শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

শুকদেব মজুমদার
  ২০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

এ দেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদের এক জবরদস্ত নৌকোয় উঠিয়ে দিয়ে তিনি ২৬ মার্চ ১৯৭১-এ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ২৪ বছরে ১২ বছরই জেলে থেকে বাঙালির ঐক্যের এক জলজ্যান্ত রূপ দেখে গেলেন শেষবারের মতো বন্দি হওয়ার আগে এবং সেই মোক্ষম সময়েই স্বাধীনতার চিরলালিত বাণী এমনভাবে রেখে গেলেন, যার দীপ্র প্রভাবে আগের থেকেই উন্মুখ হয়ে থাকা বাঙালি পাকিস্তানি সামারিক জান্তার লেলিয়ে দেওয়া রক্তলোলুপ বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের দিকে নিয়মতান্ত্রিক পথে এগোচ্ছিলেন। কিন্তু ভেতরে পূর্ণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল বলেই মনে হয় আগে থেকেই। এ জন্যই ওই 'চিরলালিত বাণী' কথাটি বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি বিল্পবী হতে চাননি কখনো, হঠাৎ করে তা পাওয়ার জন্যে। পুরো জাতিকে স্বাধীনতার জন্য পুরোদমে চাঙ্গা করতে বা উন্মুখ হয়ে ওঠার উত্তুঙ্গ শৃঙ্গে উঠিয়ে দিতে পেরেছেন বলে যখন তার কাছে মনে হয়েছে বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের মজবুত ভিত্তির ওপরে সবাইকে দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছেন বলে মনে হয়েছে, এবং তার কাছে আর জনগণের মধ্যে থাকার উপায় নেই বা তাদের কাছে ফিরে আসারও সম্ভাবনা নেই বলে মনে হয়েছে, তখনই তিনি তার স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন। তিনি নিজেই বলেছেন এক স্মৃতিচারণে- "কিন্তু ২৭ বছর পর্যন্ত স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি। আমি ইম্পেশেন্ট হই না। আমি অ্যাডভেনচারিস্টও নই (আনু মাহ্‌মুদ, 'বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব', 'জাতিরাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু,' পৃ. ১৫০)।" যদিও তিনি সূর্য সেন, সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখকে শ্রদ্ধা করতেন, তাদের দেশপ্রেমের পরম আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন বলে মনে হয়। ১৯৭০-এর জুনে ঢাকাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেলের এক বার্তায় বঙ্গবন্ধুর যে সাক্ষাৎকারের উলেস্নখ করা হয়েছে, তাতে রয়েছে : 'আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেরিলা যুদ্ধের ডাক দেব। কিন্তু ভিয়েতনামের মতো কমিউনিস্ট শোষণের ভয়ই প্রধানত আমাকে তা থেকে বিরত রেখেছে (তদেব, পৃ. ১৪)।' ওই সময়কালে বাঙালি গেরিলা যুদ্ধে যাওয়ার মতো মানসিকতা অর্জন করে ফেলেছে বোঝা যায় এর থেকে, আর ওই যে 'ডাক দেব' থেকে এও বোঝা যায়, ওই জনগণের সঙ্গে তার জীবন, জাতি ও রাজনীতিগত যোগাযোগ কতোটা গভীর ছিল। এই যোগাযোগ তাকে ভেদাভেদহীন জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করেছে। সে জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। রাজনৈতিক জীবনের বা জীবনের প্রথম লগ্নেই তিনি তা অর্জন করেছেন তা বলা যায় না। এর দৃশ্যমান প্রারম্ভিক পর্ব বলা যায়, ভারত ভাগের পরে, ১৯৪৭ সালের মধ্য-আগস্ট বা এর কিছুকাল পর থেকেই। এর আগে মুসলিম লীগ নির্ভর রাজনীতি, দ্বিজাতিতত্ত্বের ডামাডোল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদিতে কেটে গেছে তার রাজনৈতিক জীবনের শিক্ষানবিশ পর্বের কাল। অবশ্য এ পর্বে ও তার শৈশব-কৈশোরককালে তার মনোগত উদার মানবমুখী একটি দিক লক্ষিত হয়েছে বারবার বিভিন্ন ঘটনাক্রমে। এ উদারতা বা মানবিকতা, বুঝে নেওয়া যায়, পরবর্তীকালের রাজনৈতিক জীবনে তাকে দেশমাতৃকালগ্ন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদমুখী হতে সাহায্য করেছিল।

ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবর্ণ ফল পাওয়ার সময় যখন, তখন তার ছায়াতেই দ্বিজাতিতত্ত্বের দৌরাত্ম্যে সৃষ্টি হলো পাকিস্তান নামের ভূখন্ড। আসলেই কি দ্বিজাতিতত্ত্বের দৌরাত্ম্য ছিল, নাকি যতোটা না ছিল তা তার চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছিল সাধারণ্যে এবং তার দ্বারা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়েছিল? মূলে ছিল অনেকাংশেই বোম্বাইকেন্দ্রিক হিন্দু-মুসলমান বেনিয়াদের বিরাট স্বার্থনির্ভর গভীর হিসাব-নিকাশপূর্ণ ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতি। একই রাজনীতির সওয়ার পাকিস্তানি শাসকচক্রের নানা ছলচাতুরি জেল হত্যা শোষণ-নির্যাতনের হীন ঘৃণ্য ভয়াবহ লীলাখেলাই হলো পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের তাদের ইতিহাস। এ পুরো সময়জুড়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের আক্রোশের শিকার হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বারবার। উদ্দেশ্য, সবাইকে সে তত্ত্বের ফাঁদে ফেলানো, দলে ভেড়ানো; দাঙ্গা-হাঙ্গামাও বাঁধানো হয়েছে একই উদ্দেশ্যে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে, বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের মধ্যে তীব্র দ্বিজাতিতত্ত্বের মনোভাব ছিল ঠিকই, হিন্দু-মুসলমানদের ক্ষেত্রে এক-এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বোধ ছিল, বাঙালি বলতেই প্রচন্ড বিতৃষ্ণা আর বৈরিতা ছিল মনে তাদের; এসব তাদের শাসন আর শোষণের তীব্রতাকে বাড়িয়েছিল। এভাবে একাত্তরের যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল বাঙালি আর অবাঙালির তীব্র লড়াই। বাহ্যত অনেকটা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও দ্বিজাতিতত্ত্বের লড়াই। একদিকে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-নির্যাতনের শিকার ক্ষোভিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার-স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও লড়াই, অন্যদিকে বহুকালের সুবিধাভোগী অবাঙ্গালি শাসক-শোষক শ্রেণির শাসন-শোষণ-নির্যাতন বজায় রাখার উন্মত্ত অমানবিক আকাঙ্ক্ষা ও তার ক্রূর বাস্তবায়ন। প্রথম পক্ষের প্রতিভূ ছিলেন বঙ্গবন্ধু, আর দ্বিতীয় পক্ষের আইয়ুব, ইয়াহিয়া। অবাঙ্গালি ভরপুর মুসলিম লীগসহ অন্যান্য স্বাধীনতা বিরোধী দল, ব্যক্তিবর্গ দ্বিতীয় পক্ষে, আর প্রথম পক্ষের সবাই আওয়ামী লীগে একত্রিত। ন্যাপ ইত্যাদি ধারার রাজনীতিতে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ অর্থে একত্রিত হতে। সে দ্বিধাগ্রস্ততা, বিচ্ছিন্নতা বা পার্থক্যকে বঙ্গবন্ধু কখনো তেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কোনো দলকে বা কাউকে বিব্রত লজ্জিত করতে বা আরও বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিতে চাইতেন না। তার সহাবস্থানমূলক মনোভাব, বাঙালিসুলভ সহিষ্ণুতা ছিল উচ্চমাত্রার এ ক্ষেত্রে। তার সৌজন্যবোধ বা রাজনৈতিক শিষ্টাচার ছিল অসাধারণ। তিনি ৭ মার্চের ভাষণে 'ভাই' বলে সম্বোধন করেছেন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে। কিন্তু যারা ঝরে পড়েছেন স্বেচ্ছায় নিজস্ব কোনো সীমাবদ্ধতায়, রাজনীতির জটিল চক্র যারা অনুধাবন করে উঠতে পারেননি বা বাঙালির আন্দোলন ও ঐক্যের মহান সম্ভাবনায় যাদের বিশ্বাস ছিল না, যারা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, তাদের জোর করে আনার চেষ্টা করেননি। কখনো তিনি 'একলা চলো' নীতিতে চলতেন। ছয়দফা নিয়ে আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন তিনি করেছেন- 'এ ধরনের সিদ্ধান্ত জুয়া খেলা' ইত্যাদি রকমের কথা না শুনে। ক্ষেত্রবিশেষে তার বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিকদের কোনো ভুল বা অস্বাভাবিকতাকে ধরিয়ে দিতে পিছপা হননি। এ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীর 'পিন্ডি যাইয়া লাভ আছে?' কথা না শোনার কথা মনে করা যেতে পারে (এম আর আখতার মুকুল, 'মহাপুরুষ' পৃ. ৪৫); স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রীর, যিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন, ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া উক্তিটির প্রতিক্রিয়ায় তার প্রতিবাদ বা ক্ষোভের ব্যাপারটি। স্মরণ করা যায়, পাক-মার্কিন সামারিক চুক্তির বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান, সোহরাওয়ার্দীর নমনীয় মনের পক্ষাবলম্বন না করে এ ক্ষেত্রে। বঙ্গবন্ধু প্রমুখের বিরুদ্ধাচারণ ও পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় অনেক সাংসদের বিবৃতি দেওয়ার পথ ধরেই ১৯৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন আসে যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রী হন। উলেস্নখ্য, এ নির্বাচনের প্রাক্কালে যে ২১ দফা দাবির ইশতেহায় প্রকাশিত হয়, তাতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার ব্যবহারের কথা ছিল, এবং বঙ্গবন্ধু রচিত 'কেন আমি অটোনমি চাই' নামের পুস্তিকায় বাংলার স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথাটি যুক্তিসহ উলেস্নখ ছিল। তখন তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে গোপালগঞ্জ-কেটালীপাড়ায় নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে সাধারণ মানুষের দোয়া-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা পেয়ে অশ্রম্নসিক্ত হয়েছিলেন একবার এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, 'মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।' 'আমার মনের একটা বিরাট পরিবর্তন এই সময় হয়েছিল'- এও বলেছেন তিনি তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থে (পৃ. ২৫৬)। এ পরিবর্তন অবশ্যই বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসাগত, গণতান্ত্রিক মনোভাব ও বাঙালি জাতীয়তাবাদগত। এর পরে ১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে ন্যাপ গড়ে বিচ্ছিন্ন হন ভাসানী, 'ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব' নীতিতে নত হন ১৯৬৩ সালের দিকে। একই বছর মৃতু্য হয় সোহরাওয়ার্দীর, দলবলসহ বঙ্গবন্ধুর 'এনডিএফ' ত্যাগ। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানভিত্তিক রাজনীতির শেষ সূক্ষ্ণ সুতোটি ছিন্ন হলো বলে মনে করা যায়। পরে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির নব উন্মেষ ঘটে।

তার বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনোভাবটি আরও স্পষ্ট হতে শুরু করে, সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার তৃষ্ণাও। 'মুজিব ভাই' থেকে ততোদিনে তিনি 'বঙ্গবন্ধু'। এর শুরুর সময়টায় এ প্রসঙ্গে একটু ফিরে যাওয়া দরকার। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর 'পাকিস্তানের একামাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু'- এমন বক্তব্যে যে গুটিকয়েক ছেলে আওয়াজ তুলেছিল এক কোণ থেকে, 'নো নো, উই ওয়ান্ট বেঙ্গলি' বলে, তাদের একজন হলেন বঙ্গবন্ধু, যিনি তারও আগে গণপরিষদে পূর্ব বাংলার অন্যতম প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি বাতিল হওয়ার পরের দিনই ২৬ ফেব্রম্নয়ারি প্রতিবাদ মিছিলে সামনে ছিলেন। উলেস্নখ্য, সেদিন গণপরিষদে বাঙালি মুসলিম সদস্যদের কেউ বাংলার পক্ষে মুখ খোলেননি। মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী এ কর্মকান্ডে ১১ মার্চ যে ধর্মঘট পালিত হয় বিশেষত বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপনায়, তাতে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু, শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী প্রমুখ। দেশ বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলায় প্রথম ধর্মঘটেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রয়ারি। মহান এ ভাষা আন্দোলনের ঘটনা বাঙালি জাতির মধ্যে যে উদ্দীপনা ঐক্য এনে দেয়, তা পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামকে সম্ভাব্য ও সফল করে তোলে ক্রমান্বয়ে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বলিষ্ঠতা সাধনের প্রথম বড় ধাপ হলো এ আন্দোলন। এ ২১ ফেব্রম্নয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আইন পরিষদের সভা ঘেরাও করা যায় কি-না তা বিবেচনা করার কথা বঙ্গবন্ধুই বলেছিলেন জেলে আটক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি থাকার সময়ে। বাংলা ভাষার প্রতি তার এ ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা সারাজীবন অটুট ছিল। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে উপেক্ষা ও প্রদেশের নাম পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান করা হলে তীব্র প্রতিবাদে তিনি গণপরিষদ ত্যাগ করেছিলেন। আগের কথায় আবার ফিরে আসা যাক। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ইলামিত্রের সাঁওতাল বিদ্রোহসহ নানা রকমের বিদ্রোহ, কমিউনিস্টদের বিপস্নব, গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, হত্যা, বন্দিহত্যা, আন্দেলনরত বাঙালি পুলিশদের হত্যা ইত্যাদি, এরপরে ৫২-এর ভাষা আন্দেলনে আবার হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এরই মাঝে ১৯৪৯-এর ২৩ জুন বিশেষ একটি দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ায় বিশেষ কারও কারও মনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়, যার যুগ্ম সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায়। ১৯৫৫ সালে অক্টোবরে দলের নামের 'মুসলিম' শব্দটি প্রত্যাহার করা হয়, নাম হয় 'আওয়ামী লীগ'। আবার সাধারণ সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু।

আওয়ামী লীগের ওই শব্দ প্রত্যাহার প্রসঙ্গে বলা যায়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দলটির জনগণসংশ্লিষ্টতার বিশেষ আগ্রহ বা বাঙালি জাতীয়তাবাদী হওয়ার বিশেষ প্রেক্ষাপট, প্রয়োজনীয়তা ও তাড়না সৃষ্টি হয়েছিল তখন। আর এক প্রেক্ষাপট তখন পাক-ভারত যুদ্ধ, অরক্ষিত পূর্ববঙ্গ। এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি, যা ৫ ফেব্রম্নয়ারিতে লাহোরে বিরোধীদলসমূহের জাতীয় সম্মেলনে পেশ করেন তিনি, যা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ, স্বাধীনতার বীজমন্ত্রটি তার মধ্যে ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি সুদূরপ্রসারী রূপ দেওয়ার ইচ্ছে গুপ্ত ছিল তার মধ্যে। এ ক্ষেত্রে এমন বলা যেতে পারে, পঞ্চাশ দশক ছিল প্রগতিশীলদের উন্মেষের যুগ, আর ষাট দশকের সময়কাল ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রযাত্রা বা জয়যাত্রার যুগ। এ জয়জাত্রার প্রভাব-প্রবাহের মধ্যে দক্ষিণ ও বামপন্থি নেতারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকলেন। আর পাকিস্তানি সরকার খড়্‌গহস্ত হয়ে। ফলে জেল-জুলুম চলতে থাকে বিভিন্ন নেতাকর্মীর ওপর, এমনকি হত্যাও চলেছে কখনো। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৮ সালের মে-তে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১নং বিবাদী হিসেবে। এক সময় তাকে ফাঁসি দেওয়ার কথা ওঠে। যা জনগণের প্রতিবাদ-আন্দেলনকে জ্বলন্ত রূপ দেয়। আসে উনসত্তরের গণ-আন্দোলন। আইয়ুবের অস্ত্রের ভাষা পরাজয়বরণ করল। মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু। মুক্তি পাওয়ার পরেই তিনি হুঁশিয়ার করে দিলেন সবাইকে এই বলে : 'আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা বাঙালি, তারপর পাকিস্তানি। তাই বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে যারা নস্যাৎ করেত চায়, যারা বাংলার মানুষকে তাদের পরিচয় থেকে দূরে রাখতে চায়, আমরা যেন তাদের এ ধরনের কোনো হীন প্রচেষ্টায় মেতে না উঠি (শেখ ফজলুল হক মণি সম্পা. ও মো: আশরাফুজ্জামান মন্ডল সংকলিত, 'বাংলাদেশে গণহত্যা' পৃ. ৮৬)।' তিনি সাহিত্যিকদের বিপস্নবী সাহিত্য রচনা করতে বলেন, সাধারণ মানুষের কথা বলতে বলেন। আর বলেন যে, তার দল ক্ষমতায় এলে সর্বস্তরে তিনি বাংলাভাষা চালু করবেন। বিভিন্ন মহলকে তিনি এজন্য প্রস্তুতও থাকতে বলেন। এতে বোঝা যায় তিনি কী ব্যাপক বিশ্বাস লালন করতেন দেশ পরিচালনায় তার লালিত স্বপ্নের সফলতায়, যা হবে একান্তভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী, এবং তার পরিকল্পিত চারটি মূল স্তম্ভের ওপর স্থাপিত। 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিপ্রাপ্ত হন তখন তিনি, অর্থাৎ ২৩ ফেব্রম্নয়ারি, রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত এক বিশাল জনসভায়। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ল সত্তরের নির্বাচনে। সে সাধারণ নির্বাচন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের এক চরম সন্ধিক্ষণ বা অগ্নিপরীক্ষা ছিল। নির্বাচনে অবিশ্বাস্য বিজয়ে (জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি, প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন প্রাপ্তি) বঙ্গবন্ধু আবির্ভূত হলেন পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ফেব্রম্নয়ারির ১০-১১ তারিখ থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ পর্যন্ত টালবাহানা করতে থাকেন ভুট্টো আর ইয়াহিয়া। মাঝে মার্চের প্রথমে আওয়ামী লীগের দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর উত্তাল জনসমুদ্রে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা : 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'- এ স্স্নোগান ছিল তখন সবার মুখে মুখে। এখানে 'বাঙালি' শব্দটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য; এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ-জাগ্রত। ৭ মার্চের ডাকও স্বাধীনতার ডাক। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান রয়েছে এ যুগান্তকারী বক্তৃতায়। এবং শেষে ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা, যার মধ্যে 'ও পধষষ ঁঢ়ড়হ :যব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয, যিবৎবাবৎ ুড়ঁ সরমযঃ নব ধহফ যিধঃবাবৎ ুড়ঁ যধাব, :ড় ৎবংরংঃ :যব ধৎসু ড়ভ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ :ড় :যব ষধংঃ' পড়ে ওই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এ ঘোষণা অনুসারেই গঠিত হয় ১০ এপ্রিল বিপস্নবী সরকার পাকিস্তানে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে নয় মাসব্যাপী বাঙালির সর্বাত্মক যুদ্ধে ভীত হয়ে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর কামান্ডিং ইন চিফের কাছে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এ 'বাংলাদেশ' নামটিও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া। ১৯৬৯-এর ডিসেম্বরের প্রথম দিকে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মাজার প্রাঙ্গণের এক আলোচনা সভায় এ নামের বিষয়টি তিনি ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত নির্ধারিত হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা' গানটি তারই নির্দেশে। ১৯৬৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের শুরুতে গাওয়া গানটি শুনে তিনি বলে উঠেছিলেন, 'এই গানই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত (শেখ সাদী, 'বঙ্গবন্ধু/পূর্ণ জীবন' পৃ. ১৪২)। তখন থেকেই গানটি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। 'জয় বাংলা' স্স্নোগানটি তার, যা স্বাধীনতার বীজমন্ত্র স্বরূপ ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৌল ধ্বনি বা প্রতীক এটি। সত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তার প্রথম নির্বাচনী সভায় প্রথম উচ্চারিত হয়। এক অর্থে একাত্তরের জয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয়। তার ঐক্যের জয়। তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে সে জয়ের মাহাত্ম্যকে সবার মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেষ্টা করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালে ২৫ সেপ্টম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন তিনি, যা ইতিহাসে অনন্যসাধারণ ঘটনা। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশ্বায়নে তার এ ভূমিকার কথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় আর এক বিখ্যাত বাঙালির কথা, যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশ্বায়নে ভূমিকা রেখেছেন। বেগম মুজিব বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে, 'কবিগুরুর আসন বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্তঃস্থলে (আনু মাহ্‌মুদ, 'বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব', 'জাতিরাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু' পৃ. ২১৯)।' নজরুলের আদর্শেও তিনি অনুপ্রাণিত ছিলেন। তার উদ্যোগেই নজরুলের ৭৩তম জন্মদিনে তাকে ঢাকায় আনা হয়। তার 'বিদ্রোহী' কবিতা বঙ্গবন্ধু উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আবৃত্তি করতেন কখনো, যিনি আর এক বিদ্রোহী পুরুষ, বিবিসি শ্রোতা-জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।

বাঙালি, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ইতিহাস আর বাংলার মাটির সঙ্গে তিনি ছিলেন 'সেন্টিমেন্টাললি অ্যাটাচড'। বাঙালির সেন্টিমেন্ট বা প্রাণের স্পন্দন তিনি বুঝেছিলেন ও অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেই তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে পূর্ব পাকিস্তান সংগীত শিল্পী সমাজ আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন : 'ধর্মের নামে ভাড়াটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া মানুষের আত্মার স্পন্দনকে পিষে মারার শামিল।' তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শুধু নয়, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাওয়ার কথা বলেছেন। যে কথা তার ৭ মার্চের ভাষণে ধ্বনিত হয়ে চলেছে। বাঙালি সংস্কৃতিকে অটুট রাখার ও বিকশিত করার দৃঢ় আকাঙ্ক্ষাজাত এ কথা। আর এক ভাষণে তিনি বলেছেন : 'আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি, এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ (৭ জুন ১৯৭২, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)।' কেবল বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়, মনে হয়, এর ওপরেও ছিলেন তিনি; কারণ, তার অন্য স্তম্ভ তিনটি ছিল : ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র। তিনি বলেছেন : 'আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরব (আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন ভাষণে)।' তিনি বিদেশের মাটিতে নয়, দেশের মাটিতে শাহাদতবরণ করেছেন সপরিবারে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে, নিজ বাসভবনে, সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যের হাতে। তাদের হত্যাকান্ড পুরো বাঙালির ললাটে অমোচনীয় কলঙ্ক লেপন করে দিয়েছে, বিষম অপরাধী করে গেছে সবাইকে। তাদের রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শগত উচ্চাভিলাষসহ একাত্তরের বিজয়ী বাঙালি একটি সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত জাতিতে পরিণত হোক, এমন আকাঙ্ক্ষা তাদের ষড়যন্ত্র ও হত্যাকান্ডের পেছনে বিশেষ সক্রিয় ছিল বলে মনে হয়। একটি পরোক্ষ পাকিস্তান সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সফল হতে পারে বাঙালির আত্মবিস্মৃতির মধ্য দিয়ে- এমন হিসেব ছিল তাদের ওই সক্রিয়তার সর্বাঙ্গজুড়ে। এর বিপরীত সক্রিয়তার সর্বোত্তম বিকাশে যে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা সম্ভব হয়েছিল তার মধ্যে একটি বৃহত্তম ব্যাপার ছিল বঙ্গবন্ধুর বর্তমান থাকা। আর তা সম্ভব করেছে তার জন্ম। তার জন্মের শুভক্ষণটি থেকেই শুরু হয়েছিল বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও সাফল্যজনক ঘটনা একাত্তরের স্বাধীনতালাভ কবে হয় তার দিনগণনার শুরু- বাঙালির শিহরিত সাহসী গর্বিত অপেক্ষার পালা। বঙ্গবন্ধুর জন্মই ছিল আসলে বাঙালির ইতিহাসে শুধু নয়- বিশ্ব-ইতিহাসের একটি উলেস্নখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা।

শুকদেব মজুমদার: কবি, প্রবন্ধিক, কলাম লেখক ও সহযোগী অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<80545 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1