সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ও আগস্ট হত্যাকান্ড

মো. আকিব হোসাইন শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা কলেজ, ঢাকা সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ঢাকা কলেজ শাখা
  ১৬ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
বঙ্গবন্ধু ও আগস্ট হত্যাকান্ড

তৎকালীন পূর্ব বাংলার শান্তিকামী মানুষের মুক্তির আন্দোলনের অগ্রনায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা মোসাম্মৎ সায়েরা বেগম। তিনি মাত্র ৭ বছর বয়সে গ্রামের গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তারপর তিনি স্থানীয় মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে পড়াশোনা সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়। ১৯৩৯ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে আসলে স্কুলের সবার হয়ে স্কুলের সকল সমস্যার সমাধানে প্রতিবাদ করায় তিনি ৭ দিনের মতো কারাবরণ করেন। এটাই ছিল জীবনের প্রথম কারাবাস। ১৯৪২ সালে এন্ট্রাস পাস করেন। ওই বছরই তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন। তিনি কলকাতার হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ওই বছর পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৫ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর মনোনীত প্রার্থী জয়লাভ করেন। ১৯৪০ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর দেশভাগের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি নিজ হাতে মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার চেষ্টা করলেও এ দেশের ছাত্রসমাজ তার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেন। বঙ্গবন্ধু সে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকা আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা মিছিল বের করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে একটি মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে শহীদ হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের চারটি দল পাকিস্তানি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২৩০টি আসন পায়। তন্মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি আসন। তারপরও কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হয়নি। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ মিটিংয়ে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তারপর ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি করা হয়। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তানের লাহোরে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬টি দফাই ছিল বাঙালি জাতির বাঁচার দাবি। এগুলোকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত ৬টি দফার মূল বিষয়বস্তু হলো- এক. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে। দুই. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে। তিন. অর্থ সম্পর্কিত ক্ষমতা সম্পর্কে। চার. রাজস্ব কর বা শুল্ক সংক্রান্ত ক্ষমতা। পাঁচ, বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কিত ক্ষমতা। ছয়, আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন বিষয়ক ক্ষমতা সম্পর্কে।

১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্রথম আসামি করে আরও ৩৪ জনসহ সর্বমোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলাটি রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান হিসেবে পত্রপত্রিকায় ছাপানো হয়। ১৯৬৯ সালে সামরিক সরকারবিরোধী গণঅভু্যত্থান শুরু হয়। গণঅভু্যত্থানে এ দেশের সব স্তরের জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেন। গণঅভু্যত্থানে অংশগ্রহণ করার সময় বিভিন্ন মিছিল, মিটিং করা হয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধুকে আটক করে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হয়। তাছাড়া গণঅভু্যত্থানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এ দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার থেকে শুরু করে সবার উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছেন। তারপর ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ৭০-এর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভ করেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পাননি। তারপর ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বাংলায় হরতাল পালিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার মাঝে বঙ্গবন্ধুর সেই অগ্নিঝরা ভাষণ পেশ করেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনাতর সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো ততুও এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআলস্নাহ। তার এ ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা। তার এমন বিপস্নবী ভাষণটি ছিল দেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে, শোষিতের পক্ষে এবং শোষকের বিপক্ষে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এ দেশের মানুষের মুক্তির ভাষণ, যে ভাষণ শোনার পর লাখো লাখো জনতা পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধে ছাত্র, শিক্ষক, জেলে, শ্রমিকসহ সবাই অংশগ্রহণ করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণ বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে অন্যতম। ঐতিহাসিক এ ভাষণটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক উক্ত ভাষণকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ অর্থাৎ বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট সংঘটিত হয়।

২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এ দেশের ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল। আমাদের নিকট এ রাতটি অশনি সংকেত হিসেবে পরিচিত। এ রাতকে কালো রাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসক হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছেন। নৃশংসভাবে হত্যাকান্ড চালিয়েছেন। এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মধ্যদিয়ে এ দেশের বিজ্ঞ লোকদের শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। যা কখনো ভোলার মত নয়। চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে এমন নৃশংস দিনগুলোর কথা। ইতিহাসের সবচেয়ে অবহেলিত ও কলঙ্কিত অধ্যায় ছিল সেটা। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেষ রাতে কিংবা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আটক হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে এই দেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা দেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৬ মার্চ সারাদেশে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে, মুক্তির লড়াইয়ে সংগ্রামরত মানুষের পক্ষে, অধিকারহারাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জনগণের প্রকৃত বন্ধু। সর্বদা এ দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। জীবনের প্রতিটি সময় অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি নেতা। একজন প্রতিবাদী নেতা হিসেবে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাঙালি জাতির হৃদয়ে। কিন্তু ইতিহাসের একটি কলংকময় অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ওইদিন ভোরে একদল বিপথগামী সেনার হাতে নিহত হয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ অন্য দুই ছেলে, স্ত্রী, ছোট ভাইসহ অন্যান্য স্বজনকেও হত্যা করে। একজন দেশপ্রেমিক নেতাকে এভাবে হত্যা করার মধ্যদিয়ে ইতিহাসকে কলুষিত করেছে। ১৫ আগস্টের সেই রাতটি ছিল বাঙালি জাতির বিয়োগান্তক ঘটনার দিন। শোকের মাসে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় করে রাখবে। এটাই প্রত্যাশা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে