সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

গুণী সুরকার সংকটে সঙ্গীতাঙ্গন

মাতিয়ার রাফায়েল
  ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
ভাঙচুর শিরোনামের একটি গানচিত্র

বাংলা গান নিয়ে এখন প্রায় সবাই একমত হালে যেসব গান হচ্ছে অধিকাংশই নিম্নমানের। মানসম্পন্ন ভালো বাংলা গানের সংকট চলছে এখন। এখনকার সুরকাররা স্বীকার করতে না চাইলেও নতুন শিল্পীরাই বলছেন নতুন সুরকারদের কেউই আগের লেভেলের মানসম্পন্ন নয়। পাশাপাশি যারা গীতিকবি আছেন তারাও মানসম্পন্ন লিরিক দিতে পারছেন না। এ কারণেই প্রচুর কণ্ঠশিল্পী থাকা সত্ত্বেও তাদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সবাই অভিযোগ করছেন, এখনকার সুরকাররা আগের মতো মাথা খাটিয়ে সুর তৈরি করছেন না- সবাই মেশিন বা যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছেন। যে যন্ত্রে আগে থেকেই ভিডিও গেম এর মতো সুর সাজানো থাকে। সেই সুর ব্যবহার করেই গানের কম্পোজিশন করছেন তারা। সে জন্যই মানুষের তৈরি সুর আর যন্ত্রের তৈরি সুরের মধ্যে একটা আকাশ-পাতাল তফাৎ তৈরি হয়ে যাচ্ছে।

কণ্ঠশিল্পী বাদশা বুলবুল বলেন, 'আমি তো প্রথমে আমার নিজের জন্যই গান করি। সুরের মাখানো যে প্রেম, সেই প্রেম থেকেই গান করি। এরপরই সেটা দর্শকের জন্য হয়ে উঠে। সেই প্রেমটাই তো এখনকার গানে নেই। নতুনদের গায়কি ঢংটাই তো প্রকৃত গানের উপযোগী নয়। এখন বেশিসংখ্যক গায়ক এবং সুরকার আছেন ঠিকই, কিন্তু কারও মধ্যেই প্রকৃত সৃজনশীলতা নেই। আমি তো শুধু গানের জন্যই 'নয়নমনি' সিনেমা ১৩ বার দেখেছি।'

আসলে সুর তৈরিতে বর্তমান হাইটেক যুগের মেশিন বা যন্ত্রের প্রভাব এতটাই সর্বগ্রাসী হয়ে পড়েছে, যারা কণ্ঠশিল্পী, তারাও সুরকার হয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গীত পরিচালক হয়ে যাচ্ছেন। যিনি কণ্ঠশিল্পী তিনিই গীতিকার, সুরকার, কম্পোজার, সঙ্গীত

পরিচালক- সবই।

অথচ একসময় এর প্রত্যেকটিরই আলাদা আলাদা শিল্পী ছিলেন। যে কারণে প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে নিজ নিজ কাজে অনেক বেশি মনোযোগ দিতে পারতেন। এখন একজন ব্যক্তি যদি একাই একশ হয়ে যান তখন তিনি কোনটা রেখে কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দিবেন? নিশ্চয়ই তার পক্ষে একসঙ্গে সবগুলোকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এর সবগুলোরই যদি আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট থাকতো, সেই ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী যদি আলাদা আলাদা শিল্পী থাকতেন তখন তারা নিজ দায়িত্বেই নিজের কাজটিকে গুরুত্ব দিয়ে করতেন। এভাবে তখন সবকাজই সমান গুরুত্ব পেয়ে যেত। এখন এটা হচ্ছে না বলেই একটি গানের কথা যদি ভালো হয়, সুর সেই অনুযায়ী হচ্ছে না- সুর যদি ভালো হয়, পরিচালনাও সেই অনুযায়ী হচ্ছে না- সবকিছুতেই একটা জগাখিঁচুরি ব্যাপার চলে আসছে।

এমন অভিযোগ দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমিন, ফরিদা পারভীন, শাহীন সামাদ, মনির খান, শুভ্র দেব, বাদশা বুলবুলসহ তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরাও করছেন। সম্প্রতি দেশের ও পশ্চিম বাংলার প্রয়াত ও বর্তমান মিলিয়ে সেরা সুরকার ও গীতিকবি নির্বাচনে জরিপ হয়। দেখা গেছে, দেশের সেরা সুরকার হিসেবে আছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ভোট পেয়েছেন ১৫ শতাংশ। এরপরই আছেন সলিল চৌধুরী। তিনি ভোট পেয়েছেন ১৪ শতাংশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন সাঁই এবং কমল দাশগুপ্ত - ৩ জনেই পেয়েছেন ৯% করে ভোট। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত এবং শচীন দেব বর্মণের ভাগে পড়েছে ৮% করে ভোট। শাহ আবদুল করিমের পক্ষে পড়েছে ৪% ভোট।

এ ছাড়াও আরও যারা কালজয়ী গানের সুর করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, আর ডি বর্মণ, রাহুল দেব বর্মণ, ভূপেন হাজারিকা, আলতাফ মাহমুদ, সুপর্ণকান্তি ঘোষ, আপেল মাহমুদ, সুবল দাসগুপ্ত, আনোয়ার পারভেজ, আলাউদ্দিন আলী, খন্দকার নরুল আলম, আলম খান, খান আতাউর রহমান, শেখ সাদী খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল প্রমুখ।

জরিপে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের মানের তো প্রশ্নই উঠে না এমন কি শেখ সাদী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলদের মানের সুরকারও এখন কল্পনাও করা যায় না।

ফলে দেশের গোটা সঙ্গীতাঙ্গনই ভালো সুরকারের অভাবে ধুঁকছে, এমন নয়। একই অভাবে ঢাকাই সিনেমাও গত কয়েক বছর ধরে ভালো সুরকারের খোঁজে বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ছে। ঢাকাই চলচ্চিত্রে ভারতীয় সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকদের মধ্যে এখন নিয়মিত কাজ করছেন আকাশ সেন ও স্যাভি। আছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, ডাব্বু ঘোষাল ও লিংকন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া আলোচিত সিনেমাগুলোতে দেশের বাইরের শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালকরা কাজ করে আসছেন।

যেহেতু প্রত্যেক সুরকারেরই পছন্দের কণ্ঠশিল্পী থাকেন তখন বাইরে থেকে আনা সুরকারদের সঙ্গে বিদেশি কণ্ঠশিল্পীও এসে যাচ্ছেন আমাদের চলচ্চিত্রে। চিত্র পরিচালক অনন্য মামুনসহ অনেকেই এখন বিদেশি সুরকারদের সুবাদে সেখানকার শিল্পী দিয়ে গান করান। এ প্রসঙ্গে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে মামুন বলেন, 'আমাদের দেশে গুণী শিল্পী, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালকের অভাব নেই। কিন্তু গুণের অভাব আছে।' বিষয়টি তিনি আরও পরিষ্কারভাবে বলেন, 'দেখা যায়, আমি কোনো সঙ্গীত পরিচালককে দিয়ে মিউজিক করিয়ে বললাম, গানটি অমুক শিল্পীকে দিয়ে গাওয়াব, এটা তিনি মানতে পারেন না। অথবা সুর করিয়ে অন্যকে দিয়ে সঙ্গীত পরিচালনা করাব বললেও আপত্তি তোলেন। বিদেশে এ সমস্যায় পড়তে হয় না।'

এই কথাতেও পরিষ্কার হয়, গানের বিষয়ে এখানে সিন্ডিকেটও প্রবল আছে। অভিযোগটি এখন দেশের গোটা সঙ্গীতাঙ্গনেই জোরালোভাবে উঠে আসছে। কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, নাজমুন মুনিরা ন্যান্‌সি, মনির খান, বাদশা বুলবুলসহ অনেকেই বলেন, এখন এখানে একটা সিন্ডিকেট চলছে। এই সিন্ডিকেটের মধ্যে যারা আছেন, তারাই গান গাইছেন, সুর করছেন, সঙ্গীত পরিচালনা করছেন। এ জন্য আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনটিও কোয়ালিটিফুল হচ্ছে না।

চিত্র পরিচালক অন্যন্য মামুন যে কথাটি বললেন, আমাদের সুরকাররা ভালো হলেও গুণের অভাব আছে, ঠিক একইভাবে এই সময়ের কণ্ঠশিল্পী দিঠি আনোয়ারও বলেন, 'আমাদের কোয়ালিটিফুল সুরকার অভাব আছে। এই কোয়ালিটিফুল সুরকারের অভাবের কারণেই প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ভালো সিঙ্গার উঠে আসতে পারছে না। তাদের ভালোভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে