মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিক অবক্ষয়ের ফলে বৃদ্ধাশ্রমের সূচনা

বাংলাদেশের মানুষের দিন দিন নৈতিক অবক্ষয় বেড়েই চলেছে। তাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে অবহেলিত হচ্ছে সমাজের বৃদ্ধ মানুষগুলো। সামাজে বৃদ্ধের এমন সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতি অবহেলার মাত্রা বেড়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
মিজানুর রহমান মিজান
  ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

মানুষের মানবিক অবক্ষয়ে ফলে সমাজে বৃদ্ধ মাতাপিতার জন্য গড়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম হলো মানবতার কলঙ্কিত এক কারাগার। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ বৃদ্ধ সাধারণত পরিবারে বাস করে এবং তাদের ভরণপোষণ, চিকিৎসা ইত্যাদির দায়িত্ব সন্তান গ্রহণ করে। কিন্তু সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, যার ফলে বৃদ্ধরা তাদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার তথা আশ্রয় এবং বাসস্থানের অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। একটি জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ শতাংশ বৃদ্ধের এক বা একাধিক সন্তান বাইরে থাকে। তাদের সন্তানেরা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও করে না। তখন সেই সব বৃদ্ধ পিতামাতা বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তারা জীবনধারণ ও বাসস্থান সংকটে ভুগতে থাকে। দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধাশ্রম না থাকার কারণে সেইসব বৃদ্ধ ব্যক্তিদের বৃদ্ধাশ্রমেও জায়গা হচ্ছে না। তবে আশার কথা হলো, বর্তমান সরকার বাংলাদেশের ৬টি বিভাগে ৬টি বৃদ্ধাশ্রম চালু করেছে। এছাড়াও বর্তমান সরকার ১৭ লক্ষ বয়স্ক মানুষের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করেছেন? বাংলাদেশে বর্তমানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের উদ্যোগে বেশকিছু বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রম চালু করেছে এবং আরও কিছু বৃদ্ধাশ্রম চালু হওয়ার কথা আছে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম ও ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। বার্ধক্য বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ, যার মোকাবিলা নিতান্তই কঠিন। জাতিসংঘ ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ হিসেবে জনসংখ্যার ৬.১ শতাংশ প্রবীণ নর-নারী। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১০.১ শতাংশে। উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশে এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হয়ে দেখা দেবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ সাধারণ পরিবারে বসবাস করেন এবং তাদের ভরণপোষণ, চিকিংসা ইত্যাদির ভার সন্তানদের ওপর বর্তায়। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রবীণরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছেন। এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণরই কোনো না কোনো সন্তান বাইরে থাকে। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে পিতামাতার যোগাযোগ খুব কম হয়। এতে করে বৃদ্ধ পিতামাতারা আর্থসামাজিক সমস্যায় ভোগেন। বাংলাদেশে শতকরা ২০ জন হয় একাকী থাকেন অথবা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকেন। দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গড় আয়ু বেড়ে দেশের মোট জনসংখ্যার সাত ভাগ প্রায় সোয়া এক কোটি এখন প্রবীণ জনগোষ্ঠী। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হবে প্রায় ২০ ভাগ। কিন্তু এই সংখ্যাটা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে হতাশাও।

একটি জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ শতাংশ বৃদ্ধের এক বা একাধিক সন্তান বাইরে থাকে। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে তাদের পিতামাতার যোগাযোগ খুব তেমন একটা নেই। আর শতকরা ২০ জন, দরিদ্র প্রবীণদের শতকরা ৩৭ জন একাকি থাকেন অথবা কেবল স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে থাকে। এদিকে, সরকার প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করাসহ বেশ কিছু সুবিধা চালু করা হয়েছে। এছাড়া, সরকার কর্তৃক সহায় সম্বলহীন প্রবীণদের জন্য ৬টি বিভাগে ৬টি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও বেশ কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উড়েছে। তবে দেশে মোট কতজন প্রবীণ এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বসবাস করছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারিভাবে নেই। তবে বেসরকারি সংস্থা প্রবীণ হিতেষী সংঘের হিসেবে, দেশের ১ কোটি ১৭ লাখের বেশি প্রবীণের মধ্যে অনেকেরই নেই জীবনযাপনের নিশ্চয়তা। ২০৫০ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে সাড়ে চার কোটি, জনসংখ্যার প্রতি পাঁচ জনের একজন হবে প্রবীণ।

এক-দুই দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কেন এই বৃদ্ধাশ্রম? বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি জীবন যেন একেকটি ট্র্যাজেডি। যারা জীবনের সর্বস্ব দিয়ে গড়েছেন সন্তান ও সমাজ আজ তাদের ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি জীবন যেন এক একটি নির্মমতার গল্প। সেই বৃদ্ধাশ্রমের জীবনে নেই কোনো আপনজন। পরিবার-পরিজনহীন অযত্নে-অবহেলায় জীবন কাটাতে হয় প্রবীণদের। সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করতে যারা জীবনের সোনালি সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন তারাই আজ সমাজ বিতাড়িত। এই সমাজ, রাষ্ট্র এবং আইনের কাছে তাদের নেই কোনো অভিযোগ কিংবা চাওয়া-পাওয়া। তবে এই সমাজের মানুষ হিসেবে এই প্রবীণ নাগরিকদের জন্য কতটুকু দায় পূরণ করতে পেরেছি আমরা?

সন্তানদের সমৃদ্ধির জন্য প্রবীণদের হাড় ভাঙা খাটুনি, এক বেলা খেয়ে দুই বেলা না খেয়ে থাকা, নিজে আরাম-আয়েশের জীবনযাপন না করে, জীবনের সমগ্র সুখ-দুঃখ হাসিমুখে বরণ করে নেন সন্তানের জন্য। এমনকি সন্তানের সামান্য কষ্টেও ব্যথিত হন তারা। মা-বাবার স্বপ্ন একটাই ছিল তাদের সন্তান অনেক বড় হবে, অনেক বড় চাকরি করবে তখন তাদের এই কষ্টের পরিত্রাণ ঘটবে। তখন সব ক্লান্তি ভুলে নতুন করে জীবন উপভোগ করবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সন্তানদের জন্য এত ত্যাগের পরও প্রবীণরা শেষ বয়সে এসে লাঞ্ছিত, অবহেলিত হতে হয় সন্তানদের দ্বারাই। এমনকি কারো আবার জীবনের শেষ সম্বল, স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি দিলেও ঠাঁই মিলে না সন্তানদের পরিবারে। তখন আমরা ভুলে যাই প্রবীণদের শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠেছে আমাদের অগ্রগতির ধারা, আমাদের সমৃদ্ধির পেছনের শক্তি এই প্রবীণদের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে সবারই ভান্ডার খালি হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের যে ভালোবাসা, তা পৃথিবীর একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। সন্তানের জন্য বাবা-মা নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। তাই তাদেরকে সম্মান করা, ভালোবাসা ও তাদের প্রতি কর্তব্য পালন করা আমাদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু তিক্ত সত্য হলো, কালপরিক্রমায় আমরা হয়ে ওঠি অতি নিমর্ম। প্রকাশ পায় বাবা-মায়ের প্রতি চরম অবহেলা ও অবজ্ঞা। বাবা-মা যখন বৃদ্ধ হয়ে যান, তখন তারা সন্তানের উপার্জনের ওপর নির্ভশীল ও চরম অসহায় হয়ে পড়েন। আর তখন থেকেই আমরা তাদের প্রতি প্রদর্শন করি ঔদাসিন্য ও অবহেলা। তাদের ভাবতে থাকি পরিবারের বোঝাস্বরপ। এই ভোগবাদী মানসিকতা থেকেই আমরা তাদেরকে জোর করে পাঠিয়ে দেই বৃদ্ধাশ্রমে। স্বামী-স্ত্রী ও আদরের ছেলে-মেয়ে নিয়ে গড়ে ওঠে সুখের সংসার। আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। পরিবার-পরিজন, ছেলে-মেয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক চরম অসহায় জীবনযাপন করেন তারা। ভাগ্যের কি নিমর্ম পরিহাস, যে সন্তানকে মানুষ করার জন্য বাবা-মা সারা জীবন কষ্ট করেছেন, যে সন্তানের সুখের দিকে তাকিয়ে বাবা-মা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই নরাধম সন্তানের দ্বারাই বাবা-মা নিগৃহীত হচ্ছেন

বাংলাদেশের মানুষের দিন দিন নৈতিক অবক্ষয় বেড়েই চলেছে। তাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে অবহেলিত হচ্ছে সমাজের বৃদ্ধ মানুষগুলো। সামাজে বৃদ্ধের এমন সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতি অবহেলার মাত্রা বেড়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

যার ফলে সূচিত হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম নামের কলঙ্কজনক অধ্যায়। ছোটবেলায় যে বাবা-মা ছিলেন সন্তানের সবচেয়ে বেশি আপন, যাদের ছাড়া সন্তান কিছুই করতে পারত না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে তাদের মানুষ করেছেন, নিজের সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে সন্তানের হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য যে মা-বাবা ব্যাকুল থাকতেন, সে না খেলে যিনি থাকতেন অনাহারে, না ঘুমালে থাকতেন নির্ঘুম, অসুস্থ হলে ঠায় বসে থাকতেন শিয়রে, যে বাবা-মা তিল তিল করে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানকে মানুষ করার জন্য, যে বাবা নিজের পকেট খরচকে বাঁচিয়ে রাখতেন তার সন্তানের টিউশন ফি অথবা টিফিনের টাকার জন্য, যারা নিজের অসুস্থতার কথা না ভেবে কেবল তার সন্তানদের কথা চিন্তা করে প্রতু্যষেই নেমে পড়তেন রুজির সন্ধানে, সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা অবশেষে যদি হয় বৃদ্ধাশ্রম। আমাদের মানবতা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ হিসেবে এটা আমাদের জন্য লজ্জার।

\হ

মিজানুর রহমান মিজান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে