সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২
আরেক বছর যুদ্ধে ইউক্রেনের টিকে থাকা নিয়ে সংশয়

আমিরাতের মধ্যস্থতায় ৩ শতাধিক বন্দি মুক্তি দিল রাশিয়া-ইউক্রেন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আমিরাতের মধ্যস্থতায় ৩ শতাধিক বন্দি মুক্তি দিল রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৫৯তম বন্দি বিনিময়

ইউক্রেন এবং রাশিয়া তিন শতাধিক যুদ্ধবন্দির মুক্তি দিয়েছে। নতুন বছর শুরুর প্রাক্কালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মধ্যস্থতায় বিপুল সংখ্যক এই বন্দি বিনিময় করে উভয় দেশ। রাশিয়ার কবল থেকে ইউক্রেনীয় বন্দিদের ফিরে আসাকে সুসংবাদ বলে অভিহিত করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, নববর্ষের আগের দিন সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যস্থতায় ৩০০ জনেরও বেশি যুদ্ধবন্দিকে রাশিয়া এবং ইউক্রেন নিজেদের মধ্যে বিনিময় করেছে বলে উভয় দেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সোমবার রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ১৫০ ইউক্রেনীয় বন্দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ১৮৯ ইউক্রেনীয় দেশে ফিরে এসেছেন। অবশ্য বিনিময় করা বন্দিদের বিষয়ে উভয় দিক থেকে রিপোর্ট করা সংখ্যার মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

জেলেনস্কি টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে বলেছেন, "রাশিয়ান বন্দিদশা থেকে আমাদের জনগণের প্রত্যাবর্তন আমাদের প্রত্যেকের জন্য সর্বদা খুব ভালো খবর। এবং আজ এমন একটি দিন: আমাদের দল ১৮৯ ইউক্রেনীয়কে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।" তিনি আরও বলেছেন, বিনিময়ে ২০২২ সালে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী মারিউপোলে বন্দি হওয়া দুই বেসামরিক নাগরিকও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। একইসঙ্গে বিনিময় আলোচনায় সহায়তা করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। জেলেনস্কির প্রকাশিত ছবিতে কয়েক ডজন পুরুষকে বাসে বসে থাকতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইউক্রেনের জাতীয় নীল এবং হলুদ পতাকায় মোড়ানো ছিলেন। অন্যদিকে রাশিয়ার মানবাধিকার কমিশনার তাতায়ানা মোসকালকোভার প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সৈন্যরা শীতের পোশাক এবং সামরিক ক্লান্ত-চেহারায় বাসের বাইরে জড়ো হয়েছেন। মোসকালকোভা তাদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, "আমি আপনাদের সেবা, ধৈর্য এবং সাহসের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। খুব শিগগিরই আমাদের ছেলেরা তাদের আত্মীয় এবং বন্ধুদের আলিঙ্গন করবে এবং তাদের জন্মভূমিতে নববর্ষ উদযাপন করবে।

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধবন্দিদের বাড়িতে পাঠানোর আগে মস্কোর গুরুত্বপূর্ণ মিত্র প্রতিবেশী দেশ বেলারুশে মানসিক এবং অন্যন্য চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক হামলা শুরুর পর থেকে পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। প্রায় তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোঝিয়ার চারটি প্রদেশের আংশিক দখল নিয়েছে রুশ বাহিনী। এই চার প্রদেশের রাশিয়ার দখলে যাওয়া অংশের সম্মিলিত আয়তন ইউক্রেনের মোট ভূখন্ডের এক-পঞ্চমাংশ। অবশ্য যুদ্ধরত এই দুই দেশের কেউই তাদের নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য প্রকাশ না করলেও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হতাহতের সংখ্যা কয়েক লাখ বলে অনুমান করছে।

এদিকে ইউক্রেন ক্রমশ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থতার মুখোমুখি হচ্ছে। তিন বছরের দীর্ঘ যুদ্ধে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন দেশটির বহু সেনা। প্রশ্ন উঠছে, ইউক্রেন কি আরেক বছর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে? ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি রণক্ষেত্রের সেনাদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির বাহিনী এখনও পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। তবে তারা প্রায়ই কুরাখোভে শহরের চারপাশে ঘিরে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে, যেখানে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলছে। 'বস্ন্যাক প্যাক' নামে একটি মর্টার ইউনিট কুরাখোভের চারপাশে ঘেরাও প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনী তিন দিক থেকে চাপ দিচ্ছে।

একটি নিরাপদ ঘাঁটিতে ইউনিট সদস্যদের সঙ্গে দেখা হয় বিবিসির রিপোর্টারের। এখানে তারা যুদ্ধের ক্লান্তি কাটানোর চেষ্টা করছেন। এই সেনারা প্রথাগত নয়,তারা একজন ভেগান শেফ, একজন মেকানিক, একজন ওয়েব ডেভেলপার ও একজন শিল্পী। একদল বন্ধুরা, যারা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে মনে করেন।

তারা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। তাদের ৩১ বছর বয়সী কমান্ডার সুরত বলেন, তিনি রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণের পরপরই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। শুরুতে তিনি মনে করেছিলেন যুদ্ধ তিন বছর স্থায়ী হবে। এখন তিনি আরও দশ বছরের যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সুরত বিশ্বাস করেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধের ইতি টানতে চাইবেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও আলোচনার জন্য প্রস্তুতি দেখিয়েছেন। তবে একটি কার্যকর সমাধান এখনও দুরাশা।

তিনি বলেন, আমরা বাস্তববাদী। আমরা বুঝি ইউক্রেনে ন্যায়বিচার পাবে না। অনেকে হয়তো মেনে নিতে বাধ্য হবেন যে তাদের বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, তাদের প্রিয়জন নিহত হয়েছেন। এটি অনেক কঠিন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি আলোচনা চান, না যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। সুরত দৃঢ়ভাবে বলেন, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাই। ইউনিটের বেশিরভাগ সদস্যের মতও এমনই। ভেগান শেফ সের্হি মনে করেন, আলোচনা যুদ্ধকে সাময়িকভাবে বন্ধ করতে পারে। কিন্তু এটি এক বা দুই বছরের মধ্যে আবার ফিরে আসবে। শিল্পী দাভিদ বিশ্বাস করেন, ট্রাম্পকে নিয়ে পূর্বানুমান কঠিন। তিনি ইউক্রেনের জন্য খুব ভালো অথবা খুব খারাপ হতে পারেন। ইউনিটটি এক সপ্তাহ রণক্ষেত্রের সম্মুখভাগে কাটিয়েছে। বিশ্রামের সময়ও তারা প্রশিক্ষণ চালিয়ে যায়। তারা বলছে, এটি তাদের মনোবল ধরে রাখতে সাহায্য করে। নতুন যোগ দেওয়া সদস্য ডেনিস নিরাপদ জীবন ছেড়ে জার্মানি থেকে এসেছেন। তার কথায়, আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, ইউক্রেন ছাড়া পৃথিবীতে বাঁচতে পারব কি?

ডেনিস মনে করেন, ইউক্রেনের হতাহতের সংখ্যা সরকার স্বীকার করা সংখ্যার চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, আমাদের অনেক সেনা হয় হারিয়ে গেছে, না হয় খুবই ক্লান্ত। আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারব না। ইউক্রেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ডনিপ্রোতেও যুদ্ধের ক্লান্তি স্পষ্ট। রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার শিকার শহরটির বাসিন্দারা সাইরেনের ফাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে থিয়েটারে যান। একটি হাস্যরসাত্মক নাটকের প্রদর্শনীর আগে, নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এখানে উপস্থিত হওয়া লুদমিলা বলেন, আমরা সাহায্য পাচ্ছি, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আলোচনা করতেই হবে। একটি শরণার্থী শিবিরে ৮৭ বছর বয়সী ভ্যালেনটিনা বলেন, অতিথি হিসেবে থাকা ভালো, কিন্তু নিজের বাড়ি আরও ভালো। শরণার্থীদের অনেকেই মনে করেন, শান্তির জন্য আলোচনার বিকল্প নেই। তবে, মারিয়া বলেন, কেউ সামরিকভাবে জিততে পারবে না। তাই আলোচনার দরকার। তবে আলোচনায় ইউক্রেনকে হয়তো কিছু ভূমি ছাড়তে হবে। অনেকের মতে, সেটাই হবে শান্তির জন্য তাদের সবচেয়ে বড় ত্যাগ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে