।'

মেইতেই ত্রাণশিবির; বিশেষ করে চূড়াচাঁদপুরের কাছে মৈরাঙের শিবির। সেখানে গেলেই শোনা যাবে, আসাম রাইফেলস তাদের শিবিরে নিয়ে এসেছে। কোথাও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাড়িতে করে মেইতেইদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছে তারা। মোরের কাছে কথা নামে মেইতেইদের গ্রাম আছে। চারদিকে কুকিরা, মাঝখানে এই একটা মেইতেই গ্রাম। আসাম রাইফেলস অনেক কষ্টে গ্রামটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে। তারপরও ত্রাণশিবিরে মেইতেইদের অভিযোগ, কুকিরা যখন তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, তখন আসাম রাইফেলস আসেনি, কিছুই করেনি।

আবার মোরেতে কুকিদের ত্রাণশিবিরে পুলিশের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ শোনা যাবে ঘর হারানো উদ্বাস্তু মানুষের কাছে। তারাও বলছে, যখন তাদের ঘর জ্বলছিল, তখন পুলিশ কী করছিল? তারা দীর্ঘপথ জঙ্গলের মধ্যে পাড়ি দিয়ে অবশেষে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে। কিন্তু তাদের বাড়ি, টাকা, পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে সব খুইয়েছে। তাদের অভিযোগ, পুলিশ মেইতেইয়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মণিপুরে এই বিভাজনটা মারাত্মক। বিশেষ করে আসাম রাইফেলস ও রাজ্যের পুলিশকে নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা বড়ই চিন্তার।

সমাধান কোন পথে?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে বিধায়করা স্মারকলিপি দিয়ে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন, তা মেইতেইদের দাবি। এই দাবির মধ্যে আছে এসওও চুক্তি বাতিল করা। ২০০৮ সালে এই চুক্তি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার, মণিপুর ও কুকিদের মধ্যে। চুক্তি অনুসারে, কুকি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সেনা ও মণিপুরের পুলিশ কোনো অপারেশন চালাবে না। কুকি গোষ্ঠীগুলোও কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজ করবে না। গত ১০ মার্চ মণিপুর সরকার জানিয়ে দিয়েছে, তারা কুকি ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) এবং জোমি রেভলিউশনারি আর্মির ক্ষেত্রে এসওও থেকে সরে এসেছে। কারণ এই গোষ্ঠীগুলো বেআইনিভাবে বনভূমি দখল করার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তারপরও তারা কুকি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অপারেশন চালাতে পারছে না, কারণ পাহাড়ে তো আসাম রাইফেলস আছে। আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া মেইতেইদের বিরুদ্ধে তাদেরও কিছু করার নেই, কারণ, উপত্যকায় আছে পুলিশ ও কমান্ডোরা।

কুকিদের মধ্যে প্রায় ৩০টি গোষ্ঠী আছে, যারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ৪০ বিধায়কের দাবি, অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। অস্ত্র শুধু কোনো একপক্ষের হাতে নেই। দুই পক্ষের হাতেই প্রচুর ও অত্যাধুনিক অস্ত্র আছে। এই সংঘাতে সেসব অস্ত্র ব্যবহারের ফলে এত মানুষ মারা গেছে বা আহত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, দুই পক্ষের হাত থেকে কী করে অস্ত্র নেওয়া হবে? কোনো সমাধানসূত্র এক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত নেই।

মণিপুরের কুকিদের প্রধান দাবি, তাদের জন্য আলাদা প্রশাসন করতে হবে। মেইতেইদের দাবি, এটা কিছুতেই করা যাবে না। এই সমস্যার কীভাবে সমাধান হবে? কোনো সমাধান সূত্র এখনো সামনে নেই।

কীভাবে ও কবে মাদক সমস্যার সমাধান হবে, অনুপ্রবেশ নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করবে না, উত্তর জানা নেই। কবে উদ্বাস্তু মানুষ ত্রাণশিবির থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, তার উত্তরও জানা নেই। দুই পক্ষের মধ্যে বৈরিতা, বিদ্বেষ, সন্দেহ, অবিশ্বাস, লড়াইয়ের ইচ্ছা কবে কমবে, সেটাও জানা নেই। এমনকি সরকার কবে সমাধান সূত্র নিয়ে আসতে পারবে, তাও জানা নেই মণিপুরের মেইতেই ও কুকিদের। তবে সবপক্ষ একসুরে একটা কথাই বলেছে, পরিস্থিতি এত সহজে স্বাভাবিক হবে না। তার জন্য সময় লাগবে। কতদিন? এক বছর, পাঁচ বছর, ১০ বছর বা তারও বেশি? সত্যিই জানা নেই কারও। সংবাদসূত্র : ডিডাবিস্নউ নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে