শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিছকই নাম সর্বস্ব পারিবারিক নাটক

মাতিয়ার রাফায়েল
  ০২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
'উড়ালপঙ্ক্ষী' ধারাবাহিক নাটকের একটি দৃশ্য

কথায় বলে, 'নামে কী আসে যায়, গুণেই যার পরিচয়'। অর্থাৎ যার চোখই নাই নাম তার পদ্মলোচন। কথাটি অনেক পুরানো হলেও এটা যেন দেশের নাট্যনির্মাতারাই বুঝতে চান না যে এই কথাটি অনেক পুরানো। একে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই। তারপরেও যেন একপ্রকার জোর করেই একে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছেন দেশের টিভি নাটকের নির্মাতা বা পরিচালকরা। অর্থাৎ তারা দর্শককে যেন এতটাই বোকা ভাবেন যে, তারা যা করবেন, যা দেবেন সেটাই দর্শক বোকার মতো গিলতে থাকবেন।

দীর্ঘদিন ধরেন মিডিয়া একটা অভিযোগ করে আসছিল দেশের টিভি নাটক থেকে পরিবার একদমই উঠে গেছে। এটা শুধু মিডিয়াই নয়, যারা অভিনয় করেন তাদের প্রায় সবাই-ই এই অভিযোগ করে আসছেন। প্রবীণ অভিনয় শিল্পী থেকে শুরু করে নবীন অভিনয় শিল্পী সবাই একযোগে অভিযোগ করে আসছিলেন এখন প্রায় সব নাটকই পরিবারকে খন্ডিতভাবে বা আংশিকভাবে দেখিয়ে থাকে নির্মাতারা।

এই অভিযোগ শুনে-শুনেই একপর্যায়ে তাদের কান ঝালাপালা শুরু করে দিয়েছে কিনা কে জানে, নয়তো তারা কেনই তাদের নাটকে 'ফ্যামিলি' শব্দটি প্রয়োগ করে নাটক বানাতে যাবেন? আর যেভাবে তারা তাদের নাটকে এই 'ফ্যামিলি' শব্দটি প্রয়োগ করছেন তাতেই যে কারো মনে হতে পারে তারা আসলে গোটা ফ্যামিলি সিস্টেমটাকে নিয়েই বিদ্রূপ বা পরিহাস করতে চাইছেন। আর সেটা তো তাদের ওই নাটকের সংলাপ থেকেই আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। এভাবে আসলে তারা বাংলা নাটককে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছেন? নাকি জগতের আর কিছু না করার যোগ্যতা না থাকাতে এখানে কিছু টাকা-পয়সা রোজগারের উদ্দেশ্যেই এসব করছেন?

শুধু তাই নয়, একসময় যে পারিবারিক গল্পের কারণেই তুমুল জনপ্রিয় ছিল টিভি ধারাবাহিক নাটক সেগুলোকেও যেন তারা পরিহাস করতে চাইছেন তাদের এইসব নাটকের মধ্যদিয়ে। যেসব নাটকে মা-বাবা, ভাই-বোন, ভাবি-দুলাভাই, দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যই উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাইকেই পরিহাস করতে চাইছেন। এই পরিহাস করতে-করতেই ওইসব সম্বন্ধবাচক শব্দটিকে প্রথমে বিকৃত করতে শুরু করেন যে শব্দটি আদতেই কোনো অভিধানে তো নেই-ই এমনকি সমাজের কারো মুখেই প্রচলিত ছিল না। যৌন বিকৃতির মতোই যেন প্রকাশ ঘটে তাদের এই সম্বন্ধবাচক শব্দের বিকৃতিতেও।

একদিকে তাদের এই শব্দ বিকৃতির মহোৎসব আরেকদিকে চ্যানেল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা নাটকের সোনালি সময় হারিয়ে বসে টিভি নাটক। এ অবস্থায় দর্শক নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন বিদেশি চ্যানেলের ভিন দেশি সিরিয়ালে। দেশীয় চ্যানেলগুলোও প্রচারে আনে বিদেশি সিরিয়াল। যেগুলোতে নিটোল পারিবারিক গল্পের কারণেই দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এসব সিরিয়াল।

একপর্যায়ে দর্শকের মাঝে ভিনদেশি সিরিয়ালের পারিবারিক গল্পের প্রতি আগ্রহ দেখে দেশীয় টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষও উদ্যোগ নেয় পারিবারিক ধারাবাহিকের। ফলে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি পারিবারিক ধারাবাহিক নাটক প্রচার পেয়েছে বিভিন্ন চ্যানেলে। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? ওরা মনে করেছিল যেহেতু দর্শক এখন পারিবারিক গল্পের ধারাবাহিক দেখতে চায় তাই তারা শুধু তাদের নতুন ধারাবাহিকে শুধু পারিবারিক গল্পই নয়, তার সঙ্গে নাটকটিরও এমন নাম রাখবেন যাতে দর্শক সেই নাম দেখেই বুঝতে পারেন এখানে পরিবার দেখতে পাওয়া যায়। যেমন মানুষ নাম দেখেই বোঝেন কোনটা ভাতের হোটেল আর কোনোটা রেসিডেন্সিয়াল হোটেল। এভাবেই দর্শককে ধোঁকা দেওয়া শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের পারিবারিক নাটকে।

এই নাটকের নামগুলো দেখেই পাঠক বুঝবেন এই নামের মধ্য দিয়ে তারা কীসের পরিবার বোঝাতে গিয়ে কী পরিবারের নাটক উপহার দিচ্ছে। যেমন- ফ্যামিলি ডিসটেন্স'. 'পারিবারিক প্রিমিয়ার লিগ', 'ফ্যামিলি ক্রাইসিস', 'পরিবার পরিকল্পনা', 'ফ্যামিলি ক্রাইসিস রিলেডেড' 'জয়েন্ট ফ্যামিলি', 'ফ্যামিলি ফ্যান্টাসি', 'ফ্যামিলি প্রবলেম', 'ফ্রেন্ডস ফ্যামিলি', 'পরিবার : দ্য ফ্যামিলি', 'হইচই পরিবার'সহ আরও অনেক নাটক।

?সম্পর্কের বিভিন্ন টানাপোড়েন নিয়ে তৈরি হওয়া ধারাবাহিক নাটক 'ফ্যামিলি ডিসটেন্স' ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। নাটকটিতে বিশেষ চমক হিসেবে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত। নাটকে আরও অভিনয় করেছেন ডলি জহুর, দিলারা জামান, ওয়াহিদা মলিস্নক জলি, সাবেরী আলম ও চিত্রলেখা গুহ।

বৈশাখী টিভিতে প্রচারিত হওয়া ধারাবাহিকটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন হাসান জাহাঙ্গীর। শিরোনামটির মধ্যে ফাঁকিটা হলো যে, একটি পরিবারে স্বাভাবিক নিয়মে যেসব পারিবারিক দূরত্ব তৈরি হয় তারই একটি গল্প। যেহেতু প্রায় সব পরিবারে কোনো না কোনোভাবে একটা দূরত্ব দেখা দেয় এবং আবার সেই দূরত্ব ঘুঁচেও যায় তারই গল্প তো চিরকালই এ দেশের নাটকে ও সিনেমায় দেখানো হয়ে আসছে। নাটক বা সিনেমার অ্যান্ডিংয়েও সবার মিল দেখানো হয় সেটাও তো ওই ফ্যামিলি ডিসটেন্সেরই পুরানো কেন্দ্রিকরণের রূপ। তাহলে নাটকের নাম আলাদাভাবে 'ফ্যামিলি ডিসটেন্স' এমনই নামকরণ হতে হবে কেন? এরকমই 'ফ্যামিলি প্রবলেম', 'ফ্রেন্ডস ফ্যামিলি' ইত্যাদি নামকরণের মহোৎসব এলো বাংলা টিভি নাটকে। তাও আবার ইংরেজি নামে হবে কেন?

এরইমধ্যে নতুন দুটি ধারাবাহিক নাটক শুরু হয়েছে মাছরাঙা 'উড়ালপঙ্খী' ও 'ক্যাম্পাস' শিরোনামে। দুটাতেই পরিবার এসেছে।

ইদ্রিস হায়দারের রচনা ও পরিচালনায় উড়ালপঙ্খীতে অভিনয় করেছেন মীর সাব্বির, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, ইমতু, শশী, মুসাফির সৈয়দ বাচ্চু, শম্পা রেজা, শামীমা তুষ্টি, মনিরা মিঠু, কচি খন্দকার, অনন্ত হীরা, মাসুম বাশার প্রমুখ।

অন্যদিকে আওরঙ্গজেবের রচনা ও তুহিন হোসেনের পরিচালনায় ক্যাম্পাস নামের ধারাবাহিকটিতে অভিনয় করেছেন রওনক হাসান, অর্ষা, চাষী আলম, পাভেল, মিহি আহসান, এমিলা হক, সুষমা সরকার, মাহা, তামিম খন্দকার, ফরহাদ বাবু, শিবলি নোমান, তানজিম হাসান অনিক, আহসান হাবিব নাসিম, এমিলা হক প্রমুখ। এ দুটো নাটকেও নিশ্চয় পরিবার আছে। কিন্তু এজন্য নাটকে পরিবার আছে সেটা চেনানোর জন্য কি ফ্যামিলি : দ্য উড়ালপঙ্ক্ষী বা ফ্যামিলি ক্যাম্পাস এরকম নাম রাখতে হয়েছে?

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, 'দর্শক পারিবারিক নাটক পছন্দ করেন। পরিবারের সবাই মিলে এ নাটক দেখতে পারেন। করোনার শুরুর দিকে অনেক আগের নাটকগুলো পুনঃপ্রচার হয়েছে। দর্শক নাটকগুলো দেখেছেন। বর্তমানে আমরা পরিবার থেকে সরে যাচ্ছি। পারিবারিক জীবনের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ ছিল, সেটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তবে এখন কিছু পরিচালক পারিবারিক গল্পের নাটক নির্মাণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এটা অত্যন্ত ভালো খবর। এটা অব্যাহত থাকা দরকার।'

কিন্তু তাই এমন নামকরণের মধ্যেদিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, এই নাটকে পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যাবে- এটাই বা কেমন? এমন প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য আবুল হায়াত কোনো উত্তর নিয়ে তার স্বভাবসুলভ হাসেন। বলেন, তবুও যদি এই নামের মধ্যদিয়ে ভুলতে যাওয়া পরিবারকে আবার ফিরে পাওয়া যায় তো তাতে মন্দ কী!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে