শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও তার প্রভাব

বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সম্পর্কিত মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি ও নিষেধাজ্ঞা দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতির একটি কৌশলের অংশ। চীন যেভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বলয় বিস্তারে সক্ষম হয়েছে- সেখানে একমাত্র ভারত ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বন্ধু রাষ্ট্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তাদের এক ধরনের স্বার্থরক্ষার নিয়ামক। বাংলাদেশ তার পরিপক্ব কূটনৈতিক তৎপরতা ও কৌশলী দেন-দরবারের মাধ্যমে অচিরেই এ নিষেধাজ্ঞা থেকে উত্তোরণ ঘটাতে সক্ষম হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ১০ মে ২০২২, ০০:০০

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাসহ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটিকে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তনের পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক স্বার্থে বাইডেন প্রশাসনের কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও দেখা হচ্ছে। নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা এবং বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে অতীতে সেভাবে সোচ্চার না হলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন কেন সোচ্চার সেটি নিয়েও আছে কৌতূহল। সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের এক প্রকার টানাপোড়েন হিসেবেই দেখছেন অনেকে। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় এসে কিন্তু তাদের নীতির আপাতদৃষ্টিতে আমরা বলতে পারি একটা পরিবর্তন করছে। পরিবর্তনটা কীভাবে যে তারা গণতন্ত্রকে সংগঠিত করবে। এখানে আমরা আপাতদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু ব্যাপারে তারা অখুশী এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হিসেবে দেখা না হলেও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের একটা ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। দুটো জিনিসকে তারা প্রধান বা কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করছেন। তার একটা হচ্ছে- যে মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের প্রশ্ন। যেটা তাদের পররাষ্ট্রনীতির অংশ আর দ্বিতীয় যেটা হচ্ছে- যে বাইডেন প্রশাসন গোড়া থেকেই এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নজর দিয়েছেন ভূরাজনৈতিক স্বার্থে। উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাছেই মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর এগুলো চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে দীর্ঘমেয়াদে এসব জায়গায় চীনের পরিবর্তে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হোক। এটা সত্যিই একটা দীর্ঘমেয়াদি খেলা। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশকে গুরত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রর্ যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের অভিযোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রই এ ধরনের অভিযোগ করেছে বা এই প্রথম অভিযোগ করেছে তা নয়। বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে প্রতি বছরই উলেস্নখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রই এককভাবে এমন করেছে তা নয়, গত এক দশকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বহুবার বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। এ বছরের জুলাই মাসে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনেও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলেই বলা হয়েছে। ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের এসব অভিযোগের ভিত্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক এবং দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিয়মিত প্রতিবেদন। আসলে প্রতিদিনের খবরেই তা দেখা যায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল অন্তত এক দশক ধরেই বলে আসছে এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যথেষ্ট উদাহরণ হাজির করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র চায়। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন যেন সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ সুষ্ঠু হয়, সেটির ব্যাপারে তাদের আগ্রহ রয়েছে। তবে নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, কীভাবে হবে এটি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা চায় যে, সব রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আগ্রহের জায়গা হলো বাংলাদেশের মানবাধিকার সুরক্ষা রাখা। মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ৭ জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এবং এই নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ারের ঘটনা বন্ধ হওয়ায় তারা ইতিবাচক ফল পাচ্ছে বলেও মনে করেন। বাংলাদেশের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা দেখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন সময় যে নির্যাতনের অভিযোগগুলো উঠেছে সেই অভিযোগগুলোর ব্যাপারে রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপ, তদন্ত এবং নির্মোহ ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখতে হবে এবং যে কোনো মূল্যে এটাকে এগিয়ে নিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কোন অবস্থাতে উগ্রবাদ, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের মতো দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক ধারার উত্থান ঘটুক এটি চায় না। এটি বন্ধের জন্য তারা বাংলাদেশকে বিভিন্ন রকমের সহযোগিতা করতেও আগ্রহী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটি বিষয় হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম। এই জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সংশোধন করা দরকার, পারলে এটাকে বাতিল করা দরকার।

নিজ স্বার্থ রক্ষায় মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে ব্যবহার চিরায়ত মার্কিন কৌশল। এমনকি শেষ পর্যন্ত সামরিক আগ্রাসন করতেও তারা সিদ্ধহস্ত। আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা পৃথিবীর সব কৌশলগত পরিকল্পনাকে নতুন করে সাজাতে হচ্ছে। আর এখানটাতেই মার্কিন নীতি গত দুই দশকে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুদ্ধনীতি আর নির্লজ্জ ইসরায়েল প্রীতির সঙ্গে আফগানিস্তানে অপমানজনক পলায়ন তার ভাবমূর্তি এবং সামর্থ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনলেও যুক্তরাষ্ট্র উচ্চবাচ্য করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ মনে হয় জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুণ্ন্ন রেখে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে কূটনৈতিকভাবে নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলা করবে। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য আমাদের এই ধারণাকে সমর্থন করে। হয়তো, কূটনৈতিক পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ দেখা যাবে। কোনো লবিস্ট নিয়োগ দেয়া হবে- যা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে ওঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, চীনের ওপর অবকাঠামো উন্নয়নে নির্ভরশীলতা আর আঞ্চলিক কারণে বিশেষত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ভালো সম্পর্ক এই নিষেধাজ্ঞা আর বেশি দূর নিতে দেবে না বলে আমাদের বিশ্বাস। তবে এ মহূর্তে সহসা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ওঠে যাবে সেটা মনে করা যাবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরো বেশি পরিপক্ব কূটনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার উত্তোরণ ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি। এ উপলক্ষে ওয়াশিংটনে উড়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন। সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলস্নংকেনের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন এবং দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। দুই দেশই আশা প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো নতুন উচ্চতায় যাবে এবং সমৃদ্ধির নতুন দুয়ার স্পর্শ করবে। দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এক চিঠি লিখেছেন। এই চিঠিতেও দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং দুই দেশের সম্পর্ক এখন অনেক সমৃদ্ধ বলেও উলেস্নখ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টানাপোড়েনের কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর্ যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি বা মানবাধিকার বিষয়গুলো নিয়ে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করেনি। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা ইতিবাচক। তবে বিস্নংকেন- মোমেন বৈঠকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয় সামনে এসেছে। তার মধ্যে একটি হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনটির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নেতিবাচক মনোভাব আরো স্পষ্ট করেছে। এই আইনটি যদি বাতিলও না করা হয়, শেষ পর্যন্ত এই আইনের যে সমস্ত নেতিবাচক দিকগুলো রয়েছে তা যেন বন্ধ করা হয়. সেটির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কথা বলেছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়টি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। তৃতীয়ত, সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন রকম নিপীড়নের যে অভিযোগগুলো এসেছে সেগুলো যেন যথাযথ তদন্ত হয় এবং এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সে ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। আর এই সমস্ত বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন।

বিশ্বের অর্থনীতির ভরকেন্দ্র এশিয়ায় সরে আসা, চীনের উত্থান, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা, এ অঞ্চলে ভারতের আবেদন হ্রাস, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবই বাংলাদেশকে মার্কিন প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক জোট কোয়াডে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা, চীনের প্রভাব বলয় থেকে বের করে আনা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করা ইত্যাদি কারণে ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশকে এশিয়ায় তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পেতে চেয়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারের ফোন এবং অক্টোবরে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের সফরে তা স্পষ্ট ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া পায়নি বলেই মনে হয়েছে। তদুপরি গত কয়েক বছরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তিকর বলে বিবেচিত হয়নি। জর্জ ডবিস্নউ বুশের আমল থেকে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়া নীতিতে ভারতকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। পাকিস্তান ছাড়া অন্য দেশগুলোর ওপরে ভারতের আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে টানাপোড়েন হলেও গত এক দশকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কার্যক্রমে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সহযোগিতা ২০১৬ সালের পরে আরও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের একটি বড় বাজার। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে এবং একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কোভিডের টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের সাহায্য করেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রশংসা করেই যুক্তরাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করেনি, সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। এ ধরনের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ অনেককেই বিস্মিত করেছে।

এ পটভূমি বিবেচনা করলে মনে হতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ এক ধরনের প্রতীকী। ইতোমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নংঙ্কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে ফোন করার কারণে এ ধারণা আরও জোরদার হওয়ার অবকাশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, প্রতিষ্ঠান হিসেবের্ যাবকে তালিকাভুক্ত করার সময় যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয় বিবেচনা করেছে যে, একে বাংলাদেশ সরকার কতটা গুরুত্ব দেয়। যুক্তরাষ্ট্র একে একটি মাত্র পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে, নাকি এরপরে আরও পদক্ষেপ নেবে, তার ওপরে নির্ভর করবে সম্পর্কের গতিপথ কী হবে। এ নিষেধাজ্ঞার কিছু খুঁটিনাটি দিক এখনো অস্পষ্ট। উদাহরণ হিসেবে উলেস্নখ করা যায় যে, বাংলাদেশের যেসব প্রতিষ্ঠানর্ যাব কিংবা নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন করবে, তাদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ও লেনদেনের বিষয় কীভাবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশেই চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ নাকি প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য থেকে শুরু করে অস্ত্র সরঞ্জাম অনেক কিছুই বাংলাদেশ চীন নির্ভরতা রয়েছে। এখন বাংলাদেশ যদি চীনের প্রভাব বলয়ে চলে যায় তাহলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো মিত্রই অবশিষ্ট থাকে না। এসব বিবেচনায় মনে হতে পারে চীনের প্রভাব বলয় থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবের্ যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ যা যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলমাত্র।

বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সম্পর্কিত মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি ও নিষেধাজ্ঞা দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতির একটি কৌশলের অংশ। চীন যেভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বলয় বিস্তারে সক্ষম হয়েছে- সেখানে একমাত্র ভারত ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বন্ধু রাষ্ট্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তাদের এক ধরনের স্বার্থরক্ষার নিয়ামক। বাংলাদেশ তার পরিপক্ব কূটনৈতিক তৎপরতা ও কৌশলী দেন-দরবারের মাধ্যমে অচিরেই এ নিষেধাজ্ঞা থেকে উত্তোরণ ঘটাতে সক্ষম হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, কলামিস্ট ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে