জুলাই গণ-অভু্যত্থানের চেতনায় তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল 'জাতীয় নাগরিক পার্টি' আত্মপ্রকাশ করেছে। এক সমাবেশের মাধ্যমে নতুন এই দলটি যাত্রা শুরু করেছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, 'সেকেন্ড রিপাবলিক' (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা এই দলের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙ্গেপড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। তারা জুলাই বিপস্নব ২০২৪-এর চেতনায় একটি দেশ গড়তে চান। সেজন্য তারা সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছেন। এজন্য সংবিধান নতুন করে প্রণয়নের দরকার। যে সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছেন তারা- সেটা সাম্য, মানবিক ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে। এর সঙ্গে আছে সামাজিক সুবিচার। আমাদের যে সংবিধান আছে সেটা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করে না। এজন্যই আগে সংবিধান পরিবর্তন করা দরকার। আমাদের যে রিপাবলিক আছে তা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করেনি। বাংলাদেশে রেকর্ডসংখ্যক রাজনৈতিক দল থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক কাঠামো সংহত করা যায়নি। এর অন্যতম কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো বরাবর জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। তারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে যে নতুন দল গঠন করা হলো, তার মূল্যায়ন করতে হবে। এই দলের নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের প্রায় সবাই গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-অভু্যত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। নতুন দলের নেতাদের সবাই বয়সে নবীন, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও প্রাণশক্তিই তাদের প্রধান সম্বল। নতুন রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভাজনের রাজনীতির বদলে ঐক্যের রাজনীতি- 'সেকেন্ড রিপাবলিক' (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন, ভেঙ্গেপড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। ঘোষণাপত্রে নতুন 'রাজনৈতিক বন্দোবস্তের' মাধ্যমে গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্য ঘটেনি। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে জনগণের অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে হবে। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদন্ডে নেতৃত্ব নির্বাচনের পাশাপাশি সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় তুলে আনার কথাও বলা হয়েছে এতে।
আমরা যদি ইতিহাসে ফিরে তাকাই তাহলে দেখব, এ দেশে যতগুলো গণ-আন্দোলন ও অভু্যত্থান হয়েছে, তরুণরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা বিশেষভাবে উলেস্নখ করা যায়। যখন প্রবীণ নেতৃত্ব ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, ছাত্ররা তা অমান্য করে জীবন দিয়ে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভু্যত্থানেও সামনের সারিতে ছিলেন এই তরুণরা। যদিও এই দুই গণ-অভু্যত্থানের পর দেশের রাজনীতি তরুণদের হাতে ছিল না। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতারা যে তিন জোটের রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন, তা-ও তারা মান্য করেননি। যখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট থেকেছেন। তিনটি নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করায় কায়েম হয়েছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা। এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় তরুণরা যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছেন, তা জনমনে নিশ্চয়ই আশা জাগিয়েছে। নতুন দল যেসব কর্মসূচি ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে, তার সবটার সঙ্গে সবাই একমত না-ও হতে পারেন। কিন্তু তারা যে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে নিয়ে আসার এবং মেধা ও যোগ্যতার মানদন্ডে নেতৃত্ব তৈরির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। আমরা নতুন দলকে স্বাগত জানাই। তবে একই সঙ্গে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, তখনই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সফল হবে, যখন পুরনো রাজনীতির দুর্বলতা ও ক্ষতগুলো থেকে তারা নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবেন। অর্থায়নসহ দলের প্রতিটি কর্মকান্ডে যেমন সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে, তেমনি নেতৃত্ব নির্বাচনও হতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় দুর্বলতা হলো, রাজনীতিবিদরা অগণতান্ত্রিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, নতুন দল সেই পথে হাঁটবে না। তরুণদের নতুন দলের 'সেকেন্ড রিপাবলিক' এবং গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনার লক্ষ্যকে রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে দেখছে অন্য দলগুলো। তবে সরকার তাদের দাবির প্রতি ঝুঁকলে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। ঘোষিত নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেতারা বলছেন, বিষয়গুলো নিয়ে তারা জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করবেন। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করবেন। সেটা না হলে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। তবে সরকার যদি এনসিপির দাবি অনুযায়ী গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে যায়, জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়, তাহলে দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। তাদের অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন চাইতে হবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে।
জনগণের শক্তিকে ভয় পাওয়া অশুভ শক্তি নিজেদের অপকর্ম এবং অন্যায় অবস্থানের জন্য অপরাধবোধ প্রকাশের সৎ সাহস রাখে না। সেই অশুভ শক্তিই ইদানীং সমাজের চোরাগলিতে বলাবলি করছে, ক্ষমতার পরিবর্তনের পর গত ছয় মাসে দেশের অবস্থা কী যে হয়ে গেল! আজকের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, প্রতিষ্ঠানগুলোর ভগ্নদশা, রাজনৈতিক অবসাদ এবং সামাজিক অবক্ষয় যে পতিত সরকারের সৃষ্ট এবং রেখে যাওয়া, তা স্বীকার করা দূরে থাক, বিবেকহীনরা তা বুঝতে নারাজ। যেন হত্যাকান্ড, মেগা দুর্নীতি, বৈষম্য বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি বা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মতো ঘটনা ঘটেইনি বিগত আমলে! অজ্ঞাত স্থান থেকে কুকর্মকারীদের প্রতিশোধ ও নাশকতার ভাচর্ু্যয়াল হুমকি বলে দেয়, ক্ষমতার রাজনীতিতে কতটা ভয়ংকর এই ফ্যাসিবাদী শক্তি।
তবু 'অন্ধকার যুগ বনাম নতুন সম্ভাবনার অনিশ্চিত সময়' নিয়ে কোনো বিতর্কে আওয়ামী চেতনার ধ্বজাধারীদের যুক্তি অকাট্য হলে তা এত ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা কেন? কারণ, ওটাই পুরনো রাজনীতির নমুনা : নিজের মিথ্যা আড়াল কর এবং আরেকজনের সত্যকে অস্বীকার করতে থাক; ফলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে স্বীয় স্বার্থ উদ্ধার করা সহজ হবে, প্রতিপক্ষও ভিলেন বনে যাবে। কী সহজ সমীকরণ নির্ণয় করে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ! বিএনপি-জামায়াতকে গালাগাল দাও, ক্ষমতায় টেকার নাটক সাজাও। তিন তিনটি জোচ্চুরির জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার পর ২০২৪-এর ১০ জানুয়ারি ঢাকার এক সমাবেশে জবরদখলকারী প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেছিলেন, আমরা জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটে অংশ নিয়েছে। বিএনপির জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাঝেও তারা নিজের ভোট নিজে দিয়েছে। তার নির্লজ্জ মিথ্যার রাজনীতি ও রাজত্ব শেষ হয় সংক্ষুব্ধ জনতার চূড়ান্ত প্রতিরোধে। ৫ আগস্টের ক্ষমতার পরিবর্তন শুধু এক দিনের ঘটনা নয়, সেটি ছিল নতুন রাজনীতির ধারার সূচনালগ্ন। হাসিনার বিদায়ের অন্যতম সুফল হলো- অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি এবং সংস্কারের মাধ্যমে তার উপযোগী পরিবেশ তৈরির তাগিদ। ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ অবশ্যই আরেকটি ধাপ। এসব বিষয়ে আমরা যে নানা তর্ক-বিতর্ক করছি, সেটি পর্যন্ত অসম্ভব ছিল ফ্যাসিবাদী যুগে। সুতরাং 'ফুল ফুটুক না-ই ফুটুক আজ বসন্ত'। ওই কবিতার মতোই বাংলাদেশ এখন নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে, তা সবাই দেখুক আর না-ই দেখুক। 'আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে/তারপর খুলে-/মৃতু্যর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে/তারপর তুলে-/যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে/যেন না ফেরে।' কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চাননি পুরনোয় ফিরে যেতে। আমরা ২০২৪-এর আগস্ট-পূর্ববর্তী আমলের রাজনৈতিক ধারায় ফেরার ওকালতি করব কোন মুখে? যে রাজনীতি ছিল মিথু্যকের বন্দনা, দুর্নীতিবাজের আরাধনা, অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দান, ভন্ডের অশ্রম্নবিসর্জনের সার্কাস প্রদর্শন, গণশত্রম্নর শাসন নির্বিঘ্ন এবং চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা, নিষ্ঠুরের জয়গান গাওয়া আর শোনা, বর্বরের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান; সে রাজনীতিতে আমরা কেন ফিরব? আসলে এই শতাব্দীর শুরুতে একশ্রেণির রাজনীতিকদের নীতিহীন কর্মকান্ড ও বিরাজনীতিকীকরণে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্যেই চালাকি, বজ্জাতি আর ভয় দেখানোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে মানুষ ভেতরে ভেতরে প্রত্যাখ্যান করায় পুরোনো রাজনীতি অচল হয়ে পড়েছিল অনেক আগেই।
কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ঝোড়ো হাওয়ার মতো বিপস্নব ঘটায়। রক্তের অক্ষরে লিখে তুলে ধরে নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা। তারপরও সেকেলে মানসিকতার রাজনীতিকদের অপ্রাসঙ্গিকতা আরও পরিষ্কার হয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জমানায়। কী বয়ান নিয়ে রাজনীতি করবেন যেখানে দলীয় সরকার নেই, নেই রাজনৈতিক মাঠের সংজ্ঞায়িত শত্রম্ন। তাই কিছু আওয়ামী প্রলাপ এখনো প্রতিধ্বনিত হয় এখানে সেখানে। সে ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত নতুন রাজনীতির ধারণাটা কী হতে পারে? ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের সমমর্যাদা, সম্ভাবনার বিকাশ, সত্য, শান্তি, সৌহার্দ্য, ন্যায়নিষ্ঠতা, নিয়মকানুন বা সভ্য মূল্যবোধ অনুসরণের জন্য কাজ করবে যে রাজনীতি, তা-ই হয়তো আজকের প্রজন্মের প্রত্যাশা। জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে যে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটল জুলাই-আগস্ট বিপস্নবের ছাত্র নেতৃত্বের হাত ধরে, তার চ্যালেঞ্জ হবে জনগণকে বিকল্প রাজনীতির মডেল উপহার দেওয়া। পরিবর্তিত সংস্কৃতির দলটি প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি করবে না, কাজ করবে দেশ ও জনগণের চলমান ও ভবিষ্যৎমুখী নানা ইসু্য নিয়ে। সে দলের সব কর্মকান্ড হবে স্বচ্ছ এবং নেতৃত্ব সর্বদা অনুসরণ করবে গণতান্ত্রিক পথ। এই আমাদের প্রত্যাশা। এই দলকে আমরা সেই জায়গায় দেখতে চাই না, যে দল নতুন রাজনীতির 'সোল এজেন্ট' হিসেবে নিজেকে দাবি করে বসবে না বরং রাজনৈতিক বিতর্কে ন্যায্য দাবি বা যুক্তি মেনে নিতে নমনীয়তা দেখাবে। অন্যদিকে আমাদের সেই রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানো দরকার, যেখানে যে বা যারা বারবার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও ভোটাধিকার প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত করেছে এবং জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই দলের নাম যা-ই হোক, তার ভাবী গণতন্ত্রে রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না। বিগত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখা বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য দলেরও নতুন রাজনীতি নিয়ে কথা বলা এবং জাতীয় সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ না থাকার কারণ নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়াও আধুনিক মানুষ পরিবার, প্রজন্ম, প্রতিবেশ, পরিবেশ, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, ব্যবসা, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, নৈতিকতা, জনকল্যাণের সামাজিক বন্দোবস্ত ইত্যাদি অনেক বিষয়ে চিন্তিত। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ ও বাগাড়ম্বর বাদ দিলেও রাজনীতিকদের ইসু্যর কোনো অভাব হওয়ার কথা নয়। দেশবাসী আশা করে, রাজনীতি হবে তাদের কল্যাণে এবং রাজনীতিকেরা জনগণের সমস্যা ও মনের ভাব দ্রম্নতই বুঝতে পারবেন। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে এমনটা ছিল না। আমরা যদি ইচ্ছাশক্তি ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে নতুন রাজনীতি সমাজ ও জাতিকে আগামীর পথ দেখাবে, রাজনীতিকেরা সেই যাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন। এর অন্যথা জনগণের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না।
দলটির সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক প্রসঙ্গে নতুন দলের (এনসিপি) সম্মেলনে আসার জন্য জাতীয় নাগরিক কমিটির জন্য পিরোজপুর জেলার ডিসি ছয়টি বাস রিকু্যইজিশন করেছেন বলে তার আদেশের কপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়, ছাত্র সমন্বয়কদের প্রটোকল দেওয়ার জন্য। ফলে তাদের প্রতি যে সরকারের আনুকূল্য আছে তা বোঝা যায়। এখান থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর তারা নির্বাচন পেছানোর নানা ইসু্য তৈরি করতে পারে। যেমন- তারা বলছে বিচার শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন নয়। তাহলে নির্বাচন কবে হবে? প্রধান উপদেষ্টা বলছেন, সংস্কারের ব্যাপারে সবাই যদি একমত হতে না পারেন, তাহলে তিনি নির্বাচন দিয়ে চলে যাবেন। ফলে নানা ইসু্যর ব্যাপারে সরকারকে নিরপেক্ষতা দেখাতে হবে। যাহোক, আমরা যদি ইচ্ছাশক্তি ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে নতুন রাজনীতি সমাজ ও জাতিকে আগামীর পথ দেখাবে, রাজনীতিবিদরা সেই যাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন। এর অন্যথা জনগণের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না। শিক্ষার্থীদের নতুন দলকে কিংস পার্টির সঙ্গে তুলনা করে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্কের ঝড় বইছে। তারা কোনো কিংস পার্টি নন, তারা সরকার বা কোনো দলের আনুকূল্য চান না, তারা তাদের এজেন্ডা নিয়ে মানুষের কাছে যাবেন, জনমত গঠন করবেন, তারাও নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবেন, মাঠে আন্দোলনও করবেন, মানুষের কাছে যাবেন- বলেছেন। তারপর যদি জাতীয় ঐকমত্য হয় তাহলে তারা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবেন। সেটি সম্ভব না হলে তারা জাতীয় নির্বাচনে যাবেন না, তেমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। জুলাই গণ-অভু্যত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-তরুণদের একাংশ নতুন রাজনৈতক দল গঠন করেছে। সেটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তারা যে কর্মসূচির কথা বলছে তা বাস্তবায়নের পথ হলো জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া। এখন দেশে একটি সংবিধান আছে। সেই সংবিধানের অধীনে নতুন করে সংবিধান রচনা ও গণপরিষদ নির্বাচনের সুযোগ নেই। দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে এবং সংকট থেকে বের হতে দ্রম্নত জাতীয় নির্বাচন দরকার। সেটা না হলে রাজনৈতিক সংঘাত তো পরের কথা, সংবিধানে গণপরিষদ নির্বাচনের কোনো সুযোগই নেই। আর কিংস পার্টি নিয়ে যে কথা হচ্ছে সেটার সঙ্গে যে অন্তর্র্বর্তী সরকারের কোনো সংযোগ নেই, সেটাও তাদের প্রমাণ করতে হবে। এনসিপির লক্ষ্য অনুযায়ী 'সেকেন্ড রিপাবলিক' করতে হলে সংবিধান বাতিল করতে হয়। যারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, তারা সেটা পারেননি। তারা সেটা স্বীকারও করেছেন। এখন তারা সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন চান। সেটার জন্য তারা গণপরিষদ নির্বাচন চান। এজন্য তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আসলে সেটা তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। এখন উপায় হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সেটা যদি হয়, তারা তাতে অংশ নিয়ে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে। সংবিধান, সেকেন্ড রিপাবলিকের মতো বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক দ্বিমত আছে। নতুন রাজনৈতিক দলটি এজন্য সরকারকে চাপ দিলে এবং সরকার তাদের দিকে ঝুঁকে পড়লে রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।
এনসিপি এখন একটি রাজনৈতিক দল। তারা কর্মসূচিতে অনেক কথা বলেছেন। এখন তারা তাদের কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাবেন। মানুষ যদি তাদের কর্মসূচি গ্রহণ করে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে যদি তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠায়, তাহলে তারা তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবেন। তারা তখন যা করতে চাইবেন তা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে করতে পারবেন। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচন বাদ দিয়ে দলটি সংবিধান ও গণপরিষদ নিয়ে চাপ দিলে তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এখন জাতীয় নির্বাচন চায়। এখন যদি সেটা না করে তাদের দাবি মতো সরকার জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের দিকে যায় বা যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে নানা ধরনের রাজনৈতিক সংকট হবে, সংঘাত হবে। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এটা রাজনৈতিক সরকার নয়। এটা একটা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ অন্তর্র্বর্তী সরকার। তাদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তাদের কোনো কাজ তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে।
\হ
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক