প্রায় দুইশত বছর পূর্বে আবিষ্কৃত চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে প্রতি বছর সরকার প্রায় দুইশত কোটি টাকা ব্যয় করে আসছে। আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা বিজ্ঞানকে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করেনি। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, স্বাস্থ্য সচিবরা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিকল্প চিকিৎস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, হোমিও ও দেশজ চিকিৎসা পরিদপ্তর, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের নজরে না এলেও নজরে এসেছে এ দেশের অবহেলিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সমাজের দৃষ্টিতে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগারোগ্যের সফলতা ১৯৮৪ সালে উপলব্ধি করেছিলেন বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা মানবতার ফেরিওয়ালা জাতীয় অধ্যাপক মরহুম ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান।
গত ৮ ফেব্রম্নয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পৃঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে খ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি কিংবা এএমসি (অষঃবৎহধঃরাব গবফরপধষ ঈধৎব) সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ ২০১৫ সালে বিবিসি ও আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ জরিপ অনুযায়ী দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। ১৯৮৩ সালে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেসরকারিভাবে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে এবং ১৯৮৯ সালে ঢাকার মিরপুরে সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (১০০ শয্যাবিশিষ্ট) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে এমবিবিএস সমমানের বিএইচএমএস (ব্যাচেলর অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি) ডিগ্রি অর্জন করার সিস্টেম চালু আছে। বিএইচএমএস (ব্যাচেলর অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি) কোর্সটির মেয়াদ ১ বছর ইন্টার্নিসহ মোট ৬ (ছয়) বছর। এমবিবিএস-এর ন্যায় কোর্সটির ভর্তি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশন।
এছাড়া, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ৬৬টি বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক ডিপেস্নামা মেডিকেল কলেজে ডিএইচএমএস (ডিপেস্নামা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি) কোর্স চলমান। কোর্সটির মেয়াদ ৬ মাস ইন্টার্নিসহ মোট সাড়ে ৪ (চার) বছর। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৪০০ (চব্বিশ শত) রেজিস্টার্ড বিএইচএমএস ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) ডিএইচএমএস রেজিস্টার্ড চিকিৎসকসহ রেজিস্ট্রেশনবিহীন আছেন আরও প্রায় কয়েকগুণ। যারা নানা মাধ্যমে দেশের মানুষকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। গত ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪ এ জাতীয় দৈনিক 'খবরের কাগজ' এ প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) গত ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত জরিপের প্রতিবেদনে ২১টি মেথডে দেশের মানুষের চিকিৎসার চিত্র উলেস্নখ- পরিবারের সদস্যের কাছে বা নিজে নিজে চিকিৎসা নেন ১.২২ শতাংশ; কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ১.১৬ শতাংশ; ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপকেন্দ্র থেকে ০.৪৮ শতাংশ; হেকিম আয়ুর্বেদ থেকে ০.৪৮ শতাংশ; সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে মাত্র ০.৪৭ শতাংশ; এনজিওর ক্লিনিক থেকে ০.৪৬ শতাংশ; মাতৃ ও শিশু সেবা কেন্দ্র থেকে ০.২৮ শতাংশ; সরকারি স্যাটেলাইট ক্লিনিক থেকে ০.২১ শতাংশ; বিভিন্ন এনজিওর স্বাস্থ্য কর্মীদের মাধ্যমে ০.১৩ শতাংশ; কবিরাজ, পীর, ফকির, তান্ত্রিক, ওঝা থেকে ০.০৭ শতাংশ; এবং অন্যান্য পদ্ধতির চিকিৎসা নেন ০.৩৭ শতাংশ, কিন্তু 'হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারদের কাছে থেকে চিকিৎসা নেন ১.৫৬ শতাংশ'- যা হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত বাস্তবতা।
সাম্প্রতিক ৫৩৫/২০১৯নং রিট মামলায় হোমিওপ্যাথিক বিষয়ে হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাদের পর্যবেক্ষণে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্বন্ধে বলেছেন, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি। আদালত আরও বলেন- ডঐঙ-এর ১৯৪টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১১০টি সদস্য রাষ্ট্র হোমিওপ্যাথিকসহ বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির আইন ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রণয়ন করেছে। বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে 'ভারতের আয়ুশ মন্ত্রণালয়ের আদলে বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করতে আদালত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে'। যেমন ভারত সরকার 'মিনিস্ট্রি অব আয়ুশ' তৈরি করেছে। আদালত বলেছেন, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী বিকল্প ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। এর কারণ- (১) সহজলভ্যতা, (২) স্বল্প খরচ, (৩) অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার তুলনায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম, (৪) প্রচলিত চিকিৎসা এবং অপ্রতুলতা ইত্যাদি।
বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের অধীনে এএমসি (অষঃবৎহধঃরাব গবফরপধষ ঈধৎব) হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৭২ সালে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার অভিভাবকত্বের লক্ষ্যে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স অধ্যাদেশ জারি হলে বোর্ডটি স্বায়ত্তশাসনের অধীনে আসে। ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স অধ্যাদেশ ১৯৮৩ রহিতকরণ করে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন-২০২৩ সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে এবং ১৩ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে আইনটি বাংলাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
আইন অনুযায়ী 'বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ড' 'হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলে পরিণত হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ওই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং রেজিস্ট্রার উভয়েই যথাক্রমে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং কাউন্সিলের অতিরিক্ত দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। আশা করি, সরকার অনতিবিলম্বে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের সমন্বয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ পূণাঙ্গ কাউন্সিল গঠন করে প্রকৃত বাড়ির মালিকদের কাছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের চাবি হস্তান্তর করবেন। আপনার জ্ঞাথার্থে জানাতে চাই সুস্থ মানবদেহে ওষুধের লক্ষণ উৎপাদন ক্ষমতা পরীক্ষিত, ক্ষুদ্রতর থেকে ক্ষুদ্রতম মাত্রা অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্রতম মাত্রায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্বানুযায়ী শক্তিকৃত, ওষুধের উৎপাদন ক্ষমতার সঙ্গে রোগীর কাছে থেকে প্রাপ্ত লক্ষণের সদৃশ, সূক্ষ্ণমাত্রায় একটি মাত্র ওষুধে চিকিৎসা পদ্ধতির নাম হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু প্রকৃত মালিক না থাকায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ও শিক্ষার বেহাল দশার ফলে সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষা ছাড়াই প্রস্তুতকৃত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নামে তথাকথিত ওষুধ নামীয় পেটেন্ট, টনিক, মিকচার বাজারজাত করে আসছে তথাকথিত ওষুধ ব্যবসায়ীরা। যা আদৌ হোমিওপ্যাথিক ওষুধ হতে পারে না। তাছাড়া, রোগীকে এক সময়ে একটি মাত্র ওষুধ প্রয়োগে আইনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও হোমিওপ্যাথির নামে একই সময়ে একাধিক থেকে আরম্ভ করে বহু ওষুধ একসঙ্গে প্রয়োগের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে জনসাধারণ এবং অসুস্থ মানুষ অর্থনৈতিক এবং অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ সমস্ত জনহিতকর অবৈধ কর্মকান্ডগুলো দেখভাল করার সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ওষুধের স্থূল মাত্রার ব্যবহারের পরিবর্তে বৃহৎ মাত্রায় ওষুধ ব্যবহার জনস্বাস্থ্য হুমকির পথে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ হচ্ছে- মেটেরিয়া মেডিকা, অর্গ্যানন অব মেডিসিন এবং ক্রনিক ডিজিজ ইত্যাদি মৌলিক গ্রন্থের অনুকরণে ওষুধ নির্বাচনে মৌলিক স্বাস্থ্য খাত সংস্কার অতীব জরুরি। এক নজরে বাংলাদেশে বর্তমানে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা, শিক্ষা ও ঔষধ শিল্পের বাস্তব চিত্র :
ক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিবিএস-এর সমমানের একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ রয়েছে। ওই কলেজসমূহে আইএসসি পাসের পর ৬ বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (বি এইচ এম এস) কোর্স প্রচলিত রয়েছে। খ. চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচালনায় ১টি কলেজসহ ডিপেস্নামা পর্যায়ের অথ্যাৎ ডিএইচএমএস কোর্সের সাড়ে চার বছরের শিক্ষা কার্যক্রমে ৬৬টি বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ রয়েছে। ওই কোর্সের নাম ডিপেস্নামা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি। যা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত। গ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল মেডিকেল সেন্টারে, বুয়েট-এর মেডিকেল সেন্টারে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৫০টি কেন্দ্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণ কর্মরত। দেশের সরকারি ও কিছু কিছু বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হোমিওপ্যাথিক ইউনিটে চিকিৎসকরা কর্মরত। সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও অন্তবিভাগে চিকিৎসকরা কর্মরত। বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক ডিপেস্নামা মেডিকেল কলেজ সমূহের বহির্বিভাগে অনেক চিকিৎসক কর্মরত এবং প্রতিদিন হাজার হাজার রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। ঘ. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পরিদপ্তর রয়েছে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকল্প চিকিৎসা অধিদপ্তরের অন্তর্ভুক্ত। ঙ. প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আমদানি হয়ে আসছে এবং অনেক দেশীয় হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রস্তুত কারখানা রয়েছে। যেখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ওষুধ শিল্পের পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ মাননিয়ন্ত্রণ নির্ণয়ের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থায়ী কোনো পদ নেই। চ. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য প্রতি বছর সরকার প্রায় দুইশত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে আসছেন ইত্যাদি। ছ. বাংলাদেশের প্রতিটি বাজারে নিজস্ব চেম্বারে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়াও অনেক হোমিও দাতব্য চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র রয়েছে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য নিম্নের প্রস্তাবনাসমূহ স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনে অন্তর্ভুক্তির একান্ত অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
১) যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে প্রতি বছর সরকার প্রায় দুইশত কোটি টাকা ব্যয় করে আসছে এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা বিজ্ঞানকে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করেননি। ওই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্তকরণের একান্ত অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। ২) আইন অনুযায়ী পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত চিকিৎসকদের সমন্বয়ে অতি তাড়াতাড়ি চেয়ারম্যানসহ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিল গঠন করার একান্ত অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। ৩) হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের সব নিয়ন্ত্রক পদে পেশার সঙ্গে সম্পৃক্তদের নিয়োগ দিতে হবে। কাউন্সিলের প্রতিনিধি নির্বাচনে সরাসরি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের ভোটাধিকার চাই। ৪) সরকারি উদ্যোগে পূর্ণাঙ্গ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হোমিওপ্যাথিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, বিশেষায়িত হাসপাতালে হোমিওপ্যাথিক ইউনিটসহ ভারতের আয়ুশের মতো পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করতে হবে। ৫) সব হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে ইনডোর ও আউটডোর হাসপাতালে ইন্টার্নি চিকিৎসকদের ভাতা চালু এবং উচ্চশিক্ষার অধিকারসহ ডিপেস্নামা চিকিৎসকদের পূর্বের ন্যায় বিএইচএমএস ৪র্থ বর্ষে ভর্তির সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। ৬) হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ সরকারিকরণ, হোমিওপ্যাথদের সনদের মান নির্ধারণ, ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে চিকিৎসকদের নিয়োগের স্থগিতাদেশ বাতিল এবং নিয়োগ বাস্তবায়ন চাই। ৭) মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত চিকিৎসক; সব সরকারি হাসপাতালসহ পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, সিটি কর্পোরেশন, কমিউনিটি ক্লিনিক, দাতব্য চিকিৎসালয়; সশস্ত্র বাহিনী, কারাগার, পুনর্বাসন কেন্দ্র, হজ্জ যাত্রী স্বাস্থ্য সেবা নীতিমালা এবং বিসিএস (স্বাস্থ্য) সার্ভিসে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৮) জনস্বার্থে অবিলম্বে পেটেন্ট-টনিক-মিকচারের অনুমোদন বাতিলসহ বিদেশ থেকে পেটেন্ট/ কম্বিনেশন আমদানি ও দেশীয় কম্বিনেশন বা মিশ্রণ ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ায় লিপিবদ্ধকৃত অর্গানন অব মেডিসিন, ক্রনিক ডিজিজসহ হোমিওপ্যাথির মৌলিক নীতিমালা পরিপন্থি সব ধারা-উপধারা বাতিল করতে হবে। জনস্বার্থে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নামে প্রতারণা এবং ওষুধের অপব্যবহার বন্ধ করতে অভিযান চালুসহ হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নামে ভেজাল ওষুধ এবং রেকটিফাইড স্প্রিরিট বিক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। ৯) নিরাময় অযোগ্য রোগীদের প্যালিয়েটিভ সেবায় হোমিওপ্যাথদের যুক্ত করে গবেষণার দ্বার উন্মোচন এবং ড্রাগ ডিরেক্টরিসহ জাতীয় তথ্য বাতায়নে হোমিওপ্যাথি সেবা যুক্ত করতে হবে। ১০) হোমিওপ্যাথিক ওষুধ মূলত এক প্রকার অদৃশ্য শক্তি। শক্তির কোনো সৃষ্টি কিংবা বিনাশ নেই- আছে কেবল রূপান্তর। শক্তিকৃত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শক্তিকে পচনরোধক সুরাসারের মাধ্যমে বোতলে বাজারজাত করা হয়। এতে আদৌ পচন বা কার্যকারিতা নষ্টের সম্ভাবনা নেই। সুতরাং, শক্তিকৃত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের অযৌক্তিক মেয়াদকাল বাতিল করতে হবে। ১১) 'ড্রাগ লাইসেন্স (হোমিওপ্যাথি)' নামে আলাদা ফরমেট চাই। রেজিস্টার্ড প্র্যাক্টিশনারদের নিজস্ব ফার্মেসির ড্রাগ লাইসেন্স প্রথা বাতিল করতে হবে। লাগামহীন ঘুষ-দুর্নীতি ও হয়রানি এড়াতে ড্রাগ লাইসেন্সের আবেদন ও নবায়নে শতভাগ অনলাইন সিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে। ১২) এন্টিবায়োটিক দিন দিন উদ্বেগজনক হারে অকার্যকর হচ্ছে। গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ভয়াবহ রিপোর্ট- 'প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে বেশিরভাগ এন্টিবায়োটিক এখন ৯০ শতাংশ অকার্যকর।' সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসার অত্যাবশ্যক। তাছাড়া, ২০১৫ সালে বিবিসি ও আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ জরিপ অনুযায়ী দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ ভাগ মানুষ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন।
এমতাবস্থায় কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য বাজেটের ২০ শতাংশ অর্থ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ চাই। ১৩) হোমিওপ্যথিক সেক্টরের ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ এবং চিকিৎসক রেজিস্ট্রেশন নবায়ন প্রথা বাতিলসহ বিএমডিসি'র আদলে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক যাচাইকরণ ওয়েবসাইট চালু করতে হবে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে ৫৩৫/২০১৯ নং রিট মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, বিগত দিনে বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মরহুম ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিমসহ অ্যালোপ্যাথিক অধ্যাপকরা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নানের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এ মহান পেশাকে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনে অন্তর্ভুক্তকরণ বিষয়টি এখন জাতীয় দাবি।
ডা. মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া : বিএইচএমএস (ঢাকা বিশ্ব), সাবেক সভাপতি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঐগঝ কোর্স অন্তর্ভুক্তিতে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রি (ইঐগঝ) কোর্স বাস্তবায়ন পরিষদ, সহকারী অধ্যাপক (অব.) সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদ, প্রধান উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী হোমিও আন্দোলন বাংলাদেশ ও প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ অনলাই হোমিওপ্যাথিক ফোরাম (ইঙঐঋ)