শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২
পাঠক মত

দেশের খাল-বিল ও পুকুরের অস্তিত্ব বিপন্ন

আল আমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
দেশের খাল-বিল ও পুকুরের অস্তিত্ব বিপন্ন

একটা সময় ছিল যখন এই বাংলায় খাল-বিল, নদী-নালা ভরপুর ছিল। প্রতিটা গ্রামে গ্রামে গোসল করার পুকুর ছিল, মাছের আবাসস্থল খাল ছিল, শাপলা ভরা বিল ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই চিত্র দিন দিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে খাল-বিল, পুকুর হ্রাস পাওয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজার। বর্তমানে যার সংখ্যা মাত্র একশ'। ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৪৫ ভাগ। সুতরাং এটা অনুমেয় যে, কী ভয়ংকর হারে কমে যাচ্ছে জলাধারের সংখ্যা। শুধু রাজধানীর এই করুণ অবস্থা, তাহলে সারা দেশের জলাধারের কী অবস্থা এবং কী পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে তা কল্পনাতীত। পুকুর থাকলে সেখানে গোসল করতেন, খাল হলে সেখানে গৃহপালিত পশুর জন্য পানি ব্যবহার করতেন এবং ছোট ছোট খালগুলোতে ময়লা-আবর্জনা রাখার ব্যবস্থা করা হতো। সবচেয়ে জরুরি যে কাজটা হতো সেটা হচ্ছে বৃষ্টির পানি এসব খাল-বিল ও পুকুরগুলোতে জমা থাকতে পারত। এতে করে পাড়া বা গ্রামে বৃষ্টির সময়ও পানি জমত না। কিন্তু বর্তমানে জলাধারের সংখ্যা হ্রাসের কারণে উপরোক্ত সার্বিক কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়ে উঠছে না। জলাধারের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথমত, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, কারণ জলাধারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মানুষ এখন নলকূপের ওপর ভর দিয়ে তাদের গোসল সেরে থাকে। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানি কমে যায়। দ্বিতীয়ত, পাড়া, মহলস্না এবং গ্রামের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা এসব ছোটোখাট খাল-পুকুরে রাখা যেত। কিন্তু এই জলাধার সংকটে পরিবেশ আর পরিষ্কার রাখা যাচ্ছে না। ময়লা-আবর্জনা রাখার পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, বৃষ্টি এবং বন্যার সময় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পর্যাপ্ত জলাধারের অভাবে পানি সরতে পারে না কোথাও। ফলে বন্যা এবং জলাবদ্ধতার কারণে গ্রামীণ এবং শহুরে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। চতুর্থত, প্রাণিজগতের বাস্তুসংস্থান বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। জলাধারের অভাবে মাছের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে, সংকটে পড়ছে এবং উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এর বাহিরেও জলাধার ধ্বংসের কারণে নানা সমস্যার বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে আমাদের দেশ। খাল-বিল-পুকুরসহ সব ধরনের জলাধার হ্রাসের পেছনে কতগুলো কারণ বিদ্যমান। আবাসন চাহিদা একটি অন্যতম কারণ। দেশে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু আমাদের ভুখন্ড সীমানা স্থির। ফলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ছে। নতুন নতুন আবাসনের চাহিদাপূরণ করতে গিয়ে খাল-বিল-পুকুর ভরাট করতে হচ্ছে। জলাধার হ্রাসের পেছনে দখলদারিত্ব আরেকটি উলেস্নখযোগ্য হেতু। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে, ব্যবসায়িক স্বার্থে এবং অবকাঠামোগত নির্মাণের জন্য জলাধার ভরাট করছে। তারা পরিবেশের কথা চিন্তা করেন না। আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে তাদের বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা সাধারণ জনগণের নেই। তারা জলাধার ভরাট করে বিল্ডিং গড়ে তুলছেন, বাজার সৃষ্টি করছেন, কারখানা নির্মাণ করছেন। সুতরাং ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে পরিবেশের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি অপরিকল্পিত নগরায়নও খাল-বিল-পুকুরের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে। শহরে প্রতিনিয়ত শহরবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কলকারখানা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে, রাস্তাঘাট সংস্কার হচ্ছে। ফলে শহরে বিদ্যমান সামান্য সংখ্যক জলাধারগুলোও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ু, বাস্তুসংস্থান ইত্যাদি স্বাভাবিক টিকছে না। কারণ এই জলাধার সংকট। সুতরাং জলাধার রক্ষায় আমাদের কতগুলো দায়িত্ব রয়েছে। সর্বপ্রথম আমাদের ২০০০ সালে করা জলাধার রক্ষা আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এই আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। দখলদারিত্বের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। নগরের বদ্ধজলাশয়গুলো পরিষ্কার করতে হবে। জলাধারের পরিসর বাড়াতে হবে। গ্রামাঞ্চলে সব নাগরিকদের পরিবেশ রক্ষায় সচেতন করতে হবে। খাল, বিল, পুকুর ভরাটের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সর্বোপরি, খাল, বিল, পুকুরের সংখ্যা উলেস্নখযোগ্য হারে হ্রাসের প্রবাহ আমাদের থামাতে হবে। রাষ্ট্র, সরকার, জনগণ এবং পরিবেশকর্মীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারবে আমাদের এই বাংলার ভরপুর জলাধারের ঐতিহ্য রক্ষা করতে, অন্যথায় আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ কঠিন অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হবে।

আল আমিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে