বিনোদন মানেই মানুষকে আনন্দ দেওয়া। চলচ্চিত্র হচ্ছে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। বাংলা চলচ্চিত্রে, বিশেষ করে ঢাকাই সিনেমার স্বর্ণালি যুগে একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত 'কৌতুক' পর্ব। একটা সময় চলচ্চিত্রের অপরিহার্য অংশ ছিল 'কৌতুক'। আমাদের নিত্যদিনের জটিলতায় জীবন যখন নাভিশ্বাসে উঠে যায় ঠিক তখন একটু হাসি এনে দিতে পারে প্রশান্তি ও আনন্দ। সিনেমায় সেই কাজটি করেন
একজন কৌতুক অভিনেতা।
একজন কৌতুক অভিনেতা একজন নায়ক বা খল অভিনেতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। শুধু বাংলাদেশের সিনেমাতেই নয়, বিশ্বের সব চলচ্চিত্রের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে কৌতুক পর্ব। বাংলা সিনেমার সূচনালগ্ন থেকে কৌতুককে খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু ঢাকাই সিনেমায় বেশ ক'বছর যাবৎ কমেডির সেই জৌলুস হারিয়েছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে কৌতুকের মতো বড় চরিত্রগুলো। এককথায় 'চরম সংকটে পড়েছে বাংলা সিনেমার কৌতুক।'
সাধারণত একটি সিনেমায় সুন্দর একটি গল্প থাকে। আর সেই গল্পের কেন্দ্রে থাকে কয়েকটি চরিত্র। যে চরিত্রগুলো পুরো সিনেমাটিকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু এই চরিত্রগুলোর মধ্যে এমন কিছু চরিত্র থাকে যাদের উপস্থিতিতে দর্শক নড়েচড়ে বসেন। বিনোদিত হন তাদের কথা ও অভিনয়ে। আর তারা হলেন কৌতুক অভিনেতা। বর্তমান সময়ে ঢাকায় চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতা নেই বললেই চলে। বাংলা চলচ্চিত্রের সূচনালগ্নে যারা দর্শকদের হাসির খোরাক জুগিয়েছেন তাদের অনেকেই আজ নেই। কেউ চলে গেছেন না ফেরার দেশে, আবার কেউ সরে গেছেন। এমনকি নতুন করে জন্ম নিচ্ছে না- সাইফুদ্দিন, হাসমত, পরান বাবু, মতি, বেবী জামান, বস্ন্যাক আনোয়ার, খান জয়নুল, রবিউল, আনিস, টেলি সামাদ, দিলদার, কাজল, সুরুজ বাঙালী, আফজাল শরীফ, ববি, সোনা মিয়া, ফ্যাটি মহসিন, জ্যাকি আলমগীরের মতো কৌতুক অভিনেতা।
বাংলাদেশের সিনেমায় দাপুটে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তারা একচেটিয়া অভিনয় করে গেছেন। পর্দায় তাদের উপস্থিতি মানেই দম ফাটানো হাসির রোল। শুধু কথা দিয়ে নয়, দর্শক পর্দায় তাদের অঙ্গভঙ্গি দেখেও হেসে গড়াগড়ি খেত। মুহূর্তে কাঁদিয়েও ফেলতে পারতেন জাত অভিনেতারা। চরিত্রের বৈচিত্র্যময়তা প্রবল ছিল এই গুণী অভিনেতাদের মধ্যে।
আশি ও নব্বইয়ের দশকের বাংলা সিনেমায় কৌতুক অভিনেতা মানেই ছিল দিলদার। অঘোষিতভাবে তিনি বাংলা কমেডির রাজপুত্র বনে গেয়েছিলেন।
কৌতুক অভিনেতা হিসেবে দিলদার জনপ্রিয়তার এমন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, তাকে নায়ক করে 'আব্দুলস্নাহ' নামে একটি সিনেমাও নির্মাণ করা হয়। ওই সিনেমাতে একজন লোক হাসানো মানুষের খোলস ছেড়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন অন্যরূপে। সিনেমাতে দর্শক তার অভিনয় দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছেন, তেমনি চরিত্রের বৈচিত্র্যও দেখিয়েছেন অভিনেতা দিলদার। কিন্তু এই অভিনেতার মৃতু্যর পর যে শূন্যতা দেখা দিয়েছিল তা আজও পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রথমদিকের সফল কৌতুক অভিনেতা ছিলেন রবিউল। শতাধিক সিনেমাতে তার হাস্যরস সৃষ্টির প্রতিভা আর্কাইভে পাওয়া যায়। তার অন্যতম গুণ ছিল তিনি কুলোর মতো কান দুটোকে তালে তালে নাচাতে পারতেন।
আমাদের চলচ্চিত্রের প্রাথমিক লগ্ন থেকে যে সব কৌতুক অভিনেতা ছিলেন তাদের মধ্যে সাইফুদ্দীন, আনিস, খান জয়নুল, আলতাফ, হাসমত- এদের সবাই এখন পরলোকগত। সর্বশেষ চলে গেলেন শক্তিমান কৌতুক অভিনেতা টেলিসামাদ, আনিস ও হাসমত। কোনোরকম ভাঁড়ামো নয়, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, ডায়ালগ এবং এক্সপ্রেশনের মাধ্যমে দর্শককে এক ধরনের নির্মল আনন্দদানে তারা ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
যতই ছোট চরিত্র হোক, কৌতুক অভিনেতার কাজটি বেশ কঠিন। একজন অসার মানুষের মুখে খিলখিল করে হাসি ফোটানোর ক্ষমতা সবার থাকে না। চলচ্চিত্রে কৌতুকশিল্পীর চরিত্র রূপায়ণের মাধ্যমে দর্শক মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতারা তো বটেই। এমনকি আমজাদ হোসেন, দিলীপ বিশ্বাস, সুভাষ দত্তের মতো বিখ্যাত নির্মাতারাও সিনেমার পর্দায় ক্যারিয়ার শুরু করেন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। সেই নব্বই দশকের কথা। সেই সময় পর্যন্ত ঢাকার চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতাদের অবস্থান ছিল জমজমাট। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল কৌতুক অভিনেতাদের।
এখনকার দর্শক, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম আগের মতো আলাদা করে কৌতুক দেখে না। তা ছাড়া কৌতুকের মতো কঠিন একটি কাজ সহজে সব শিল্পী আয়ত্তে আনতেও পারে না। ফলে এই চরিত্রে কেউ বেশিদিন টিকতে পারছে না। এখন অন্য চরিত্রের চেয়ে নায়ক-নায়িকা হওয়ার প্রতি সবার ঝোঁক বেশি। এ ছাড়া নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে বলে অনেকে আলাদা করে কৌতুকের দৃশ্য বা কৌতুকশিল্পী নিতে চায় না। তবে এ কথা মানতেই হবে যে, দর্শককে পূর্ণ বিনোদন দিতে কৌতুক বা কৌতুক অভিনেতার বিকল্প নেই।