সুস্থ জনগোষ্ঠী এবং সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্কটা অত্যন্ত নিবিড়। পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে মানুষ পরিবেশকে নানাভাবে ব্যবহার করেছে। যার ফলে, প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে গড়ে উঠেছে মানবসৃষ্ট পরিবেশ। এই পরিবেশেই আছে আমাদের জীবন ধারণের নানা উপাদান। আবার এই পরিবেশেই থাকতে পারে হাজার রোগের উপকরণ। এরকম একটি ভয়ংকর উপাদান হলো ধূমপান থেকে নির্গত ধোঁয়া। সিগারেটের ধোঁয়ায় মিউটাজেন থাকে- যা মানুষের মুখ, শ্বাসনালি এবং ফুসফুসে ক্যানসার সৃষ্টি করে। ধূমপানে সিগারেটের নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিরাজমান। ধূমপান বহু জীবনঘাতী রোগের প্রত্যক্ষ কারণ। যখন কেউ নিজে সরাসরি ধূমপান না করেও অন্যের ধূমপান থেকে নির্গত ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, সেটিকেই পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়ে থাকে। পরোক্ষ ধূমপান আরও বেশি ক্ষতিকর। কিন্তু ধূমপায়ীরা পরোক্ষ ধূমপান যে মানব শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেটা মাথাতেই রাখতে চায় না।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ তামাক ব্যবহার করছে। তবে, এ সংখ্যার চেয়েও আরও বেশি আশঙ্কাজনক পরোক্ষ ধূমপানের হার। বর্তমানে বাংলাদেশে ধূমপান না করেও বিভিন্ন পাবলিক পেস্নস ও পাবলিক পরিবহণে প্রতিনিয়ত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। পরোক্ষ ধূমপানের হার এভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ অসচেতনতা এবং আইনের বাস্তবায়নহীনতা। প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর করা সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, পরোক্ষ ধূমপানের মাধ্যমে বাড়ির অন্যদের ক্ষতি হওয়ার বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অপ্রতুলতাই মূলত দায়ী। যারা ধূমপান করেন তারা শুধু নিজেদের ক্ষতি করেন তা নয়, পাশাপাশি আশপাশে যারা থাকে বিশেষত শিশুদের ক্ষতি করে থাকেন। কারণ পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষেত্রে শিশুরা বড়দের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। শিশুদের ওপর পরোক্ষ ধূমপানের প্রধান ক্ষতিকর দিকগুলো হলো, কানের সংক্রমণ, অতি ঘন ঘন ও তীব্র অ্যাজমা অ্যাটাক এবং শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশে সংক্রমণ। এর বাইরেও যেসব শিশু পরোক্ষ ধূমপানের মুখোমুখি হয়, তারা পরবর্তী সময়ে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, বিপাক প্রক্রিয়ার রোগ, বন্ধ্যাত্বসহ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে নিয়মিত ধূমপায়ী হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন তামাকের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে মানুষকে মৃতু্যর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইউনিয়ন সমীক্ষা বলছে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সেই বাংলাদেশি শিশুদের ৪২ শতাংশ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বাংলাদেশে মোট মৃতু্যর ৭১ শতাংশই অসংক্রামক রোগের কারণে ঘটছে। প্রতিরোধযোগ্য এই মৃতু্যর অন্যতম কারণ তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার। কেবল তামাকজনিত পণ্য ব্যবহারের কারণেই বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৫৩ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। পঙ্গুত্ববরণ করে বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যানসার বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার (আইএআরসির) তথ্য অনুসারে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বজুড়ে ফুসফুসে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আইএআরসি জানিয়েছে, অধূমপায়ীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারকে এখন বিশ্বে ক্যানসারে মৃতু্যর পঞ্চম প্রধান কারণ বলেই মনে করা হচ্ছে। গবেষকরা ফুসফুস ক্যানসারের প্রধান চারটি উপধরনে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা জানতে পেরেছেন। ফুসফুস ক্যানসারের চারটি প্রধান উপধরন হলো- অ্যাডেনোকার্সিনোমা, স্কুয়ামাওয়াস সেল কার্সিনোমা, স্মল সেল কার্সিনোমা ও লার্জ সেল কার্সিনোমা। আইএআরসি-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী অধূমপায়ীরা এ ক্যানসারেই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী পুরুষ এবং নারী উভয়ের মধ্যেই এই ক্যানসার প্রকট হয়ে উঠছে। গত কয়েক দশকের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে উন্মুক্ত স্থানে ধূমপানের আধিক্য চোখে পড়ছে।
এর কারণ হিসেবে বলা যায়, পৃথিবীতে সর্বনিম্ন দামের সিগারেট লভ্যতার দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম, যেখানে প্রায় প্রত্যেকেই সিগারেট এবং স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত ফিল্টারবিহীন সিগারেট বা বিড়ি কিনতে সক্ষম। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ এর ২(চ) ধারা অনুসারে জনপরিসরে বা উন্মুক্ত স্থানে যেমন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস; গ্রন্থাগার, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, আদালত, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহণে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণের সম্মিলিত ব্যবহারের স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ। এমন স্থানে ধূমপান করলে অনধিক ৩০০ টাকা জরিমানা করার বিধান আছে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে তিনি দ্বিগুণ হারে দন্ডিত হবেন। অপ্রিয় হলেও সত্য ধূমপান নিয়ন্ত্রণে যে আইন আছে তা কখনোই প্রয়োগ হতে দেখা যায় না। সিগারেট ও বিড়ির ওপর কর বৃদ্ধি করেও ধূমপান হ্রাস করা যায়নি। বরঞ্চ শহরের যেখানে-সেখানে লোকসমাগমের জায়গায় সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকানে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় দিন দিন ধূমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ফলশ্রম্নতিতে অধূমপায়ীরা অধিক হারে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। পরোক্ষ ধূমপান থেকে অধূমপায়ী ব্যক্তিদের রক্ষার জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। কাগজে-কলমে 'সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ'-এর মাধ্যমে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে অধূমপায়ী নাগরিকদের রক্ষা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তাহলে সাধারণ জনগণও সহজে উন্মুক্ত ও জনসমাগম স্থানে ধূমপানের বিরুদ্ধে সহজেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে।
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও সময়োপযোগী করা দরকার। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তামাক কোম্পানি এবং তাদের পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠন আইন সংশোধনের বিরোধিতা করবে এবং বলার চেষ্টা করবে আইন সংশোধন হলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে তারপরও সরকারকে রাজস্ব আহরণের চেয়ে জনস্বাস্থ্যকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মাথায় রাখতে হবে তামাক কোম্পানিগুলো বছরে যে পরিমাণ রাজস্ব দেয় তামাকজনিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় তারচেয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়। অধূমপায়ীদের সুরক্ষা প্রদান এবং নতুন প্রজন্মকে তামাকের ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচাতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের যে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আশা করি, তা দ্রম্নতই বাস্তবায়ন করবে। বিষয়টির ভয়াবহতা বিবেচনায় আইন প্রণয়নের পাশাপাশি জনগণকেও যত্রতত্র ধূমপানের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
\হ
মো. তাহমিদ রহমান :শিক্ষক ও কলাম লেখক