এইডস বা অ্যাকুয়ার্ড ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি সিনড্রোম হচ্ছে এইচআইভি বা হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট একটি রোগের লক্ষণ সমষ্টি- যা মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস করে। এর ফলে, একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে- যা শেষ পর্যন্ত তার মৃতু্য ঘটাতে পারে। এইচআইভি সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই সর্বদা এইডস হয় না। শুরুতে ক্ষেত্রবিশেষে ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
এরপর বহুদিন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র দুর্বল হতে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ সংক্রামক ব্যাধি, উদাহরণস্বরূপ যক্ষ্ণায় যেমন আক্রান্ত হতে পারেন, তেমনই সুযোগসন্ধানী সংক্রামক ব্যাধি এবং টিউমারের শিকার হতে পারেন, যেগুলো কেবল সেসব লোকেরই হয়, যাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ করে না। এইচআইভি সংক্রমণের এই পর্যায়টিকেই এইডস বলা হয়। এই পর্যায়ে প্রায়শই রোগীর অনিচ্ছাকৃতভাবে ও অত্যধিক পরিমাণে ওজন হ্রাস পায়।
যেহেতু একবার সংক্রামক এইচআইভি শরীরে ঢুকলে তাকে পুরোপুরি দূর করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, তাই এইচআইভি সংক্রমণ হলে এইডস প্রায় অনিবার্য। বিশ্ব এইডস দিবস ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে। এইচআইভি সংক্রমণের জন্য এইডস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এই দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে। সরকারি ও স্বাস্থ্য আধিকারিকরা, বেসরকারি সংস্থা এবং বিশ্বে বিভিন্ন ব্যক্তি এইডস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সবাইকে সচেতন করতে এই দিনটি পালন করে।
বিশ্ব এইডস দিবস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা চিহ্নিত বিশ্ব জনস্বাস্থ্য সচেতনতার উদ্দেশ্যে ঘোষিত আটটি বিশেষ দিনের মধ্যে একটি। ২০২২-এর হিসাব অনুযায়ী, এইডসের জন্য বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে এবং আনুমানিক ৩৯ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি হয়ে বেঁচে আছে। এর ফলে এটি নথিভুক্ত ইতিহাস অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম জনস্বাস্থ্য বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে উন্নত অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল চিকিৎসা পৌঁছোনোর ফলে এইডস মহামারি থেকে মৃতু্যর হার কমেছে। বেশির ভাগ এইডস আক্রান্ত রোগীই সাহারা-নিম্ন আফ্রিকাতে বাস করে।
এইডসকে বর্তমানে একটি মহামারি ব্যাধি হিসেবে গণ্য করা হয়- যা বিশ্বের বিশাল এক আয়তন জুড়ে বিদ্যমান- যা সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এইচআইভি ভাইরাসটি ১৯শ শতকের শেষভাগে বা ২০শ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিম-মধ্য আফ্রিকাতে উৎপত্তি লাভ করে। ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি সর্বপ্রথম রোগটি শনাক্ত করে এবং তার পরে ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকে এই রোগের কারণ হিসেবে এইচআইভি ভাইরাসকে শনাক্ত করা হয়। সিডিসির ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে এইচআইভি আক্রান্তের ৭০ শতাংশই সমকামী এবং উভকামী পুরুষ।
এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে বা তার ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বা সুঁই ব্যবহার করলে সেই ব্যক্তি এইডস রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের শিশুরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- যা গর্ভধারণের শেষদিকে বা প্রসবের সময় হতে পারে। তবে ওষুধ ব্যবহার করে এই সম্ভাবনা কিছুটা কমিয়ে আনা যায় এবং তা করলে মায়ের বুকের দুধও বাচ্চাকে দেওয়া যেতে পারে কারণ মায়ের বুকের দুধ না পেলে গরিব ঘরে জন্মানো বাচ্চার মৃতু্যসম্ভাবনা আরো বেশি। এছাড়া, এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত কারো সঙ্গে কনডম ব্যবহার না করে অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে ওই ব্যক্তি এইডস রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
আসলে দেহজাত অধিকাংশ তরল ক্ষরণে এইচআইভি নিষ্কৃত হয়। তবে স্নেহ পদার্থের আবরণ থাকায় এইচআইভি অত্যন্ত ভঙ্গুর। তাই এইচআইভি শরীরের বাইরে বেশিক্ষণ বাঁচে না। এই কারণে সরাসরি রক্ত বা যৌন নিঃসরণ শরীরে প্রবেশ না করলে এইচআইভি সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব কম। শুধু স্পর্শ, একসঙ্গে খাওয়া, এমনকি একই জামাকাপড় পরা বা মশার কামড়ে কখনো এইচআইভি ছড়ায় না। তাই এইচআইভি সংক্রমণ ছোঁয়াচে নয়। ১৯৮১ সালে নিউমোসিস্টিন কারিনি এবং কাপোসিস সার্কোমা নামে দুটি বিরল রোগের সংক্রমণ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র তথা সিডিসি সতর্ক হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৯৮৪ সালে ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এই মহামারি রোগের ভাইরাস শনাক্ত করেন।
ফরাসি বৈজ্ঞানিকরা এর নাম দেন লিম্ফাডেনোপ্যাথি-অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস। আর মার্কিনিরা এর নাম দেয় মানব টি-কোষ লসিকাগ্রন্থি-অভিমুখী ভাইরাস। ১৯৮৬ সালে এই ভাইরাসের পুনঃনামকরণ করা হয় এইচআইভি। এইচআইভি ভাইরাস মানুষের শরীরের টি-সহায়ক কোষগুলো আক্রমণ করে যেগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। এইডস এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই কোনো লক্ষণ ছাড়া এই রোগ বহন করে। তবে কখনো কখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ পরে কিছু অনির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে যেমন- জ্বর, গলাব্যাথা, মাথাব্যথা, ফুলে ওঠা লসিকা গ্রন্থি ইত্যাদি। এসব লক্ষণ কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়, যার কারণে রোগী এ ভাইরাস সম্পর্কে অবগত হয় না। এইচআইভি ভাইরাস কোনোরকম লক্ষণ ছাড়াই সর্বোচ্চ ১০ বছর মানুষের শরীরে নীরবে বাস করতে পারে।
এইডস রোগের কোনো চিকিৎসা এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। গবেষকরা এ পর্যন্ত অনেক ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। প্রথম শ্রেণির ওষুধের নাম নিউক্লিওসাইড রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ ইনহিবিটর- যা এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণকে বিলম্বিত করে। দ্বিতীয় শ্রেণির ওষুধের নাম প্রোটিয়েজ ইনহিবিটর- যা এইচআইভি ভাইরাসের পুনর্বৃত্তিতে বাধা সৃষ্টি করে। যেহেতু যে কোনো একটি শ্রেণির ওষুধ এককভাবে শরীরে কার্যকর হয় না, তাই সমন্বিত ওষুধ দেওয়া হয়। এই চর্চাকে বলা হয় হার্ট বা হাইলি অ্যাকটিভ অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি অর্থাৎ অতি সক্রিয় রেট্রোভাইরাস প্রতিরোধী চিকিৎসা। যদিও হার্ট এইডস উপশম করে না তবে এটি এইডস রোগীর মৃতু্যসংখ্যা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এইচআইভি এবং এইডস সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। সবচেয়ে সাধারণ তিনটি ভুল ধারণা হচ্ছে : ১) এইডস স্বাভাবিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে যেতে পারে, ২) কোনো কুমারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এইডস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং ৩) এইচআইভি দ্বারা শুধু সমকামী পুরুষ ও মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারীরা সংক্রমিত হতে পারে। বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা এখনো খুব বেশি নয়, মোট জনসংখ্যার ০.১ শতাংশ। তবে নতুন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার বাড়ছে। যৌনকর্মী ও ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদকসেবীদের মধ্যেই এইচআইভির বিস্তার বেশি ঘটছে। অবশ্য গত পাঁচ বছরে গৃহবধূ ও গর্ভধারিণী নারীদের মধ্যেও এইচআইভির সংক্রমণ বেড়েছে। নারীদের মধ্যে এইচআইভি ছড়িয়ে পড়াকে বৈশ্বিকভাবে মহামারির অশনিসংকেত হিসেবে দেখা হয়।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এইডস শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ৪,০০০ লোকের মধ্যে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশ এইডস মহামারির দ্বারপ্রান্তে উপনীত। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) এবং জাতীয় এইডস নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন মাদকদ্রব্য গ্রহণকারীর মধ্যে অন্তত দুই জন এইচআইভি ভাইরাসের বাহক- যা এইডস রোগ ঘটায়। এছাড়াও প্রতি একশত যৌনকর্মীর মধ্যে অন্তত একজনের এইচআইভি আছে।
এইচআইভির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা কীভাবে গড়ে তোলা যায় এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা না থাকার কারণেই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এছাড়া অপ্রতুল স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং একাধিক মাদকাসক্ত ব্যক্তির একই সুঁই ব্যবহারও এর বড় কারণ। আশঙ্কা করা যাচ্ছে, আফ্রিকান দেশগুলোর মতো এ দেশকেও এইডসের বিস্তৃতি দ্রম্নত গ্রাস করবে, যদি সময়োচিত ও সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে এই প্রবণতা রোধ করা না যায়। বাংলাদেশের ৬৪ জেলায়ই এইডস আক্রান্তরা ছড়িয়ে আছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে এ বিষয়ে নজরদারির সুযোগ সীমিত। লাখ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপে অভিবাসী হয়েছে। তারা সেখানে প্রধানত কায়িক শ্রম দেন। অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ বেশি এবং তা আরও বাড়ছে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
এইচআইভি সংক্রমণের উপায়গুলো জেনে এ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এইডস প্রতিরোধ করা সম্ভব। এইডস প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তা হলো: ১) অন্যের রক্ত গ্রহণ বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আগে রক্তে এইচআইভি আছে কিনা পরীক্ষা করে নেয়া, ২) ইনজেকশন নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবারই নতুন সুচ/সিরিঞ্জ ব্যবহার করা, ৩) অনিরাপদ যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা, ৪) স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারী বা পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের সময় কনডম ব্যবহার করা, ৫) এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত মায়ের সন্তান গ্রহণ বা সন্তানকে বুকের দুধ দেয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া, ৬) কোন যৌন রোগ থাকলে বিলম্ব না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া, ৭) অন্যের ব্যবহার করা বেস্নড ব্যবহার না করা এবং ৮) ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশাসন মেনে চলা।
মো. আরাফাত রহমান : কলাম লেখক