সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

হালাল উপার্জনে রোজা আর ইফতার হোক আমাদের লক্ষ্য

আলস্নাহ আমাদের দেহ এবং মনকে শুদ্ধ করে রোজার প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্ধির ক্ষমতা দান করুন। আমাদের উপার্জন হোক হালাল। আমাদের আত্মা হোক লোভমুক্ত পবিত্র। ঘৃণার অনলে নয়, প্রেমের আলোয় আলোকিত হোক আমাদের হৃদয়। রমজানে এটাই হোক আমাদের লক্ষ্য, আমাদের প্রার্থনা।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ১২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। এই শর্তকে সামনে রেখে আমরা আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য শুরু করি আমাদের সাওম পালন।

রোজা শব্দটি ফারসি। আরবি পরিভাষা হচ্ছে সওম। বহুবচন হচ্ছে সিয়াম।

সওম শব্দের অর্থ হচ্ছে- বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা।

আলস্নাহর সন্তুষ্টির কামনায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার থেকে বিরত থাকাকে বলা হয় সওম।

এই রমজান মাসেই অধিকাংশ আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছে।

হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী:

হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সহিফা রমজানের ১ তারিখ।

মুসা (আ.)-এর তাওরাত রমজানের ৬ তারিখ।

দাউদ (আ.)-এর যবুর রমজানের ১২ তারিখ।

ঈসা (আ.)-এর ইঞ্জিল রমজানের ১৮ তারিখ।

হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর কোরআন রমজানের পবিত্র কদরের রাত্রে।

সূরা বাকারার ১৮৩নং আয়াতে আলস্নাহতায়ালা বলেন, 'হে ইমানদার বান্দারা তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।'

ইমাম গাজ্জালীর মতে, আখলাকে ইলাহী বা আলস্নাহর গুণে মানুষকে গুণান্বিত করাই সিয়ামের উদ্দেশ্য।

তাকওয়া কী?

তাকওয়া আরবি শব্দ। এর অর্থ- বাঁচা, মুক্তি, সতর্কতা ও ভয়। শরিয়তের পরিভাষায়- আলস্নাহর ভয়ে ভীত হয়ে আলস্নাহর নির্দেশ ও রাসূল (সা.)-এর পথে জীবন পরিচালিত করা। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই যেন আলস্নাহর হুকুম লঙ্ঘন না হয় সে সতর্কতার সঙ্গে চলার নামই তাকওয়া।

তাকওয়ার ৬টি বৈশিষ্ট্য:

১. সত্যের অনুসন্ধান।

২.সত্য গ্রহণ।

৩.সত্যের ওপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা।

৪.আলস্নাহ ভীতির মহান স্বভাব সৃষ্টি করা।

৫.দায়িত্ব সচেতনতা।

৬.আলস্নাহর কাছে জবাবদিহি নিয়ে সব কাজ সৃষ্টি করা।

প্রকৃতপক্ষে দুটি বিপরীত বস্তু দেহ ও মনের সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি। দেহ মাটির তৈরি আর রুহ বা আত্মা আলস্নাহর হুকুম বা নূরের তৈরি। মাটি নিম্নগামী আর রুহ ঊর্ধ্বগামী।

মাটির বৈশিষ্ট্য যখন মানুষের মধ্য প্রবল হয় তখন সে মনুষ্যত্বটুকু হারিয়ে ফেলে। সে চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়। অন্যদিকে, আত্মার শক্তি প্রবল হলে, মারেফত এলাহী অর্জনে সক্ষম হয়।

রোজা আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র উন্নয়নের এক বিশেষ প্রক্রিয়া। চারিত্রিক উন্নয়ন এবং মানসিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানসিক সাধনা। সিয়াম সাধনায় শারীরিক অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের ব্যবহারের চেয়ে মনের গতি- প্রকৃতি, কামনা ও বাসনা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বই বেশি। এজন্যই সিয়ামকে রাসূল (সা.) দেহের জাকাত বলেছেন।

ড. মোহাম্মদ আলস্নামা ইকবালের মতে, মুসলিমরা এ বিশ্বে বিজয়ী হয়েছিল কোরআনকে অবলম্বন করে। আজ পতিত হয়েছে, বিপর্যস্ত হচ্ছে কোরআন পরিত্যাগ করে।

আলস্নামা ইবনুল কাইয়ুম বলেন, সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা আর জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা। জৈবিক চাহিদাসমূহের মধ্যে স্থূলতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করা।

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে, ১৬/১৭ ঘণ্টা ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার ফলে, শরীরের অঙ্গগুলো স্বাভাবিক হতে থাকে। পাচনতন্ত্রের উন্নতি হয় এবং গ্যাস, বদহজম, লিভারের রোগ, জয়েন্ট ব্যথার ঝুঁকি ইত্যাদি কমে যায়।

১৭৬৯ সালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিটার ডেনিয়ামিনড বলেন, রোজার কারণে পরিপাকতন্ত্র একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশ্রাম পায়।

ড. পিজি স্পার্সকি বলেন, রোজার মাধ্যমে কালাজ্বর ও শরীরের অন্যান্য পুরাতন রোগ কোনো ম্যাডিসিন ছাড়াই ভালো হয়।

জার্মান ডাক্তার ফেডারিক হ্যানিম্যান বলেন, রোজার মাধ্যমে মৃগীরোগ ও আলসারের চিকিৎসা করা যায়।

এটা ধৈর্যের মাস। এটা সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। এটা সেই মাস- যে মাসে মুমিন বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়।

রাসূল (সা.) বলেন, 'তোমাদের মধ্যে যেন কেউ রোজা রেখে অশ্লীল কথাবার্তায় এবং ঝগড়া লিপ্ত না হয়।

কেউ গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করতে চাইলে শুধু বলবে আমি রোজাদার।'

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস উপস্থিত হতো তখন রাসূল (সা.) কয়েদিদের মুক্তি দিতেন এবং প্রত্যেক প্রার্থনাকারীকে দান করতেন।

নবী করিম (সা.) বলেছেন, কেউ যদি রোজা রেখেও মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই।

যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ যেমন পবিত্র হয়, তেমনি রোজার মাধ্যমে শরীর এবং আত্মা পবিত্র হয়।

রোজার মাসে আমরা নিজের শরীর এবং আত্মাকে পবিত্র করার এবং সেই সঙ্গে সম্পদকে পবিত্র করার সুযোগ পাই।

'হালাল রুজি ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত।'

'সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়, মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে।'

আমরা এই হাদিসগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখব- আমাদের ইবাদত আসলেই কতটুকু শুদ্ধ।

একবার হযরত আবু বকর (রা.) কাপড় বিক্রি করা টাকা এনে নবীজিকে বললেন, আমি সকালে যখন কাপড় বিক্রি করতে যাই তখন ভেবেছিলাম আমার একটা কাপড় একটু ছেঁড়া আছে তা ক্রেতাকে বলে বিক্রি করব কিন্তু সব কাপড় বিক্রি হওয়ার পর আমার এ কথা মনে পড়েছে।

মহানবী (সা.) বললেন, ভালো কাপড় বিক্রির টাকা এবং ছেঁড়া কাপড় বিক্রির টাকা সব কি একত্রে? আবু বকর (রা.) বললেন, জি, সব একত্রে।

মহানবী (সা.) বললেন, তাহলে সব টাকাই অবৈধ। সব টাকা দান করে দাও।

এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি নিজেদের মুখোমুখি দাঁড়াই তাহলে আমাদের কতজনের আয় বৈধ?

এই যে সুরম্য মসজিদ, মাদ্রাসা তা কতটা বৈধ আয়ে তৈরি?

একজন উপরস্থ কর্মকর্তা শুনেছি বস্তা ভরে ঘুষ নিতেন। কারণ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি যাতে চলতে পারেন এজন্য একটি শপিং মল তৈরি করবেন এবং গ্রামের মানুষ যাতে নামাজ পড়তে পারে এজন্য তিনি আধুনিক একটি মসজিদ তৈরি করবেন।

অনেক মানুষ তার ক্ষমতাকে ব্যবহার করে চাঁদা চায়- মসজিদ, মাদ্রাসার জন্য। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসের মন রক্ষার্থে সে চাঁদা দিতে বাধ্য হয় অধীনস্তরা।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে সত্যকে ধারণ এবং বৈধ আয়ে জীবন পরিচালনা এই দুটিকে আমরা গুরুত্বসহ গ্রহণ করতে পারলে আমাদের এই রোজা রাখা সফল হবে। নয়ত শুধুই ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত থাকা হবে। রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমরা ধারণ করতে না পারলে কেন রোজা রাখা?

একদিকে ইফতার পার্টি, মুখোরোচক নানা খাবারের সমারোহ; অন্যদিকে, চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে মানুষ। রোজা না রাখলেও ঈদের নানা আয়োজনে লাখ টাকার কেনাকাটা। ভোগবাদী জীবনের নানা আয়োজনে ঢাকা পড়ে যায় সমাজের একটি অংশের কোনমতে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম।

সমাজের এই বৈষম্য দূর করার জন্যই যাকাত। যাকাত দয়া নয়। অধিকার ধনবানের সম্পদে নিঃস্বদের।

সত্য এবং ন্যায়ের আলোয় হৃদয় আলোকিত না হলে সবকিছুতেই থাকে লোক দেখানো আয়োজন। যাকাত যদি সঠিকভাবে দেয়া হতো তাহলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য এত প্রকট হতো না। যতটা না আলস্নাহ ভীতি তার চেয়ে বেশি সমাজে নিজেকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা থাকে এই যাকাত প্রদানে।

আসুন আমরা এই রমজানে রোজা রাখা, যাকাত প্রদান এবং নানা ইবাদতের মাধ্যমে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াই। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি,

১. আমার নিজের হৃদয়ের আঁধার দূর হয়েছে কি?

২. আমার আয় শতভাগ বৈধ তো?

৩. আমি কি ভোগ বিলাস থেকে মুক্ত হতে পেরেছি?

৪. আমার আত্মা কি পবিত্র হয়েছে?

৫. আমি কি মানুষকে, আলস্নাহর সৃষ্ট সব জীবকে ভালোবাসতে পারি?

৬. আমার হাত এবং মুখ থেকে পাশের ব্যক্তি কি নিরাপদ?

৭. আমি যা করি তা কি আলস্নাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য, না মানুষকে দেখানোর জন্য?

৮. অন্য ধর্মের মানুষ আমায় নিরাপদ এবং বিপদে আশ্রয় হিসেবে মনে করে কি?

৯. আমায় মানুষ ভালোবাসে, না ভয় করে?

১০. আমি কি নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছি প্রেমে?

আলস্নাহ আমাদের দেহ এবং মনকে শুদ্ধ করে রোজার প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্ধির ক্ষমতা দান করুন। আমাদের উপার্জন হোক হালাল। আমাদের আত্মা হোক লোভমুক্ত পবিত্র। ঘৃণার অনলে নয়, প্রেমের আলোয় আলোকিত হোক আমাদের হৃদয়। রমজানে এটাই হোক আমাদের লক্ষ্য, আমাদের প্রার্থনা।

আমিন।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে