মাতৃত্ব এমনই মধুর যাতনা যে নবজাতক মারা গেলেও মায়ের বুকে দুধ আসে। সন্তানের চেহারা দেখে নিমিষে হারিয়ে যায় গর্ভধারণকালের সব আঘাত, প্রসব সময়কালে মৃতু্যসম কষ্ট। যখন ছোট থাকে, তার খাবার, ঘুম, জ্বর-সর্দি নিয়েই কত ভাবনা; ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দায়িত্ব। আজকের পৃথিবীতে অনেক ক্ষেত্রেই বৃদ্ধ বাবা-মা সন্তানের কাছে বোঝাস্বরূপ। আমরা সন্তানকে বড় করতে চাই বটে; কিন্তু এত বড় না যে বাবাকে কবর দেওয়ার সময় হবে না। মায়ের কতিপয় আচরণ অজান্তেই সন্তানের মঙ্গল হওয়ার বদলে তার বিকাশে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। কাজেই মা হিসেবে আমাদের করণীয় বুঝে নেওয়া চাই।
মহানবী (সা.)-এর জীবনী থেকে কিছু চমৎকার দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। প্রথমত, সন্তানকে ভালোবাসা, সম্মান করা এবং সেটা দেখানো, সন্তানের জন্য ইমোশনালি অ্যাভেইলেবল থাকা। সন্তানের সঙ্গে সখ্যতা রাখুন। জড়িয়ে ধরে আদর করুন, চুমু খান। যে কোনো সমস্যায় তার কাঁধে হাত রেখে কথা বলুন। তাহলে সে শুধু ছোট ছোট সমস্যাই নয়, গভীরতর জটিলতাও আপনার সঙ্গে আলোচনা করবে। ভালোবাসায় শর্তজুড়ে দেবেন না। যেমন ক্লাসে প্রথম হলে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব; বরং বোঝান যে কোনো অবস্থায়, যে কোনো পরিস্থিতিতে আপনি তার সঙ্গে আছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর বিলাসিতা নয়, কোয়ালিটি টাইম দিন, যে সময়টা শুধু আপনার এবং আপনার সন্তানের। পরিবারে সবাই অন্তত একবেলা একসঙ্গে বসে খান। ওর ভালো লাগা-খারাপ লাগা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা জেনে নিন। আপনার ছেলেবেলার গল্প ওর সঙ্গে করতে পারেন, এতে ও আনন্দ পাবে, ইতিহাসও জানা হয়ে যাবে; যান্ত্রিক হবে না। ছেলে ও মেয়েতে বৈষম্য করা কোনোমতেই চলবে না। ইরশাদ হয়েছে, 'যখন তাদের কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, মনঃকষ্টে তাদের চেহারা কালো হয়ে যায়। তাদের যে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে- তার কারণে তারা নিজ সম্প্রদায়ের লোক থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তারা ভাবে, এই সন্তান রাখবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট। (আন-নাহল, ৫৮-৫৯)
দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতের বিষয়ে ভালো ধারণা দিন, উচ্চাশা দেখান, যেমন : 'তুমি খুব ভালো মানুষ হবে, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।' আচরণ ও নীতিবোধ শেখান, প্রশংসা করুন। 'তোমাকে এটা পারতেই হবে', এ ধরনের অযথা চাপ তৈরি করবেন না। সন্তানের ছোটখাটো সাফল্যকে উদযাপন করুন। প্রায়শই দেখতে পাবেন আপনার সন্তানের বেশকিছু পছন্দ এবং সিদ্ধান্ত আপনার সঙ্গে মেলে না। যতক্ষণ নিজেদের বা অন্য কারও ক্ষতি করছে না, ততক্ষণ তাদের পছন্দ এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে বাধা দেবেন না। ছেলেমেয়ে বিনয়ী হোক, বাধ্য নয়। বাবা-মা বলেই আপনার সব কথা মেনে চলতে বাধ্য তা নয়, যুক্তি দিয়ে বোঝান। প্রয়োজনে সন্তানের কাছে ভুল স্বীকার করতেও দ্বিধা করবেন না। কীভাবে একটা সৃজনশীল ও অনুসন্ধিৎসু মনন তৈরি করা যায় সে চেষ্টা চালান। প্রতিভা খুঁজে বের করুন। কোনো কিছুতে খারাপ করলে অন্যের সঙ্গে তুলনা তাকে এগিয়ে যেতে তো উৎসাহ দেবেই না, তিলে তিলে অবসাদে ভোগাবে। ঘন ঘন আইনস্টাইন, বিল গেটস কিংবা পাশের বাড়ির ছেলে বা মেয়েটির মতো ভালো আপনার সন্তান হচ্ছে না কেন সে কাহিনী শুনিয়ে কাজ নেই। গায়ে হাত তোলাও কোনো সমাধান নয়। ভুলটা দেখিয়ে দিন, সংশোধন করে নেওয়ার সময় দিন, যেন আবার একই ভুল না করে। আত্মবিশ্বাসী হতে শেখান। সন্তানের ব্যক্তিত্বকে খর্ব করা হলে সন্তানও মায়ের ব্যক্তিত্ব খর্ব করতে দ্বিধা করবে না। প্রায় পরিবারেই দেখা যায় সন্তানকে মাও প্রচুর ভালোবাসে, বাবাও ভালোবাসে, অথচ তাদের নিজেদের দ্বন্দ্ব প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করে। সত্যি বলতে মা হিসেবে যে গুটিকয়েক অনন্য উপহার আমরা দিতে পারি তার অন্যতম হলো স্বামী তথা সন্তানের বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। তাই বলে মুখ বুজে সহ্য করা যাবে না। স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি অন্যজনকে একচেটিয়া অসম্মান করেন তাতে সন্তান দুটা মেসেজ পাবে। এক- অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে নেই, দুই- অধিকার আদায় করতে হলে হিংস্র হতে হয়। পারিবারিক অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুও যদি বাচ্চাদের সামনে হয়ে যায়, তাদের বলুন- সব সময় এমন থাকবে না, ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হবে।
তৃতীয়ত, তাদের চাহিদা পূরণের ব্যাপারে আন্তরিক হোন। তবে চাওয়ার আগেই সব দিয়ে দেওয়া উচিত নয়, কষ্টসহিষ্ণু করে গড়ে তুলতে হবে। কঠিন কাজ হলেও করে না দিয়ে কীভাবে করতে হয় তা দেখিয়ে দেবেন যাতে পরেরবার নিজে করতে পারে। পরিশ্রমী হতে শেখান। পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দিন। নিজের হাতে খেতে উৎসাহিত করুন। সে কম খায় এই অজুহাতে মুখে তুলে খাইয়ে দেবেন না। স্কুলগামী সন্তানের স্কুলের বই শিশুকেই পড়তে দিন। স্কুল থেকে সে যেন নিজের পড়া নিজেই তুলে নিয়ে আসে, আপনি সংগ্রহ করবেন না। ছোটখাটো কাজ করতে দিতে হবে। যেমন- রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়তে হবে, তার মাঝেই হোমওয়ার্ক, ব্যাগ গোছানো, খাওয়া সম্পন্ন করতে হবে। এতে সময়ানুবর্তিতা বাড়বে। পারিবারিক আয়ব্যয় সম্পর্কিত আলোচনাগুলো তাদের সামনেই করা উচিত। টাকা-পয়সা ম্যানেজ করা, বাজার করা, কাপড় ধোয়া, বাথরুম পরিষ্কার করা, আতিথেয়তা প্রভৃতি শেখান।
মাত্রাতিরিক্ত অধিকার খাটাবেন না। একই আদেশ বার বার দেওয়া যাবে না। বয়স অনুযায়ী শারীরিক পরিবর্তন আর নিরাপত্তা নিয়ে ধারণা দিন। ইমানি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নিশ্চিত করুন। কৈশোরে সমব্যথী হয়ে উঠুন। বিদ্রূপ, কটাক্ষ করে বকবেন না, শান্ত মনে বুঝিয়ে বলুন। অহেতুক সন্দেহ বা গোপন নজরদারি করবেন না। তবে পরিষ্কার ধারণা রাখুন সে কাদের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছে। নেশার খপ্পরে পড়ছে কি না। মোবাইল ফোন ব্যবহার সীমিত করুন। ভালো বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে উৎসাহ দিন। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় সন্তানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুন।
সন্তানকে কোনো বিষয়ে মানা করার আগে দেখে নিন আপনি সেটা করেন কিনা। শিশুরা শুনে যতটা শেখে, তার চেয়ে বেশি শেখে দেখে। কারও উপহারের খুঁত ধরবেন না। কেউ উপকার করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। কারও ব্যক্তিগত জিনিস নেওয়ার আগে অনুমতি নিন। সন্তানের সামনে পরিবারের অন্য সদস্যদের সমালোচনা এড়িয়ে চলুন। হোক পরিবারের সদস্য, তবুও। তার সামনে কোনো অপরাধ করবেন না বা অপরাধের পক্ষ নেবেন না।
'বলে দাও, বাবা বাসায় নেই', সন্তানকে দিয়ে এরূপ মিথ্যা বলানো থেকে বিরত থাকুন।
সবশেষ যে বিষয়টি প্রিয় নবী (সা.) শিখিয়েছেন তা হলো সন্তানের প্রতি ন্যায়বিচার করতে দ্বিধা করা যাবে না। প্রয়োজনে শাসন করুন, কী কারণে শাসন করছেন, এটা সম্পর্কে যেন ওর পরিষ্কার ধারণা থাকে। 'যে দন্ড বেদনা পুত্রেরে পার না দিতে, সে কারও দিও না।' প্রকৃতার্থেই যেদিন তুমি আমাকে হারাবে সেদিন আমি জিতব, তখন নয় যখন আমি তোমাকে জিততে দেব।
নিশাত তাসনিম
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়