মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন থামছে না

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস আজ
ম আব্দুলস্নাহ রায়হান
  ২৫ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ২৫ নভেম্বর ২০২১, ০৯:২৪
নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন থামছে না
নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন থামছে না

সমাজে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধে নানা তৎপরতার পরও নির্যাতন থেমে নেই। বরং করোনাভাইরাস মহামারির পরিবর্তিত বাস্তবতায় দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, প্রতি বছর নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। কেননা নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তায় সরকারের জাতীয় হেল্পলাইন '১০৯' এ চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৯ লাখের বেশি নারী ও শিশু সহায়তার জন্য ফোন দিয়েছেন। ২০১৮ সালে ছয় লাখ ৫০ হাজার এবং ২০১৯ সালে ১৮ লাখ ১১ হাজার নারী ও শিশু চিকিৎসাসেবা, কাউন্সেলিং, পুলিশি সহযোগিতা, আইনি ও অন্যান্য সহযোগিতা নিয়েছেন। এছাড়া ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেলে প্রতি বছর ১ লাখেরও বেশি নির্যাতিত নারী ও শিশু চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে যৌন নির্যাতন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে 'বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ'। তাদের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২০ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০টি ধর্ষণ, ২৩৭টি গণধর্ষণসহ চার হাজার ৬২২টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৭১১টি নির্যাতনের তথ্য পেয়েছে মহিলা পরিষদ। আর এই বাস্তবতায় প্রতি বছরের মতো আজ (বৃহস্পতিবার) আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হচ্ছে। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালন করবে বিভিন্ন সংগঠন। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে 'নারী নির্যাতন বন্ধ করি, কমলা রঙের বিশ্ব গড়ি'। বাংলাদেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে। নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলন দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উদযাপন কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস ও পক্ষ পালন করছে। শীর্ষস্থানীয় নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মতো বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৪৫১। চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ১৭৯৪টি। এ হিসেবে বৃদ্ধির হার প্রায় ২৪ শতাংশ। মহিলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্তকরণের মতো অনেক ঘটনা থানায় রিপোর্ট হয় না। মামলাও হয় না। নির্যাতিত নারী বা কন্যাশিশুর অনেক অভিভাবক পুলিশের কাছে যান না। তারা এই ভেবে ভয় পান যে, ঘটনা প্রচারিত হলে নির্যাতিত মেয়েটি সমাজের কাছে হেয় হবে অথবা আরও বেশি লাঞ্ছিত হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী বা অপরাধী প্রভাবশালী হয় অথবা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকে। তাই নির্যাতিত নারীকে মামলা করতে দেওয়া হয় না, মামলা করলেও তা ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা জানান, নারী নির্যাতনকে অনেকে অপরাধ বলেই মনে করে না, এটা তাদের জন্য আনন্দের বিষয়। এ কারণে সমাজে নারীদের প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত হতে হচ্ছে। প্রাচীন আমলের বিভিন্ন সামাজিক প্রথা, কুসংস্কার এমনকি লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে নারী এখন পুরুষের পাশাপাশি পথ চলতে শুরু করেছে; কিন্তু এ সময়ে এসেও পথেঘাটে, বাস-ট্রেনে এমনকি বাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলেও নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যৌতুক, বাল্যবিয়ে, বহুবিবাহ, ধর্ষণ, হত্যাসহ এমন নারী সহিংসতার ঘটনা নিত্যদিনের। নারীরা রাজনৈতিক সহিংসতারও শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারেই তারা সহিংসতার শিকার হয়। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার অনুপাতে মামলার সংখ্যা কম। অধিকার কর্মীরা মনে করেন, বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যত মামলা হয় তার সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ ভাগ মামলায় আসামিরা শাস্তি পায় আর শুধু ধর্ষণের হিসাব করলে এই হার আরও অনেক কম। এছাড়া নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ক্ষমতা কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা ও আইনি কাঠামোর সামগ্রিক পরিবর্তনও জরুরি। মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জানান, করোনা মহামারির সময়ে নারী নির্যাতন বেড়েছে। অথচ প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। গণমাধ্যমে নির্যাতিত নারীদের নিয়ে যেসব তথ্য দেখা যায়, তা প্রকৃত চিত্র নয়। কেননা লকডাউনের সময় গণমাধ্যমে রিপোর্ট কম প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ সময়টাতে ধর্ষণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীদের নির্যাতনের খবর বেশি পাওয়া গেছে। এ বাস্তবতায় এবারও আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হবে। মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান গণমাধ্যমকে বলেন, 'ধর্ষণ মামলায় সর্বোচ্চ দুই ভাগের বেশি শাস্তি হয় না। এছাড়া শাস্তির হার এত কম দেখে কেউ কেউ বলেন, অধিকাংশ ধর্ষণ মামলাই মিথ্যা; কিন্তু তারা ঠিক বলছেন না। আদালতে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হলে ধর্ষণের ঘটনা মিথ্যা হয়ে যায় না। মামলা দায়ের থেকে শুরু করে মামলার তদন্তসহ নানা কারণে আসামিরা বেনিফিট অব ডাউটের সুযোগে ছাড়া পেয়ে যায়।' তিনি আরও বলেন, ধর্ষণের শাস্তি মৃতু্যদন্ড করায় বিচারকরা এখন আরও বেশি সতর্ক হয়েছেন। যেহেতু মৃতু্যদন্ডের বিষয় তাই তারা কোনো ধরনের বেনিফিট অব ডাউট পেলেই ধর্ষণের আসামিকে খালাস দিয়ে দিচ্ছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে