শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভিউ বাড়াতে নাটকে অশ্লীলতা

বিনোদন রিপোর্ট
  ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বেশ কয়েক বছর ধরেই যাচ্ছেতাই অবস্থা বিরাজ করছে দেশের টিভি নাটকগুলোতে। সিনেমার মতো নাটকেও অবাধে চলছে অশ্লীল, রগরগে শয্যাদৃশ্য ও সংলাপ। শুধু তাই নয়, তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমার মতো অভিনেত্রীর শরীরের বিশেষ অঙ্গে আলাদাভাবে ক্যামেরা জুম করেও দর্শককে আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে টিভি নাটককে আর ড্রয়িংরুমনির্ভর বিনোদন বলা যায় না। আগের মতো পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে টিভি দেখা এখন বিব্রতকর অবস্থায় পরিণত হয়েছে। অশালীন সংলাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হয়েছে নাটকের কুরুচিপূর্ণ নাম। আবার অনলাইন পস্ন্যাটফর্ম কিংবা ইউটিউবে শুধুমাত্র ভিউ বাড়ানোর জন্য একশ্রেণির নির্মাতা নাটক বা অন্য কোনো কন্টেন্টের এমনসব অদ্ভুত, অশ্লীল, চটকদার ও কুরুচিপূর্ণ নাম ব্যবহার করছে, যা আমাদের দেশের শিল্প সংস্কৃতিকে বিশ্বে অত্যন্ত অমর্যাদাকর হিসেবে তুলে ধরছে। অনলাইন পস্ন্যাটফর্মের শুরু থেকেই অনেকে ভালো গল্পের সুন্দর নাম না দিয়ে নাটক বা কন্টেন্ট বানানোর দিকে ঝুঁকছে। অভিযোগ উঠেছে, অনলাইন পস্ন্যাটফর্মটিকে সুকাজে ব্যবহারের পরিবর্তে কুকাজে ব্যবহারের পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। এসব দেখার কেউ নেই। ফলে ভিউ বাড়ানোর এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন এক ধরনের নাটক নির্মাতারা। এখন একটি নাটক কতটা সফল হলো, তা নির্ভর করে ইউটিউব চ্যানেলে কত ভিউ হলো, তার ওপর। নাটকটি মানসম্পন্ন না হলেও ভিউ সংখ্যাই এর দর্শকপ্রিয়তা নির্ণয় করছে। যে নাটকের যত বেশি ভিউ হচ্ছে, সেটিকেই সেরা হিসেবে ধরা হচ্ছে। ফলে পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মানের দিকে খেয়াল না করে ভিউয়ের পেছনে ছুটছেন। এতে ঐতিহ্য হারাচ্ছে আমাদের নাটক। অনলাইন পস্ন্যাটফর্মে একটি নাটক পুরো না দেখলেও তা ভিউ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে নাটকের মান বিচার করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে চটুল গল্পের ভাঁড়ামোপূর্ণ নাটকের সংখ্যা বেশি। বিগত দুই বছরে সর্বাধিক ভিউয়ের বেশিরভাগ নাটকের গল্প দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। অনেক নির্মাতা মনে করেন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনেকে ভাইরাল গল্পের বাইরে কাজ করতে আগ্রহ দেখায় না। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই ধরনের গল্পের নাটকগুলোর বেশি প্রচারণা চালাচ্ছে। ফলে গল্পনির্ভর নাটকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ভালো গল্পের নাটকগুলো প্রচারণার অভাবে দর্শকের চোখে কম পড়ছে।

তথাকথিত এসব ইউটিউব তকমাধারী অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং নির্মাতা অশ্লীল কনটেন্ট করে ভিউ পাচ্ছেন। ইউটিউবের জন্য নির্মিত এসব নাটকের উদ্ভট গল্প, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অশ্রাব্য গালাগালি একশ্রেণির দর্শকের কাছে বেশ প্রিয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে ইউটিউবের জন্য নির্মিত নাটকে প্রচুর পরিমাণে 'বিপ' শব্দের ব্যবহার করা হয়। রুচিশীল দর্শক এসব নাটক দেখে বিরক্ত হচ্ছেন। চলতি বছরে কয়েকটি নিম্নরুচির নাটকের নাম শুনলেই বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। যেমন 'বাটপার প্রেমিক', 'দৌড়ের উপর বিয়ে', 'জামাই কেন চোর', 'বেয়াইন যেন কাঁচামরিচ', 'দুইজনের এক বউ', 'বিয়ে ছাড়া বাচ্চা' ইত্যাদি। এসব নাটকে কমেডির নামে অশ্লীল দৃশ্য ও সংলাপ উপস্থাপন করা হচ্ছে। বেশি ভিউ ও আয়ের প্রত্যাশায় এ ধরনের মানহীন ও কুরুচিপূর্ণ নাটক কিছু নির্মাতা নির্মাণ করছে।

অন্যদিকে, বেশির ভাগ টিভি চ্যানেলে নাটকের প্রিভিউ কমিটি না থাকায় নাটক নির্বাচন করছে মার্কেটিং বিভাগ। তারা গল্পনির্ভর নাটকের চেয়ে কাটতির কথা মাথায় রেখে সম্ভাব্য ভিউসর্বস্ব নাটকগুলোকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নাট্যবোদ্ধাদের মতে, নাটকের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা ও মান কখনো এক হতে পারে না। এই সময়ের অনেক শিল্পীর ফলোয়ার বেশি। একই সঙ্গে তাদের নাটকে ভিউ ভালো হচ্ছে। কিন্তু তাদের মানসম্পন্ন কাজের সংখ্যা কম। বেশির ভাগ নাটক একই রকম মনে হয়। আবার টিভিতে নাটক প্রচারের পর সেটি চলে যাচ্ছে ইউটিউবে। এখানে বিভিন্ন শ্রেণির দর্শক আছে। তবে বেশির ভাগ দর্শক কমেডি নাটক দেখতে পছন্দ করে। আমাদের উচিত, দর্শকদের জোর করে না হাসিয়ে গল্পের মাধ্যমে হাসানো। আমাদের নাটকের নিজস্বতা আছে। আমাদের প্রয়োজন আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করা।

এসব বিষয়ে বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত বলেন, একটা সময় প্রমিত বাংলায় মানুষ কথা বলত। এখন নাটকের নাম শুনলেই মোটামুটি সব বোঝা যায়। ভাষাটাই যেখানে হারিয়ে গেছে, নাম নিয়ে আর কী আশা করতে পারি। আশি ও নব্বইয়ের দশকের নাটকগুলো নিয়ে এখনো দারুণ সব প্রতিক্রিয়া পান মন্তব্য করে এই অভিনেতা, নাট্যকার ও পরিচালক বলেন, এখনো বুঝি, দর্শক ওই রকম গল্প চায়। জানি না, কীভাবে বেরিয়ে আসা যাবে এখান থেকে। এখানে টেলিভিশন চ্যানেলের দায় অনেক। সব নাটকের নাম এমন, তা নয়। এই শহরে, আমাদের সমাজবিজ্ঞান, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মায়া সবার মতো না, কাঠপেন্সিলের কাহিনী, তুমি ফিরে আসোনি, আগন্তুক, ফেরা, শুনতে কি পাও- এর মতো নামের নাটকও আছে।

আরেক প্রথিতযশা নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, এখনকার বেশির ভাগ নাটকে যে ধরনের নাম দেওয়া হয়, এগুলো অসভ্য লোকের বর্বর কাজ। আমাদের দুঃখ ছিল, টেলিভিশন নাটক তো গেল, এখন ইউটিউব আরও জঘন্য। নাটকের নামের এই বিকৃতির পেছনে যারা আছেন, তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত। নাটকের বাজেট কম, এ কারণেই কি নামের এই হাল? এখানে বাজেট কোনো বিষয় নয়। এ ধরনের নাম কিছু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ পছন্দ করে, যার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়ে। শুনেছি, যারা অনুষ্ঠান বিভাগে আছেন, তারা এমনও বলেন, নাটকে মজা কোথায়, মজা বের করেন। আমরা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে একটি নাটক বানাচ্ছিলাম, মজা নেই বলে চ্যানেল সেই নাটকের প্রচার বন্ধ করে দেয়। নির্মাতা ও অভিনেতা সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, এখন নাটক চলে গেছে চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগ ও এজেন্সির হাতে। তারাই নাটকের গল্প ও শিল্পী নির্ধারণ করে দেয়। কি ধরনের গল্পে কাজ করতে হবে এবং কোন কোন শিল্পীকে নিতে হবে, তা নির্বাচন করে চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগ ও এজেন্সিগুলো। যার কারণে অনেক সময় নির্মাতারা নিজেদের পছন্দের গল্পে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার এটিও সত্যি, এই সময়ের অনেক তারকা ভালো ভিউ হতে পারে- এমন গল্পের নাটকগুলোতেই বেশি কাজ করছেন। যে নাটকের বেশি ভিউ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেটিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর শিল্পমান কেমন হবে কিংবা দর্শকদের মনে দাগ কাটবে কিনা, তা তাদের কাছে বিবেচ্য নয়।

নাটক-সংশ্লিষ্টদের মতে, এই সময় কোটি ভিউর নাটকের দর্শকের বেশির ভাগ তরুণ। তারা শিল্পের চেয়ে হাসি-তামাশাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশির ভাগ কমেডি নাটকের ক্লিপ প্রমোট করা হচ্ছে। দর্শক ক্লিপ দেখে আগ্রহী হয়ে সেসব নাটক দেখছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে