রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
পানাম নগর

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

পানাম নগর বাংলাদেশিদের কাছে 'হারানো নগরী' হিসেবে সুপরিচিত। ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত এটি একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর।

সোনারগাঁওয়ের প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠে এই নগরী। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর- প্রাচীন সোনারগাঁওয়ের এই তিন নগরের মধ্যে

পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ১৫ শতকে ঈশা খাঁ সোনারগাঁওয়ে বাংলার প্রথম

রাজধানী স্থাপন করেন।

পানাম নগরী চতুর্দিক থেকে পঙ্খীরাজ খাল দিয়ে ঘেরা। পঙ্খীরাজ খাল মেনিখালী নদ নামে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। পানাম নগরীর পূর্ব দিকে রয়েছে মেঘনা নদী আর পশ্চিম দিকে শীতলক্ষ্যা। এই নদী পথেই বিলেত থেকে আসত বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেত মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়ত পালতোলা নৌকা। পরবর্তীতে এই পোশাক বাণিজ্যের স্থান দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। ইংরেজরা এখানে বসিয়েছিলেন নীলের বাণিজ্য কেন্দ্র। প্রায় সময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠে পানাম নগরী। পানাম নগরীর বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণশৈলীতে রয়েছে ভিন্নতার ছাপ। তৎকালীন ধনিক শ্রেণীর এই নগরীর প্রতিটি দালানে রয়েছে অপূর্ব কারুকার্য ও আভিজাত্য ছোঁয়া। নগরীর বুক চিরে চলে যাওয়া রাস্তার দুই পাশে রয়েছে প্রায় ৫২টি ভবন। মূল রাস্তার উত্তর দিকে ৩১টি এবং দক্ষিণ দিকে ২১ ভবন আছে। এই ভবনগুলো কোনোটি একতলা, কোনোটি আবার দুই বা তিনতলাবিশিষ্ট।

বাড়িগুলোর অধিকাংশই আয়তাকার ও উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। বাড়িগুলোর স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মুঘল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়িই ব্যবহারোপযোগিতা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার এবং নির্মাণকৌশলের দিক দিয়ে উদ্ভাবনী কুশলতায় ভরপুর। ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই-লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তী স্থানে নীল ও সাদা ছাপ দেখা যায়। এছাড়া বাড়িগুলোতে নকশা ও কাস্ট আয়রনের কাজ নিখুঁত। কাস্ট আয়রনের এই কাজগুলো ইউরোপের কাজের সমতুল্য বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এর সাথে আছে সিরামিক টাইলসের রূপায়ন। প্রতিটি বাড়িই অন্দরবাটি এবং বহির্বাটি- এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাড়ির চারদিকের ঘেরাটোপের ভিতর আছে উন্মুক্ত উঠান।

পানাম নগরীর পরিকল্পনাও নিখুঁত। নগরীর পানি সরবরাহের জন্য দুই পাশে ২টি খাল ও ৫টি পুকুর আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কুয়া বা কূপ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে করা হয়েছে খালের দিকে ঢালু। প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে সম্মানজনক দূরত্বে রয়েছে। নগরীর যাতায়াতের জন্য রয়েছে এর একমাত্র রাস্তা, যা এই নগরীর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এপাশ-ওপাশ।

নগরীর অভ্যন্তরে আবাসিক ভবন ছাড়াও মসজিদ, গির্জা, মন্দির, মঠ, নাচঘর, চিত্রশালা, পান্থশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, পুরনো জাদুঘর, গোসলখানা ও গুপ্ত পথ রয়েছে। এছাড়া ৪০০ বছরের পুরনো টাঁকশাল বাড়ি ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরি নীলকুঠি এখানে দেখতে পাওয়া যায়।

নীলকুঠি : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলচাষের নির্মম ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে পানামের নীলকুঠি। পানাম পুলের কাছে দুলালপুর সড়কের পাশেই এর অবস্থান। জানা যায়, শুরুতে এটি কোম্পানির মসলিন বস্ত্র ক্রয়কেন্দ্রের দপ্তর ভবন হলেও পরে কুঠিটি নীল ব্যবসা কেন্দ্র হয়ে ওঠে। যদিও বর্তমানে (২০০৪) নীলকুঠির মূল রূপ ঢাকা পড়ে গেছে নতুন করে করা পলেস্তারার নিচে।

দুলালপুর পুল : পঙ্খীরাজ খালের ওপর ১৭ শতকে এই পুলটি নির্মিত হয়েছিল, যা আমিনপুর ও দুলালপুর গ্রামের সংযোগ রক্ষা করছে। তিনটি খিলানের উপর পুলটি স্থাপিত। পুলের নিচ দিয়ে পণ্যবাহী নৌযান চলাচলের সুবিধা দিতে মাঝখানের খিলানটি কিছুটা উঁচু করে বানানো। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে পুলটিতে সংস্কারকাজ চালানো হয়।

এছাড়াও নগরীর আশেপাশে ছড়িয়ে আছে ঈসা খাঁ ও তার ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন, ফতেহ শাহের মসজিদ, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীরের মাজার, কদম রসুল, চিলেকোঠাসহ বহু পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ববহ স্থাপনা।

এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বার ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত।

পানাম নগরীর প্রবেশ পথে আছে বিশাল গেট, সূর্যাস্তের সাথে সাথে এই গেট বন্ধ করা হতো। বর্তমানেও কোনো দর্শনার্থী সন্ধ্যার পর পানাম নগরীতে অবস্থান করতে পারে না।

২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের তৈরি বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় পানাম নগর স্থান পায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে