শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

মাদকাসক্তির ছোবল থেকে রক্ষা পাক তারুণ্য

যুবসমাজকে বাঁচাতে মাদকের আগ্রাসন ঠেকাতেই হবে। দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। তার সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ী আর অপরাধীরা যাতে কোনোভাবেই জামিনে ছাড়া না পায় সেদিকেও কড়া নজর রাখা জরুরি।
আসিফ আল মাহমুদ
  ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মাদকাসক্তির ছোবল থেকে রক্ষা পাক তারুণ্য
মাদকাসক্তির ছোবল থেকে রক্ষা পাক তারুণ্য

বর্তমানে বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ সমস্যাগুলোর একটি হলো মাদকাসক্তি! 'মাদক' কথাটি শুনলে বেশিরভাগ মানুষই বিচলিত হয়, ভয়ে আঁতকে ওঠে! আমাদের সমাজ মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা ও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকে। আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুমহলে কেউ মাদকাসক্ত হয়েছে জানলে তাকে আমরা সচরাচর এড়িয়ে চলি। এমনকি তার পরিবারের সঙ্গেও অপবাদমূলক ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। ফলে, একজন মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিবারও সমাজের এরূপ নেতিবাচকতার ভয়ে মাদক সমস্যা সমাধানের জন্য কারো কাছে সহায়তা চাইতে সংকোচ বোধ করে এবং এ সমস্যা সামনে নিয়ে আসতে চায় না। ফলশ্রম্নতিতে সমস্যা কখনো তীব্র থেকে তীব্রতর পর্যায়ে চলে যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, আর ১০টি রোগের ন্যায় মাদকাসক্তিও একটি রোগ। সঠিক নিয়মে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ সেরে যায় এবং পরবর্তী সময়ে নিয়মিত ব্যবস্থাপনায় সুস্থ থাকা সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণের দরুন এই সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরাও চিকিৎসা প্রদানে অসুবিধার সম্মুখীন হন।

বর্তমানে মাদকাসক্তদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য না থাকলেও, দেশে এক কোটিরও বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে বলে ধারণা করা হয় এবং তার সিংহভাগই যুবক। তার ওপর এদের অধিকাংশই আবার বেকার! এদের কেউ কেউ ইতোমধ্যেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জড়িয়ে পড়েছে নানাবিধ সমাজবিরোধী কর্মকান্ড বা অপরাধের সঙ্গে। আগে যারা হয়তো 'ফেনসিডিল' আসক্ত ছিল, তাদের অনেকেই এখন 'ইয়াবা' আসক্ত। ইদানীংকালে 'ইয়াবা' আমাদের যুবসমাজকে ভয়ানক গ্রাস করেছে। একদিকে যেমন 'ইয়াবা' ও অন্যান্য মাদক কারবারিদের ধরা হচ্ছে, আবার অন্যদিকে, প্রতিদিন হাজার হাজার 'ইয়াবা' বড়ি তরুণরা সেবন করছে। পরিসংখ্যান বলছে, মাদকাসক্তদের ৩০ শতাংশই কেবল নেশার খরচ জোগাতেই বহুবিধ অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়। এই আসক্তির ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে ছাত্র থেকে আরম্ভ করে দেশের শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে। এমনকি নারীরাও মাদকের থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। উদ্বেগের কারণ হলো, নারী আসক্তদের ৯০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তথ্য-উপাত্ত ঘাটলে দেখা যায়, মাদকাসক্তদের শতকরা পাঁচজন নারী। তাদের মধ্যে ছাত্রী, গৃহিণী, নারী উদ্যোক্তা ও কর্মজীবীও রয়েছেন।

তবে মাদকের আগ্রাসন রোধকল্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর যথেষ্ট তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত পথে 'ইয়াবা' আসা বন্ধ হয়নি। 'মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি)' তথ্যমতে, ২০১৮ সালে দেশে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৮৪ হাজার 'ইয়াবা' বড়ি উদ্ধার হয়। আজকাল 'ইয়াবা'র চাহিদা কিছুটা কমলেও 'আইস' জাতীয় তুলনামূলক কঠিন মাদকের নতুন চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

'আইস' বা 'ক্রিস্টাল মেথ' যেভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তা জাতিকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। সমস্যার কথা হলো, আমাদের সঙ্গে মিয়ানমারের অবস্থান সহযোগিতামূলক নয়। এই ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে মিয়ানমারের মাদক চোরাচালান চক্রের সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে। এদের মাধ্যমেও মাদক আসছে- যা দেশের জন্য রীতিমত ঝুঁকি তৈরি করছে।

ইন্দ্রিয় অনুভূতি, সাহস ও শক্তি বৃদ্ধি করা ছাড়াও যৌন উত্তেজনা বাড়াতে 'আইসে'র ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। তবে এর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির দিকই বেশি। এই মাদক সেবনে অনিদ্রা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া ছাড়াও বিবিধ রোগ দেখা দিতে পারে। মাদক গ্রহণের মাত্র ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই এর কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়- আর এমন পরিস্থিতিতে ওই মাদকসেবী যে কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ঘটাতে দ্বিধা করে না।

মাদকদ্রব্য অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দেশে শক্ত আইন ও কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে। হেরোইন, ফেনসিডিল, আফিম, মরফিন, গাঁজা, ভাং ইত্যাদি উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহণ, বেচাকেনা ও ব্যবহার 'মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে' নিষিদ্ধ ও এক কথায় মারাত্মক অপরাধ।

যুবসমাজকে বাঁচাতে মাদকের আগ্রাসন ঠেকাতেই হবে। দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। তার সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ী আর অপরাধীরা যাতে কোনোভাবেই জামিনে ছাড়া না পায় সেদিকেও কড়া নজর রাখা জরুরি।

কেউ মাদকে আসক্ত হলে বিষয়টি গোপন না করে দ্রম্নত চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন। আসক্তির লক্ষণ দেখা মাত্রই অনতিবিলম্বে নিরাময় বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। মাদকাসক্তকে ঘৃণা নয়, ভালোবাসা দেওয়া প্রয়োজন। কেউ আসক্ত হলে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা উচিত। এখানে পরিবারের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বৈষম্য নয়, মাদকাসক্ত ও তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। তবেই মাদক প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

আসিফ আল মাহমুদ : ফ্রিল্যান্স রাইটার

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে