মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

আইনের আওতায় আনতে হবে অপরাধীদের

চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই অসহায় মানুষের ওপর হামলে পড়ছে দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের হামলায় ঘটছে নির্মম মৃতু্যর ঘটনা। রাস্তায় নেমে মহাসড়কে চরম নিরাপত্তাহীনতার প্রতিবাদ জানিয়েছেন যানবাহনের চালকরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বেশিরভাগ এলাকায় অভিন্ন চেহারার অপরাধীরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
আর কে চৌধুরী
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আইনের আওতায় আনতে হবে অপরাধীদের

২৩ ফেব্রম্নয়ারি রাতে রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে তার কাছে থাকা ২০০ ভরি সোনা এবং নগদ এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গুলিবিদ্ধ স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নাম আনোয়ার হোসেন। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির শংকর এলাকায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে একদল ব্যক্তির সশস্ত্র মহড়া দেওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। স্থানীয়রা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেন যে, 'মহলস্নায় ডাকাত দল প্রবেশ করেছে।'

এই দুটি ঘটনার দিকে তাকালে বোঝা যায়, অপরাধীরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। এক সময় বহুতল ভবনগুলোকে আবাসস্থল হিসেবে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ভাবা হতো। সেসব ভবনেও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা। রাজধানীর সড়কগুলো ছিনতাইয়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। জুলাই গণ-অভু্যত্থানের অর্জন গিলে খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলার দুরবস্থা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এগুলো দেখার দায়িত্ব যাদের, তারা আত্মপ্রসাদে ভুগছেন। একজন তো বলেই বসেছেন, আইনশৃঙ্খলার অবস্থা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। কথায় বলে শুকনো কথায় চিড়ে ভিজে না। কর্তাব্যক্তিরা দাবি করলেই আইনশৃঙ্খলায় স্বস্তি আসবে, তা ভাবার কোনো যুক্তি নেই।

চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই অসহায় মানুষের ওপর হামলে পড়ছে দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের হামলায় ঘটছে নির্মম মৃতু্যর ঘটনা। রাস্তায় নেমে মহাসড়কে চরম নিরাপত্তাহীনতার প্রতিবাদ জানিয়েছেন যানবাহনের চালকরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বেশিরভাগ এলাকায় অভিন্ন চেহারার অপরাধীরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কেবল পরিবর্তন হয়েছে তাদের পৃষ্ঠপোষক। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে না দেখলে কোনোভাবেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছিনতাইয়ের দৃশ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে রাতের কোনো এক সময়ে একটি মোটর সাইকেলে করে তিনজন যুবক এসে থামে। কয়েক সেকেন্ড পর পেছন থেকে রিকশায় আসছিলেন দুই যাত্রী। মুহূর্তেই তারা চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। প্রাণভয়ে পালিয়ে যান রিকশাচালক। নির্বিঘ্নে ছিনতাই শেষে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জনপদ মানুষ শকুনদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। পৌনে ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী সরকারের দুর্নীতি-অপরাধ ঢাকা পড়ছে দুর্বৃত্তদের কর্মকান্ডে। দেশের মানুষ দুটি ব্যাপারে স্পর্শকাতর। এর একটি হলো দ্রব্যমূল্য, আরেকটি আইনশৃঙ্খলা। তাই সরকারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে নিজেদের স্বার্থেই।

আবার আলোচনার বিষয় 'কিশোর গ্যাং'। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে উঠতি বয়সি কিছু কিশোর। স্কুল-কলেজের গন্ডি পার হওয়ার আগেই কিশোরদের একটি অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া-মহলস্নায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয় তারা। দেশে চলমান বিশেষ অভিযানের (অপারেশন ডেভিল হান্ট) মধ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের নৃশংসতার অনেক অভিযোগ দেশের বিভিন্ন থানায় জমা পড়েছে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। দেশজুড়ে নতুন কৌশলে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়েছে। প্রতিদিনই তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড নিয়ে অভিযোগ উঠছে। খোদ পুলিশের ওপরও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে তারা।

সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে দুজনকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালনা নিয়ে কথাকাটাকাটির জেরে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পুলিশের তথ্যানুযায়ী গত বছরের এপ্রিলের আগে রাজধানীতে অন্তত ১২৭টি কিশোর-তরুণ গ্যাং সক্রিয় ছিল। ঢাকার মধ্যে আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি, প্রায় দুই হাজার সদস্য রয়েছে। মিরপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন মহলস্না, ডেমরাসহ রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকান্ড আগের চেয়ে বেড়েছে। সারাদেশে ছিল ২২৭টি গ্যাং। এ দেশের প্রতিটি থানায় তাদের তালিকা ছিল। তবে, গত ৫ আগস্টের আগে ও পরে দেশের বেশিরভাগ থানা ধ্বংস হওয়ায় সেই তালিকাও ধ্বংস হয়েছে। থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সময় বদলালেও পাল্টায়নি কিশোর-তরুণদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড। বিগত সরকারের সময়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে শুরু করে কিছু রাজনৈতিক নেতা তাদের শেল্টার দিতেন। বর্তমানে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে সমাজে নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়া কিছু উঠতি সন্ত্রাসী। এছাড়া রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় জামিনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও এখন কিশোর গ্যাংকে শেল্টার দিচ্ছে। কিশোর-তরুণ গ্যাং নিয়ন্ত্রণই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

দেশের সর্বত্র কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ব্যাপক বেড়েছে। হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে অপরাধী হিসেবে তারা কাজ করছে। সরকার পরিবর্তনের পর তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, পেশাদার খুনিসহ বেশ কয়েকজন ভয়ংকর অপরাধী জামিনে বের হয়েই নিজ নিজ অপরাধের সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। আবার ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের সময় থানা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের একটি বড় অংশ এখনো উদ্ধার করা যায়নি।

কিশোর গ্যাং বা সন্ত্রাসী এই গোষ্ঠীর তৈরি হলো কেন? কেনই বা তারা এত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। কিশোর বয়সে হিরোইজমের প্রবণতা থাকে। আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের 'গ্যাং কালচার' গড়ে উঠছে। কিশোর গ্যাং কালচার নির্মূলে মদতদাতাদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নিতে হবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে