মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

কেবল পরিবহণ মালিকই নন ঢাকাও গরিবের শহর!

হাফ ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত শুধু ঢাকা শহর নয়, পুরো দেশের জন্যই হওয়া উচিত ছিল। দেশের অন্য অঞ্চলগুলোর ছাত্র-ছাত্রীরা কী অপরাধ করেছেন? এটা রীতিমতো চরম বৈষম্যমূলক, অন্যায্য, অযৌক্তিক ও প্রহসনমূলক ঘোষণা।
মোহাম্মদ আবু নোমান
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
কেবল পরিবহণ মালিকই নন ঢাকাও গরিবের শহর!

সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ইতিপূর্বে বলেছেন, ৮০ শতাংশ পরিবহণ মালিক গরিব। এবার ছাত্র আন্দোলনের মুখে তাদের হাফ ভাড়া দাবি-দাওয়া মানার ভাব দেখে মনে হয়, শুধু পরিবহণ কর্তৃপক্ষই গরিব নয়, খোদ রাজধানী ঢাকাই হচ্ছে গরিবের শহর! ঢাকায়ই সব গরিব মানুষের বসবাস! বাকি বিভাগগুলো হচ্ছে জমিদার ও রাজবংশের বিভাগ! সেখানকার শিক্ষার্থীরাও রাজবংশের ছাত্র! যার কারণে শুধু ঢাকা মহানগরে চলাচলকারী শিক্ষার্থীরাই বাসে হাফ ভাড়া দিতে পারবে, দেশের অন্য শহরের কোনো শিক্ষার্থীর জন্য হাফ ভাড়ার সুযোগ নেই।

গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার দাবি মেনে নিয়ে ৩০ নভেম্বর পরিবহণ মালিকরা কতিপয় শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেছেন, শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া শুধু ঢাকা শহরের জন্য প্রযোজ্য হবে; ঢাকার বাইরে নয়। খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র দেখিয়ে সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত হাফ ভাড়া দেওয়া যাবে। এ ছাড়া সাপ্তাহিক ছুটি, সরকারি ছুটি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মৌসুমি ছুটির সময় হাফ ভাড়া দেওয়া যাবে না। শুধু ঢাকা মহানগরে চলাচলকারী বাসে হাফ ভাড়া দেওয়া যাবে; ঢাকার বাইরের জন্য এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না।

এ কেমন সিদ্ধান্ত! এক দেশে দুই আইন! এক আইন দুই জায়গায় ভিন্ন হবে কেন? শুধু রাজধানীর জন্য অর্ধেক ভাড়া, যা একটি বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত নয় কী? ঢাকার বাইরে কি ছাত্ররা থাকে না? নাকি ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সক্ষমতা বেশি? ছুটির দিনেও হাফ পাস কার্যকর করা উচিত ছিল, কারণ ছুটির দিনে শিক্ষার্থীরা চাকরীজীবী হয়ে যায় না। এরকম বৈষম্যমূলক আচরণ ও সিদ্ধান্ত পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ছিল। ১১ দফাই বলছে, তখন শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে হাফ ভাড়ার সুযোগ ছিল। যার কারণে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ অংশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হয়েছিল। স্বাধীন দেশে এরকম সিদ্ধান্ত থাকতে পারে কী? ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীদের কি হাফ ভাড়ার সুবিধা ভোগের অধিকার নেই? নাকি দেশের সব কোটিপতিদের ছেলেমেয়েরা ঢাকার বাইরে বসবাস করে? ঢাকায় শুধু গরিব পরিবহণ মালিক ও গরিব শিক্ষার্থীদের বসবাস?

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ইতিপূর্বে পরিবহণ নেতা খন্দকার এনায়েত উলস্নাহ বলেছিলেন, 'ঢাকায় চলাচলকারী পরিবহণ মালিকদের ৮০ শতাংশ গরিব...।' তার কথা হয়তো সঠিক। পরিবহণ মালিকরা 'পয়সাওয়ালা গরিব'! কারণ, বাংলাদেশ এখন উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে। এখানে একজন গরিব পর্যন্ত বাসের মালিক! বাংলাদেশে গরিবের সংজ্ঞাও ভিন্নভাবে করতে হবে। এখানে গরিব তারাই যারা অঢেল অর্থের অধিকারী, কিন্তু ব?্যাংক লোন পরিশোধ করতে অপারগ, আয় গোপন করতে পারঙ্গম ও অর্থ পাচারে সিদ্ধহস্ত। অন্যদিকে নেতারা বলছে, বাংলাদেশে গরিব নেই, তাহলে খন্দকার এনায়েত উলস্নাহ এত (৮০%) গরিব মানুষ কোথায় পেলেন? আর গরিব মানুষ ৪০-৫০ লাখ টাকার গাড়ির মালিক কীভাবে? কত টাকার মালিক হলে মানুষ গরিব থাকে না? লাখ লাখ টাকা দিয়ে যে গাড়ি কিনতে পারে সে যদি গরিব হয়, তাহলে গরিবের রচনা লিখতে নতুন করে ভাবতে হবে। পরিবহণ নেতাদের কথা যদি ঠিকই ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বলতে হবে তাদের আর্থিক দরিদ্রতা নয়, 'অন্তরের দরিদ্রতা' রয়েছে।

সাধারণ মানুষ তো কেউ হাফ ভাড়া দেওয়ার চিন্তা করে না। দিনভর কি শুধু ছাত্ররাই ভরপুর থাকে দেশের গাড়িতে? সারাদিন কি শুধু শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাস চলে? নাকি সাধারণ মানুষও চলাফেরা করে? একটা বাসে হয়তো দুই, তিন জন শিক্ষার্থী ওঠে, এদের হাফ ভাড়া নিতে তাদের এত কষ্ট। গরিবের দোহাই দিতে হলো? অথচ ২০-৩০ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে যায়, বাসের দরজায় ঝুলে থেকেও ফুল ভাড়া দেওয়া হয়। এ দৃশ্য সারা দেশের। সেটা কি পরিবহণ কর্তৃপক্ষ দেখেন না? বাসগুলোতে আটার বস্তার মতো ভরে যাত্রী বহন করে! দুই পা ফেলার জায়গা থাকে না! সিটিং বলে ভাড়া আদায় করা হয়। সিটিং সার্ভিসে যাত্রীদের দাঁড় করে নেওয়া টাকাগুলো কার পেটে যায়? সিটিং বা গেটলক সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সেটিও তারা মানছেন না। বাসে উঠলেই পুরো পথের ভাড়া নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমরা মনে করি দেশ সবাইকে নিয়ে চলবে। সবার কথা চিন্তা করতে হবে। বাসমালিকরা শিক্ষার্থীদের ছাড় দেবে। যাত্রীরাও গাড়ির স্টাফদের ছাড় দেবে, এটাই নিয়ম।

বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি ও বেসরকারি গণপরিবহণগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শুধু শিক্ষার্থী নয়, বয়স্ক নাগরিকদেরও বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় গণপরিবহণগুলোতে। পরিবহণ বিভাগ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র দেখানোর কথা বলা হয়েছে। তাদের এ দাবির যথাযথ। আমরাও মনে করি ছাত্রদের অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের আইডি সঙ্গে রাখতে হবে। তাহলে ছাত্ররা এ সুযোগ পাবে। অছাত্ররা এ সুবিধা ভোগ করতে পারবে না।

রাস্তার মোড়ে, স্ট্যান্ডে, চেকিং পয়েন্টে চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ায় কোনো ক্ষতি হতো না। চাঁদাবাজি বন্ধ হলে বাসমালিকরা আগের ভাড়াতেই পারবে এটা ওদেরই কথা। আর চাঁদাবাজকে তা দেশের ১৬ কোটি মানুষ চেনে, জানে। শুধু জানেন না সংসদের এমপিরা ও সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী মহোদয়! সংসদে বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা শিক্ষার্থীদের বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবি কার্যকরের দাবি জানিয়ে বলেন, সরকার বলে বেসরকারি গণপরিবহণের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের নেই। কথাটি সঠিক বা সত্য নয়। জবাবে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, 'পরিষ্কারভাবে একটি সত্য কথা বলতে চাই- এখানে অনেক সমস্যা আছে। যখন চেয়ারে বসবেন, অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হবে। একটা চ্যালেঞ্জিং জব। এখানে আমরা কিছু কিছু বিষয় অ্যাডজাস্ট করি।' সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মহান সংসদে দাঁড়িয়ে কার বা কাদের সঙ্গে 'অ্যাডজাস্ট' করার কথা বললেন, তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন, কিন্তু তাকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে, জনগণের জন্যই তিনি সেখানে দাঁড়িয়েছেন? 'অ্যাডজাস্ট' যা করা দরকার, তা কেবল জনগণের সঙ্গেই করতে পারেন, কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা গোষ্ঠীর কাছে নয়।

বাসমালিকদের টার্মিনালে চাঁদা দিতে হয়, সড়কে পুলিশকে টাকা দিতে হয়। এ সব খরচ তো মালিককে তুলতে হবে। নিরীহ যাত্রীদের কাছ থেকেই মালিকরা আদায় করেন এ সব খরচ। অন্যদিকে মালিকরা চান নির্দিষ্ট আয়, এতে তারা কোনো রকম ছাড় দিতে রাজি নয়। মালিকরা চুক্তিতে চালক-সহকারীর কাছে বাস ছেড়ে দেন। পৃথিবীর কোথাও এমন আছে কী?

পরিবহণ ব্যবসায় বকেয়ার কোনো কারবার নেই, ক্যাশ টাকার ব্যবসা, লাভজনক ব্যবসা। কেন জানি এখানে রাজনৈতিক ও আমলাদের আগ্রহ বেশি! সরকারও সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পরিবহণজগৎ একটা বিরাট সিন্ডিকেট। রুট পারমিটের অনুমতি নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। রুট পারমিট যারা দিচ্ছেন, তারা সবসময়ই সরকারি দলের হয়ে থাকেন। পরিবহণ নেতাদের জন্য রুট পারমিট পাওয়া না জানি আকাশের চাঁদ পাওয়া। এরপর থেকে তারা সবচেয়ে সহজ আয় শুরু করেন। ওই পথে পরিবহণ চালাতে গেলে তার ব্যানারেই চালাতে হবে। এ ব্যানারে ঢুকতেই বাসমালিকদের অনেক টাকা গুনতে হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এ কারণেই গণপরিবহণের সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ চিত্র বদলানো না গেলে সরকার, জনগণকে আরও বেশি ভুগতে হবে।

সিটি করপোরেশনের লোকজন কীভাবে গাড়ি চালাচ্ছে, লাইসেন্স আছে কিনা, সেটা দেখার দায়িত্ব যাদের, তারা তা দেখছে না। আসলে শুরুটা বিআরটিএ থেকে। তাদের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগ আছে। এ জন্য দুর্ঘটনা ঘটছে। এখানে আসলে গোড়াতেই গলদ। সরকারকে ভিন্ন কৌশলগতভাবে চিন্তা করতে হবে। সড়কে মৃতু্যর মিছিল বাড়ছে। সরকারকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি বদলাবে না। বর্তমানে আমাদের পুরো পরিবহণ ব্যবস্থাটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ঢাকার দুই মেয়র অনেক প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানকেই সঠিক ব্যবস্থাপনায় চালাতে পারছেন না। একটা শহরকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে হলে আগে তো নিজের প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থায় আনতে হবে। মেয়রের প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবস্থাপনার গলদে একটি মানুষকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হলো, সেটার দায় মেয়র এড়াতে পারেন কী?

রাজধানীতে বেপরোয়া বাস চালানো ও রেষারেষি বন্ধে 'বাস রুট রেশনালাইজেশন' বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে চার বছরের বেশি সময় আগে। 'বাস রুট রেশনালাইজেশন' বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ (বিআরএফ) মডেলটি পুরো বিশ্বের জন্যই মডেল। অযথা সময়ক্ষেপণ করা ছাড়াও এ কার্যক্রম চালুর ক্ষেত্রে জটিলতা কী?

আমরা মনে করি, মোটর শ্রমিকদের বেতন ভাতা নির্ধারণ ও চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। মোটর শ্রমিকদের জিম্মি করে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল করাটা জঘন্যতম জুলুম, যার কারণে সড়ক পথ এখন অভিশপ্ত। মজলুম মোটর শ্রমিকদের সার্বিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হোক। এতে কমে আসবে রাস্তায় রক্তের শ্রোত, থাকবে না কোনো নৈরাজ্য, অন্যথায় যা হওয়ার তাই হবে।

হাফ ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত শুধু ঢাকা শহর নয়, পুরো দেশের জন্যই হওয়া উচিত ছিল। দেশের অন্য অঞ্চলগুলোর ছাত্র-ছাত্রীরা কী অপরাধ করেছেন? এটা রীতিমতো চরম বৈষম্যমূলক, অন্যায্য, অযৌক্তিক ও প্রহসনমূলক ঘোষণা।

আমরা মনে করি বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে সারাদেশে সব গণপরিবহণের ছাত্রছাত্রীদের থেকে হাফ ভাড়া নেওয়া হোক। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য।

মোহাম্মদ আবু নোমান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে