সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বৃদ্ধাশ্রম ও আমাদের বাবা-মা

পাঠক মত

নতুনধারা
  ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

মানবসমাজে সভ্যতার গতি যত বেগবান হচ্ছে তত কমে যাচ্ছে আবেগ, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মানবিকতা, কৃতজ্ঞতার মতো মানব হৃদয়ের কোমল স্বত্বাগুলো। ফলে ক্রমান্বয়ে আমরা হৃদয়হীন পশুতে পরিণত হচ্ছি। একটি শিশুর জীবনের প্রথম প্রভাতে যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তিনি হচ্ছেন মা। জীবনের পরম আদরগুলো মায়ের কাছেই পেয়ে থাকেন। সেইসঙ্গে বাবার খাটুনি করা শেষে ঘাম ভেজা শরীরে জড়িয়ে ধরা, চুমু দেওয়ার মতো ঐশ্বরিক সুখ পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বাবা-মার মায়া-মমতা স্নেহ-ভালোবাসায় ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি শিশু। সন্তানের প্রতি তাদের স্নেহ অকৃত্রিম এবং অতুলনীয়। বাবা-মার মিলিত আত্মত্যাগ, পরিশ্রম ও স্নেহে লালিত-পালিত শিশু ক্রমে পা বাড়ায় আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং একদিন এই বাবা-মার কাঁধে ভর করে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়ও। বড় দুঃখের বিষয়, পরিতাপের বিষয় এই শিশু যখন বড় হয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ায় এবং নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় তখন সে ভুলে যায় তার বৃদ্ধ বাবা-মার সেই আত্মত্যাগ, কষ্ট, পরিশ্রমের চিরন্তনি লড়াইকে। এই সন্তানের কাছেই তখন তার বৃদ্ধ বাবা-মা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় নতুন একটি দরজা। যেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মাসে মাসে, সেই বৃদ্ধাশ্রমে কিছু টাকা পাঠিয়ে কৃতজ্ঞতার পবিত্র দায় পালন করে এই হৃদয়হীন আধুনিক প্রজন্ম। কখনো খোঁজও নেয় না, বাবা-মা কেমন আছেন! স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া, মমতা এই সবকিছুর বিনিময় তখন শুধু অবহেলা। এই কৃতজ্ঞতাহীন হৃদয়হত্যার কাহিনী আমাদের জন্য সত্যিই বড় লজ্জার এবং দুর্ভাগ্যের। যে বাবা-মা নিজেদের রক্তকে পানি করে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে নিজে না খেয়ে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করলেন, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অবজ্ঞা, অবহেলা-ই কি তাদের পাওনা ছিল? এটাই কি তাদের উপযুক্ত প্রতিদান? একটু ভালোবাসা, যত্ন, সুখ চাওয়া কি তাদের অন্যায়? বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বিশ্বজুড়েই বেড়েছে প্রবীণ নাগরিক সংখ্যা। বর্তমান সময়ে পরিবর্ধিত সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাড়িতে ছেলের বউ কিংবা ছেলের সঙ্গে বনিবনার অভাবে তারা একই বাড়িতে থাকতে পারছেন না। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে পরিচালন সমিতির অত্যাচারও চরম। এই অমানবিক অবস্থায় বর্তমানে বৃদ্ধ বাবা-মাদের অবস্থা করুণ। তাদের প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হচ্ছে নরকযন্ত্রণা। আর্থিক, শারীরিক ও সামাজিক দিক দিয়ে দুর্বল ও শক্তিহীন এই মানুষের অসহনীয় দুর্দশা দেখে কেন নিশ্চুপ নিরুত্তর এই বর্তমান প্রজন্ম সেটাও আমার বোধগম্য নয়। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বৃদ্ধ বাবা-মার প্রত্যাশা খুব বেশি কিছু নয়। দু'বেলা দু'মুঠো খাবার, একটু আশ্রয়, চিকিৎসা যত্ন আর বেশি করে ভালোবাসা। এই সহমর্মিতা, সহৃদয়তা কি দেখানো যায় না? ভুলে গেলে চলবে না, তারা আমাদের একান্ত আপনজন, আমাদের জন্মদাতা-জন্মদাত্রী, আমাদের বাবা-মা। তারা আমাদের লালন-পালন করে মানুষের মতো মানুষ না করলে আজ আমরা কোথায় থাকতাম? একবার কি ভেবে দেখেছেন? আধুনিক জীবনভাবনার আত্মঘাতী আগুন কিন্তু একদিন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেবে আমাদের হৃদয়হীন এই অমানবিকতাকে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বোঝা নয়, বরং সম্মান-সম্ভ্রমের অফুরন্ত উৎস। তাদের অভিজ্ঞতার ওপর যদি আমরা আরও বেশি করে আস্থা রাখতে পারি, তাহলে অনেক উপকৃত হবো, লাভবান হবো। যে মানুষজন জীবনের সোনালি সময়টা সন্তানদের সফল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য আত্মবলিদান দেন তাদের আমরা যেন একটু ভালোবাসা, যত্ন, শান্তি দিতে পারি, এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। পোশাকে আধুনিকতা আসে না, আসে ভাবনা মন ও মননে। আমাদের মন ও মনন সেই অঙ্গীকারের শুদ্ধতায় উজ্জ্বল হোক এটাই কামনা করি।

আজহার মাহমুদ

চট্টগ্রাম

নতুন বছরে বন্ধ হোক 'বডি শেমিং'

অন্যের দৈহিক আকার, বর্ণ, সাজসজ্জা, অঙ্গের তথাকথিত ত্রম্নটি-বিচু্যতি, হ্রাস-বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে তাকে দু'চার কথা শুনিয়ে চুপিচুপি আত্মশ্লাঘা অনুভব করা, ঠাট্টার ছলে হুল ফোটানোর এই বদভ্যাসের নামই বডি শেমিং। বডি শেমিং একটি মারাত্মক অপরাধ। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই অপরাধটি শুরু হয় খুব কাছের মানুষদের দ্বারা। হাসতে হাসতেই বলে দেয় 'তুমি কোন গোডাউনের চাল খাও?' অথবা এটাও বলি 'দিন দিন হাতি হয়ে যাচ্ছো কেন?' এই হাসতে হাসতে বলা কথাগুলোও অপরাধ। আপনি একজনকে মানসিকভাবে আঘাত করছেন মানে আপনার পরবর্তী প্রজন্মকেও আত্মবিশ্বাসহীনতায় ঠেলে দিচ্ছেন। আমরা যখন কাউকে শারীরিক গঠন নিয়ে মন্তব্য করি কিংবা উপদেশ দিই ওই ব্যক্তি তখন হাসিমুখে কিছু একটা বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে অথবা চুপ থাকে। কিন্তু আপনি এটি বুঝতে পারবেন যখন আপনিও এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে কাউকে হেয় করে কথা বলা উচিত নয়। অনেক দিন পর কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে আমরা অনেকেই প্রথম প্রশ্ন করি এত শুকনা কেন, বা কি খেয়ে এত মোটা হয়েছো? কাউকে কখনোই বডি শেমিং করতে যাবেন না। কালো, মোটা, চিকন, অসুস্থ, বেটে এসব কথাগুলো হয়তো আপনার কাছে স্বাভাবিক একটা শব্দ মাত্র। কিন্তু তার বুকে যে এই কথাগুলো তীরের মতো বেঁধে, কতটা কষ্ট পায় তা বোঝার ক্ষমতা হয়তো তখন আপনার নেই। নিজের কাছের মানুষই যখন এইসব ব্যাপার নিয়ে আলাদা করে দেখে তখন ব্যাপারটা আরও বেশি কষ্টকর হয়ে পড়ে সে মানুষটির জন্য। অনলাইনে, অফলাইনে কেউ কাউকে বুলিং, হয়রানি কিংবা ছোট করবেন না। লম্বা, খাটো, মোটা, চিকন এক কথায় বডি শেমিং করবেন না। মানসিকভাবে মানুষ একটু দুর্বল হলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। অনলাইনে ব্যাপারটা মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে গেছে। অতিরিক্ত বডি শেমিং-এর জন্য অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত মানসিক অসুস্থ এক সময় অবসাদে রূপ নেয়। বডি শেমিংয়ের কারণে অনেকের পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার দেখা দিতে পারে। সম্প্রতি এই ধরনের বুলিং, বাজে মন্তব্যের জন্য অনেক তরুণ-তরুণীকে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ, বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। যা সত্যি বেদনাদায়ক। সঠিক কাজ করা পৃথিবীতে কোনো দিনও সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরেও যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের লোকসান করে হলেও সঠিক পথটি বেছে নিয়েছেন বলেই আজকে আমি, আপনারা সবাই এত দূরে এসেছি। এবারে আমাদের অন্যকে পথ দেখানোর পালা। নতুন বছরের শুরুতে আমরা নিজের সঙ্গেই অনেক ধরনের কমিটমেন্ট করি। যেমন ভালো কাজ করার, ওজন কমানো বা কোনো কিছু অর্জনের। এই অনেক কিছুর সঙ্গে আসুন আরও একটা বিষয় যোগ করি তা হচ্ছে বডি শেমিং না করা। মানুষ বৈচিত্র্যময়, ব্যক্তিগত পছন্দের কোনো মাপকাঠি নেই। খুব সহজেই বলে ফেলা যায়, তুমি তো সুন্দর না। কিন্তু খুব সহজে কি একজন সুন্দর মনের মানুষ হওয়া যায়? কারও সামনে বা পেছনে তার শারীরিক গঠন নিয়ে সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকুন। শরীর খুব ক্ষণস্থায়ী একটি অস্তিত্ব। একজন মানুষের মানসিকতাকে গুরুত্ব দিন। একটি সুন্দর মন পাল্টে দিতে পারে একটি সমাজ। মানুষের মন ভালো করার কাজ যদি অনেক শ্রমসাপেক্ষ ও কষ্টকর মনে হয়, তাহলে সহজ কাজটিই করুন- দয়া করে কারও মন খারাপ করিয়ে দেবেন না।

সাকিবুল ইসলাম

শিক্ষার্থী,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে