বাঙালি জাতির জন্য ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ বিশ্বের মাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে দেশের তরে নিজ প্রাণ সঁপে দিয়েছিল উদ্দীপ্ত বাঙালিরা। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান ও দুই লক্ষ মা-বোনের ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং কোটি বাঙালির আত্মদানের ফসল হিসেবে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে অর্জিত হয়েছিল এই স্বাধীন ভূখন্ড। একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জয়লাভ করা বিরল ঘটনা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পিছনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠের মতো। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক।
১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে জাতীয় অখন্ডতা, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অব্যাহত অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের ভালোবাসা- এ দু'টি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সেনাবাহিনীর দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের আদর্শ ও দেশ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকারী সেনাবাহিনী তরুণ প্রজন্মের কাছে আজ আলোর দিশারীস্বরূপ। আমার বিশ্বাস একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশসেবায় সেনাবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা দেশপ্রেমিক গণমানুষের কাছে পাথেয় হয়ে আছে এবং থাকবে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অভু্যদয়ের পরপরই বাঙালি নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেছিলেন যে, বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বাঙালিদের মুক্তি নিহিত নয়। কারণ যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বাঙালির সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে, বাঙালির ভাষা কেড়ে নিতে চায়, সেই রাষ্ট্র বাঙালির জন্য নয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর তৎকালীন শাসকচক্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বেআইনিভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। বাংলার মানুষ তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে পরাধীন বাংলাকে মুক্ত করার জন্য, উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গভীর রাতের নিকষকালো অন্ধকার ভেদ করে দখলদার হানাদার বাহিনীর বুলেট আঘাত হানতে থাকে নিরস্ত্র, নিরীহ, নিরপরাধ, বিপন্ন ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। উক্ত অপারেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ঢাকার পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ইবিআরসিসহ সারাদেশের সামরিক-আধাসামরিক সৈন্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাঙালি জাতির ওপর হানাদার বাহিনীর এই কুখ্যাত পূর্বপরিকল্পিত ন্যায়নীতি বহির্ভূত গণহত্যাটি 'অপারেশন সার্চ লাইট' নামে পরিচিতি।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই হানাদার বাহিনীর হামলার জবাবে ভীত কিংবা হতবিহ্বল না হয়ে, সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈনিক বিশ্বের মাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সরাসরি বিদ্রোহ করে দেশের মুক্তি-সংগ্রামে অংশ নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের দুরন্ত, অকুতোভয় বীর বাঙালি সদস্যদের নিয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিক, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সেনা অফিসারদের নেতৃত্বে শত্রম্নবাহিনীকে প্রতিরোধ করা শুরু করে।
১৯৭১ সালের ০৪ এপ্রিল সিলেট জেলার হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশন সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তাব, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ, সীমান্তবর্তী ভূখন্ড ব্যবহারের অনুমতি, একক কমান্ড চ্যানেল প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধ মনিটরিং সেল গঠন, সামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কমান্ডার নিয়োগ ও দায়িত্ব বণ্টনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ফোর্সেস গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আগের সিদ্ধান্তের আলোকে গোটা দেশকে চারটির স্থলে ছয়টি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ একটি সুপরিকল্পিত রূপ লাভ করে। পরবর্তীতে ১০ হতে ১৭ জুলাই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডারদের এক সম্মেলনে অপারেশন চালানোর সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর ও বিভিন্ন সাব-সেক্টরে বিভক্ত করে পেশাদার দুরন্ত, অকুতোভয় বীর বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের এসব সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর গঠিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের ওপর সেক্টরগুলোয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ সময় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরের পাশাপাশি বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রতিটি সেক্টরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলে মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগত যুবকদের স্বল্পসময়ের মধ্যে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি রেজিমেন্ট (১, ২, ৩, ৪ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল) ও পরবর্তী সময়ে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ৯, ১০ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেয়। এখানে উলেস্নখ্য যে, ১৯৭১ সালে ৫ ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তানের শিয়ালকোট সীমান্তে, ৬ ইস্ট বেঙ্গল পেশোয়ারে ও ৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট রাজস্থান মরুভূমিতে নিয়োজিত ছিল। পরবর্তীতে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মিত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য 'জেড ফোর্স', 'এস ফোর্স' ও 'কে ফোর্স' নামে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয়। এরই মধ্যে ১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই ময়মনসিংহের বিপরীতে তুরা পাহাড়ের পাদদেশে সংগঠিত হয়েছিল জেড ফোর্স। আগরতলায় ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে কে ফোর্স মেলাঘরে গঠন করা হয়। ২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ হেজামারা এস ফোর্স গঠিত হয়েছিল।
বিচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘ আট মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিপাগল দেশপ্রেমিকদের সম্মিলিত আক্রমণে যখন হানাদার বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ছিল, তখন জেনারেল ওসমানীসহ তৎকালীন উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করার জন্য ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক দূরদর্শী সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে চলমান যুদ্ধে নতুন গতিশীলতা আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাধ্য হতে থাকে পশ্চাৎপসরণে।
১৯৭১ সালের ০৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সশস্ত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটা এক মিনিটে লাখো জনতার সম্মুখে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অবনত মস্তকে প্রায় ৯৩ হাজার দখলদার হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও দখলদার হানাদার বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই আত্মসমর্পণের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রম্নপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ০৩ জন বীরশ্রেষ্ঠসহ ১ হাজার ৫৩৩ জন সেনাসদস্য শাহাদত বরণ করেন এবং ২৯১ জন সেনাসদস্য খেতাবপ্রাপ্ত হন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেমন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী সংকটের সময়েও জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সমানভাবে অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশের অখন্ডতা ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য জীবন দিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যে কোনো ক্রান্তিকালে দেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে র?্যাবের সদস্য হয়ে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের নেতৃত্ব দিয়ে সীমান্তকে সুরক্ষা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশাগত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে দেশ ও জাতির ওপর অর্পিত দায়িত্বও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে আসছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরি করে দেশ-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। পদ্মা সেতু, জাতীয় মহাসড়ক, মহিপাল ফ্লাইওভার, মিরপুর এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার, বনানী লেভেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, ৩০০ ফিট পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, ১০০ ফিট খাল খনন প্রকল্প হাতিরঝিল, স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতাবিশিষ্ট বর্ডার সড়কসমূহ, মেরিন ড্রাইভসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনাসমূহ তৈরিতে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সশস্ত্র বাহিনী নানা ধরনের সামাজিক কর্মকান্ড অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করেছে। তার অন্যতম উদাহরণ মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে লকডাউন কার্যকর, ত্রাণ সহায়তা, বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসহ করোনা মোকাবিলায় রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
শুধু দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতেও আমাদের সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ জাতিসংঘ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, কসেভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর, সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, কঙ্গো, হাইতি, লেবানন, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য সুনামের সঙ্গে কাজ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আর্থসামাজিক ক্ষেত্রসহ পুনর্বাসন ক্ষেত্রে এনেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এখন বাংলাদেশকে শান্তি রক্ষা মিশনের জন্য একটি মডেল হিসেবে গণ্য করে।
যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেই জনগণের আস্থা ও ভরসার নাম সেনাবাহিনী, সব সময়ই দুর্গত মানুষের পাশে থেকেছে সেনাসদস্যরা। ২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০২০ সালে আম্ফান এবং অতিসম্প্রতি ২০২৪-এর আগস্ট মাসে ফেনী-কুমিলস্না অঞ্চলে বন্যাদুর্গত অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে উদ্ধার, ত্রাণ তৎপরতা ও পুনর্বাসনে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হয়েছে জনগণের কাছে প্রশংসিত। এছাড়া, বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে সেনা সদস্যরা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন।
২০২৪-এর এই গণ-অভু্যত্থান এবং পরবর্তী সংকটময় সময়ে বর্তমান সেনাপ্রধান এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধান খুব সুন্দরভাবে ও অসাধারণ পরিপক্বতার সঙ্গে দেশের দায়িত্ব ড. ইউনূস সরকারের কাছে হস্তান্তর করেন। সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী প্রায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে অনেক সংকট ও সমস্যা সমাধানে সরকারকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। বিশেষত সরকার গঠনের প্রথম দিকে বাংলাদেশ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ও করছে। ডাকাতি, আনসার বিদ্রোহ, গার্মেন্টস, শ্রমিকদের নৈরাজ্যমূলক কর্মকান্ড দমনে এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সেনাবাহিনী অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে এবং তা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়।
সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ পেশাগত উৎকর্ষে বিশ্বের যে কোনো বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়। মিসাইল, আধুনিক ট্যাংক ও গোলন্দাজ বাহিনীর সব শাখাসহ সেনাবাহিনী এমন সব উপাদান সহকারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে নিজস্ব বিদ্যাপীঠ ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। বর্তমান সময়ে সেনাবাহিনীর প্রতিটি শাখাকে আধুনিক সমরাস্ত্র ও উপকরণ দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন, সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, দু'টি পদাতিক ব্রিগেড, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন ছাড়াও ১০টি ব্যাটালিয়ন, এনডিসি, বিপসট, এএফএমসি, এমআইএসটি ও জেসিও-এনসিও'স একাডেমির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সেনাবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। রণক্ষেত্রে জন্ম নেওয়া একটি সেনাবাহিনী অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ অনেক দক্ষ, সুসংগঠিত এবং দেশ-বিদেশে প্রশংসিত। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা দেশপ্রেমিক গণমানুষের কাছে পাথেয় হয়ে আছে এবং থাকবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভূখন্ডের অখন্ডতা রক্ষার দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি জাতির বিভিন্ন সংকট ও ক্রান্তিকালীন সময়ে যথাযথ ভূমিকা পালন ও অবদান রাখার দৃষ্টান্তে আমাদের সেনাবাহিনী নিয়ে আজ এদেশের আপামর জনসাধারণ গর্বিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বপরিমন্ডলে আজ একটি পরিচিত এবং গর্বিত নাম। জাতির গর্বে গর্বিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাই আজ জাতির আস্থার প্রতীক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সব সাফল্যমন্ডিত কর্মকান্ড বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিসরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে বিশাল সম্মান বয়ে এনেছে তা শুধু সেনাবাহিনীর নয় বরং এদেশের সবার অহংকার ও গৌরব।
কর্নেল এ এস এম নাছের :সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা