বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

নাফিস আহমেদ শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
  ২১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
আপডেট  : ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৩
ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন
ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

পৃথিবীতে মানব সভ্যতার প্রাচীন শৈল্পিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মৃৎশিল্প। এটা আমাদের বাঙালিরও আবহমান গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য বহন করে। 'মৃৎ' বলতে মৃত্তিকা বা মাটিকে বোঝানো হয় এবং 'শিল্প' বলতে দক্ষতা ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে তৈরি এমন জিনিসকে বোঝায় যা নান্দনিক সৌন্দর্য বহন করে। অর্থাৎ মৃৎশিল্প বলতে মাটি দিয়ে তৈরি অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্যপূর্ণ চমৎকার কোনো সৃষ্টিকর্মকে বোঝায়। মূলত এঁটেল মাটি ও কাদামাটির সাহায্যে শৈল্পিক রূপ দিয়ে তৈরি করে আগুনে পুড়িয়ে মৃৎশিল্প আকার লাভ করে। বাঙালির কালজয়ী ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের এই মৃৎশিল্প। বহুদিন ধরে হিন্দু পালরা (যাদের আমাদের দেশে কুমার বলা হয়) এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে অবদান রেখে আসছে, তবে এখনকার সময় মুসলামানরাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মৃৎশিল্প তৈরি হচ্ছে, যেমন কুমিলস্নার বিজয়পুরে মৃৎশিল্প সমিতি আছে। সেখানে বহু মানুষ প্রতিনিয়ত কাজ করছে এবং অত্যন্ত চমৎকার ও বিচিত্র সব শিল্পকর্ম তৈরি করছে, যা দেশের গন্ডিও পেরিয়ে গেছে। সেখানকার শিল্পকর্ম দর্শককেও অত্যন্ত মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে। আবার শরীয়তপুর জেলার কার্তিকপুরের মৃৎশিল্প দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে, যা বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের ঐতিহ্যকেও বহন করছে আবার বৈদেশিক মুদ্রাও পাওয়া যাচ্ছে। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। অন্যদিকে পটুয়াখালী জেলার বাউফলের মৃৎশিল্পেরও সুনাম রয়েছে। তথ্যমতে, এক বছর আগে বিশ্বজুড়ে অর্ধশতকোটি টাকার বাজার গড়েছে বাউফলের মৃৎশিল্প। এই তিনজেলা ছাড়াও সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় কম-বেশি মৃৎশিল্প তৈরি হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশে এই শিল্পের অস্তিত্ব যেন হারাতে বসেছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এর জায়গায় স্থান করে নিয়েছে পস্নাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়াম। অতীতে আমাদের দেশে শুধু জেলাতেই নয়, প্রত্যেক উপজেলাতেও মৃৎশিল্প তৈরি ও বেচাকেনা হতো। কিন্তু গত এক দশকে এর ব্যবহার আগের তুলনায় অনেক লোপ পেয়েছে। সাধারণ মানুষও এখন মৃৎশিল্প দেখতে পছন্দ করলেও ব্যবহারের জন্য পস্নাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসই কেনে। এর ফলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পস্নাস্টিকের ব্যবহার যেমন দিনকে দিন বাড়ছে, তেমনি মৃৎশিল্পের ব্যবহার যেন হারাতে বসেছে। বেচাকেনা কম হওয়ার ফলে এর কারিগররাও বানাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না, কারণ মৃৎশিল্পের দামও অনেক কমে গেছে, ফলে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারছে না। এজন্য অন্য পেশার দিকে ছুটছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আগামী এক দশকের মধ্যেই হয়তো সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে। কিন্তু এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখলে একদিকে আমাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রাও আসবে আবার পস্নাস্টিকের ব্যবহারও কমবে। আমরা পস্নাস্টিকের ব্যবহার রোধ করতে চাই, কারণ এটি পরিবেশ দূষিত করে এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টির জন্যও দায়ী। কিন্তু এর বিকল্পটা খুঁজে না পেলে হয়তো এটির ব্যবহার কমবে না। মৃৎশিল্পই হতে পারে পস্নাস্টিকের সর্বোত্তম বিকল্প। আমাদের এই শিল্পের বহুবিধ গুণাগুণ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা দরকার ও পস্নাস্টিকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেও অবহিত হওয়া দরকার। তাহলে আমরা মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। যেমন মাটির তৈরি কলসে পানি রাখলে সেই পানি একদিকে যেমন ঠান্ডা থাকে, তেমনি স্বাস্থ্যগত দিক থেকে এর উপকারিতা রয়েছে। আবার, গ্যাসের চুলার থেকে মাটির চুলায় রান্না করলে সেই খাবার খেতে অধিক সুস্বাদু হয় এবং স্বাস্থ্যের জন্যও অধিকতর উত্তম। আমরা গাছ লাগানোর জন্যও ইদানীং অনেকে পস্নাস্টিকের টব কিনছি; কিন্তু এর বদলে যদি মাটির তৈরি টব ব্যবহার করি, তবে সেটি গাছের জন্যও বেশি উপকারী। মৃৎশিল্পের এমন বহু সুবিধাজনক ও চমৎকার দিক রয়েছে। আমাদের সেটি ভালোভাবে জানা উচিত এবং পস্নাস্টিকের বদলে এগুলো ব্যবহারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যাই হোক, মৃৎশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। এটাকে আমাদের একটা ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং একই সঙ্গে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তালিকাভুক্ত করা উচিত। মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে যাতে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা যাতে করা হয়, সেজন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাই। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাতে প্রত্যেক জেলায় মৃৎশিল্প উদ্যোক্তা ও কারিগরদের প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে পাশে থাকা দরকার। একই সঙ্গে মৃৎশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সামাজিকভাবে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রত্যেক উপকরণের ন্যায্য বাজারদর নির্ধারণের মাধ্যমে মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে হবে। অন্যথায় এর দাম একেবারে কম হলে কেউ এই পেশায় থাকবে না। আবার এখানে কোনো সিন্ডিকেট করে কারিগরদের বা শ্রমিকদের ঠকানো হচ্ছে কিনা সেটাও দেখা গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি বলব, মৃৎশিল্প আমাদের বাংলা ও বাঙালির আবহমান ঐতিহ্য ও আমাদের গর্ব। এটি আমাদের বাঙালির মাটি ও মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। আমরা সবাই যাতে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সচেতন হই ও গুরুত্ব প্রদান করি। এজন্য সরকার ও সাধারণ জনগণ উভয়ের পক্ষ থেকেই সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা চালানো আবশ্যক।

নাফিস আহমেদ

1

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে