রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

জাঁতাকলে চব্বিশ বছর

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সমগ্র বিশ্বের অধিকার সচেতন মানুষের হৃদয়ভরা শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে, অত্যাচারী বর্বর পাক সেনাদের মর্মান্তিক পরিণতি ঘটিয়ে জন্ম নিল একটি নতুন রাষ্ট্র। নাম হলো তার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। অবসান ঘটলো স্বার্থপর, শোষক, অত্যাচারী পাক স্বৈরশাসকের দীর্ঘ চব্বিশ বছরের কুশাসনের। শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতি মুক্তি পেল দীর্ঘ চব্বিশ বছরের জাঁতাকলের যন্ত্রণাময় নিষ্পেষণ থেকে।
আ. শ. ম. বাবর আলী
  ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
জাঁতাকলে চব্বিশ বছর
জাঁতাকলে চব্বিশ বছর

উনিশশ' সাতচলিস্নশের চৌদ্দই আগস্ট দেশভাগের মাত্র কয়েক মাস পর আটচলিস্নশের মার্চে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক জনসভাতে স্বৈরতান্ত্রিক কণ্ঠে সদর্পে ঘোষণা করলেন, 'উর্দুই হবে এ দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।'

সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল বিশাল জনসমুদ্র। যে দেশ ৩২টি ভাষাভাষীর জন্মভূমি এবং তার শতকরা ৫৬ জন কথা বলে বাংলায়, ৫ জন মাত্র উর্দুতে, সেই শাহানশাহ বাংলাকে পদাঘাত করে সিংহাসনে বসে পদসঞ্চালন করবে পথের একটা অখ্যাত ভিক্ষাজীবী ভাষা উর্দু। এত বড় অন্যায় আর অসম্মান কোনো আত্মসচেতন জাতি মেনে নিতে পারে না। তাই জনসভার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ রোষে তীব্রভাবে ফেটে পড়ল তিনটি বজ্রকঠিন সমধ্বনি- 'না না না।'

তারপর থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আত্মসচেতন বাঙালিরাও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করল সে ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্য। তাই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালিরা সমূলে বিনাশ করে দিল সে ষড়যন্ত্রকে। জীবনের বিনিময়ে সিংহাসনে আসীন করল প্রাণের ভাষা বাংলাকে।

এটা তো গেল ভাষার দিক। অর্থনৈতিক অঙ্গনেও ষড়যন্ত্র। ঊষর মরু পশ্চিমা ভূমি। আর ধানের দেশ, গানের দেশ, পলাশ ডাকা, কোকিল ডাকা সোনার দেশ বাংলা। কিন্তু কুচক্রী শাসকের কুটিল চক্রান্তে শুরু হলো শ্যামল আর ধানের দেশ, গানের দেশ হতে থাকল বিরান মুলস্নুক। পশ্চিমে বাড়তি ফসল ফলানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হলো গোলাম মোহাম্মদ বাঁধসহ আরও কত প্রকল্প। অপরদিকে, পূর্বের মানুষের জীবনরক্ষার জন্য সর্বগ্রাসী বন্যার পানিকে রোধ করবার কোনো প্রচেষ্টাই নেওয়া হলো না। এখানকার বাৎসরিক দুর্যোগ বন্যাকে ঘোষণা করা হলো 'আলস্নাহর মর্জি' বলে। তার ওপরও এখানকার সম্পদকে লুট করে নিয়ে যাওয়া হতে থাকল ওখানে। এখানকার মানুষকে অভুক্ত রেখে চলতে থাকল ওখানকার মানুষের বিলাস-প্রমোদ। উন্নয়ন খাতে যেসব বৈদেশিক সাহায্য আসতে থাকল, তা পরিশোধের গুরুদায়িত্ব এ অঞ্চলের লোকের ওপরে পড়লেও তার শতকরা ৭০ ভাগ ব্যয় হতে থাকল ওখানকার উন্নয়নে।

বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রই ছিল এসব বঞ্চনার মূলে। বাঙালিরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই যখনই রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করতে গিয়েছে, তখনই ষড়যন্ত্র করে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও তারা ক্ষমতা পেল না। ষড়যন্ত্র করল তারা ব্যক্তিগতভাবে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান আর তখনকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে। তাদেরসহ সব দেশপ্রেমিক বাঙালি নেতাকে নিশ্চুপ করে রাখার জন্য ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পশ্চিমা শোষক আইয়ুব খানের নেতৃতে সারাদেশে জারি করা হলো সামরিক শাসন। ওই মাসের ২৭ তারিখে তিনিই হলেন দেশের স্বঘোষিত শাসক।

কিছুদিনের মধ্যে বাংলার জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতাদের বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো।

চলল এমনি করে। চলতে থাকল প্রায় একটা যুগ। এ দীর্ঘ সময়টা বাঙালিদের জন্য একটা চরম অভিশাপের সময়। এই একটি যুগে পাকিস্তানি শাসকের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে তিলে তিলে নিঃশেষ হতে থাকল পাকিস্তানের সর্বমোট ১২ কোটি জনতার সংখ্যাগুরু ৭ কোটি অধিবাসী। সেই ষড়যন্ত্রের ধনন্তরী দাওয়াইয়ের বদৌলতে পশ্চিমাদের তিন তলা প্রাসাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকল। অপরদিকে, পূর্বের দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক আর তাঁতির ছোট দোচালা ঘরের খুঁটি হতে থাকল নড়বড়ে। রবীন্দ্রনাথসহ শ্রেষ্ঠ রচনা চর্চাকে দেশদ্রোহিতা ঘোষণা এবং বাঙালিদের বিভিন্ন জাতীয় সংস্কৃতিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদীর পাপ স্বাক্ষর ঘোষণা করে বাঙালিদের কৃষ্টি ও সাহিত্যকে তারা সমূলে ধ্বংস করতে তৎপর হয়ে উঠল।

কিন্তু আঘাতের পর আঘাত খেয়ে আরও মজবুত হয়ে উঠতে লাগল এ দেশের সাত কোটি সূর্যসৈনিকের শপথদীপ্ত আত্মসচেতন হৃদয়। বিক্ষুব্ধ হতে থাকল তা অন্তরে অন্তরে। আর সে বিক্ষোভ একদিন প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়ল ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে। বাঙালিদের আত্মোপলব্ধির সেই দুর্দমনীয় আন্দোলনের কাছে পরাজয় মানতে বাধ্য হলো একনায়কতন্ত্রী আইয়ুব সরকার। অনেক চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে সক্ষম হলেন না তিনি। তাই ওই বছরের ২৫ মার্চে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন।

কিন্তু শুরু হলো ষড়যন্ত্রের আর এক অধ্যায়। ক্ষমতার নতুন কর্ণধার জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে তার প্রথম বেতার ভাষণেই গদগদ কণ্ঠে বাঙালির প্রতি তার দরদের কথা প্রচার করলেন। প্রচার করলেন ক্ষমতার প্রতি তার বিতৃষ্ণা এবং অনীহার কথা। বাঙালিদের দুর্দশায় তিনি রুদ্ধগলায় কাঁদলেন খুব এক চোট।

কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকল তার আসল চেহারা। চব্বিশ বছরের প্রতিটি পাকশাসন থেকে তিনি বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন না। তার বাঙালিবিদ্বেষী রূপ প্রকাশ পেতে থাকে। নিজের ক্ষমতার সুষ্ঠু সংরক্ষণে নিজেকে তিনি সর্বতোভাবে নিয়োগ করলেন। তাই ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে তার দেওয়া পূর্বপ্রতিশ্রম্নতির কথা বেমালুম ভুলে যেতে তিনি তৎপর হয়ে ওঠলেন। তার শুভাকাঙ্ক্ষী ভবিষ্যৎদ্রষ্টা অনুচররা এ ব্যাপারে তাকে সতর্ক করল, ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে গড়িমসি করলে তারও পরিণতি তার পূর্বসূরি আইয়ূবের মতো হতে পারে। অনুচরেরা তাকে এই বলে সাহস জোগালো, নির্বাচনের রায় (তাদের ভাষায়) 'ভেতো বাঙালিদের পক্ষে যাতে না যেতে পারে, তার সুষ্ঠু ব্যবস্থা তারা করে রেখেছে।

জেনারেল ইয়াহিয়া তাদের যুক্তিতে আস্থা রেখে ১৯৭০ সালের অক্টোবরে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেন।

কিন্তু অনুচররা গোপনে তাকে বুঝালো, সারাদেশে তাদের প্রস্তুতি এখনো শেষ হয়নি। এরজন্য আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন। তাদের সে অনুরোধে বাজে অজুহাত দেখিয়ে ইয়াহিয়া খান ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে নিয়ে গেলেন। বস্তুত এটা ছিল তাদের একটা ষড়যন্ত্র। তারা ভেবেছিল, এর ফলে দেশের মধ্যে একটা গোলযোগ, মারামারি, কাটাকাটির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে যাবে। তখন তার অজুহাতে নির্বাচনকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বানচাল করে দেওয়া সম্ভব হবে। কারণ বাইরে তারা যা-ই বলুক না কেন, মনে মনে আশঙ্কিত হচ্ছিল, এবারের নির্বাচনের রায় তাদের অনুকূলে নাও আসতে পারে।

ক্ষমতাসীন পাক সরকারের সেই ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে সমগ্র বাঙালি জাতি প্রশংসনীয় ধৈর্যের সঙ্গে ৭ ডিসিম্বরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।

অনেক প্রত্যাশার পর এলো সেই সোনার হরিণের দিনটি। কুচক্রী পশ্চিমা শাসকের শঙ্কাকে বাস্তবে পরিণত করে বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হলো।

চোখে অন্ধকার দেখল ক্ষমতাসীন কুচক্রী সরকার। তাদের দীর্ঘ চব্বিশ বছরের শোষণের অবসান হতে চলেছে দেখে তারা প্রমাদ গুনল। তাই নানারকমের টালবাহানা করে জনগণের রায়কে বানচাল করতে তারা সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করল। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই উত্তাল হয়ে উঠল এ দেশের জনগণ। বিক্ষোভে ফেটে পড়ল তারা। এক চরম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো তদানীন্তন সারা পূর্ব পাকিস্তানে। কোনোভাবেই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারছিল না ক্ষমতাশীল সরকার।

শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গোটা বাঙালি জাতিকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করলেন। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য নেতা হলেন বন্দি। নির্বাচন বিজয়ী দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হলো। নির্বিচারে কামান-গোলা-মেসিন গান চালিয়ে গোটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইল তারা।

কিন্তু দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে অনেক ঘা খেয়ে, অনেক সহ্য করে বাঙালিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেছে। এখন আর তাদের প্রাণের মায়া নেই। তাই প্রাপ্য অধিকারকে বুঝে নিতে তারা বুকের রক্তের চেয়ে মূল্যবান দায়িত্ব বলে মনে করল। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় তারাও হাতে তুলে নিল হাতিয়ার। পাক সেনারা বাংলাদেশে গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর জ্বালিয়ে ছারখার করে দিতে থাকল। হাটবাজার থেকে শুরু করে নগর-গঞ্জ পর্যন্ত করে দিল নিঃশেষ। ভস্মীভূত করে দিল ক্ষেতের ফসল। এ দেশের এক কোটি লোককে করল দেশছাড়া। ৩০ লাখ বাঙালিকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করল। সতীত্ব নষ্ট করল আড়াই লাখ সতীপ্রাণা মা-বোনের।

কিন্তু তাদের অত্যাচারের নৃশংসতা যত বাড়তে থাকল, বাঙালি মুক্তিসেনাদের শক্তিসামর্থ্য আর সাহস বাড়তে থাকল তত।

অবশেষে পাক সেনারা যখন দেখল, অস্ত্রবলে বাঙালিদের আর দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, তখন ফরাসি মনীষী ভল্টেয়ারের 'যদি কোনো দেশকে তোমার ধ্বংস করার ইচ্ছা থাকে, তবে সে দেশের সব জ্ঞানীজনকে হত্যা কর, তোমার উদ্দেশ্য সহজে সিদ্ধ হবে'- এই উক্তিটি তারা স্মরণ করল। এ দেশের গোটা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে হত্যার জন্য তারা নতুন প্রচেষ্টা গ্রহণ করল এবং তা কার্যকর শুরুকরণের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ দেশের সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গায়ক, নাট্যকার, অভিনেতা, চিকিৎসক, আইনজীবী প্রমুখ ৩৪০ জন বুদ্ধিজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করল।

কিন্তু তাতেও তাদের শেষ রক্ষা হলো না।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সমগ্র বিশ্বের অধিকার সচেতন মানুষের হৃদয়ভরা শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে, অত্যাচারী বর্বর পাক সেনাদের মর্মান্তিক পরিণতি ঘটিয়ে জন্ম নিল একটি নতুন রাষ্ট্র। নাম হলো তার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। অবসান ঘটলো স্বার্থপর, শোষক, অত্যাচারী পাক স্বৈরশাসকের দীর্ঘ চব্বিশ বছরের কুশাসনের। শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতি মুক্তি পেল দীর্ঘ চব্বিশ বছরের জাঁতাকলের যন্ত্রণাময় নিষ্পেষণ থেকে।

আ. শ. ম. বাবর আলী : কবি, প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে