বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

রিকুইজিশন 'আতঙ্কে' গাড়ি উধাও

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বৃহস্পতিবার ছুটি শেষে গণপরিবহণ সংকটে চরম ভোগান্তিতে পড়েন অফিস ফেরত মানুষ। ছবিটি বাংলামোটর থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

মাতুয়াইলের সাইনবোর্ড মোড়। গত বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সেখানে কথা হয় ব্যবসায়ী জামিলুর রহমানের সঙ্গে। বাঞ্ছারামপুর যাওয়ার জন্য আধা ঘণ্টা ধরে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু গাড়ি পাচ্ছেন না। জামিলুর রহমানের মতো আরও অনেককে সেখানে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

পরিবহণ মালিকেরা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাজে ব্যবহারের জন্য পুলিশ গাড়ি রিকুইজিশন করায় আতঙ্কে রাস্তায় গাড়ি বের করছেন না তারা। এ কারণে চার থেকে পাঁচ দিন ধরে রাস্তায় গণপরিবহণের সংখ্যা কমে গেছে। এ কারণে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বাসচালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, রিকুইজিশনের ভয়ে তিন দিন ধরে গাড়ি বের করছেন না তিনি। পুলিশকে টাকা দিয়ে অনেকে পার পেয়ে গেছেন।

এদিকে রিকুইজিশন আতঙ্কে রাজধানীর রাস্তা থেকে রাতারাতি বিপুল সংখ্যক গাড়ি কমে যাওয়ায় গণপরিবহণ সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এতে নগর সার্ভিসের পাশাপাশি আন্তঃজেলা পরিবহণের যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে সকাল ও বিকালের পিক-আওয়ারে এ সংকট তীব্র হয়ে উঠছে। এ সময় রাজধানীর প্রায় প্রতিটি বাস স্টপেজে অপেক্ষমাণ যাত্রীর ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।

অন্যদিকে নগরীর রাস্তা থেকে বিপুল সংখ্যক যানবাহন কমে যাওয়ায় গত কয়েক দিন ধরে ব্যস্ত সড়কে নিয়মিত যানজটের চিত্রও উধাও হয়ে গেছে। ফলে ট্রাফিক পুলিশ অনেকটা স্বস্তিতে দায়িত্ব পালন করছে।

পুলিশ জানায়, নির্বাচনী সরঞ্জাম ভোটকেন্দ্রে পৌঁছানো এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সেখানে আনা নেওয়ার জন্য বাস-মিনিবাস, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও টেম্পো রিকুইজিশন করা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী তারা চালক-হেলপারদের খাবারের টাকা ও জ্বালানি খরচ পরিশোধ করছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় গাড়ি রিকুইজিশন করা হবে। অতিরিক্ত গাড়ি রিকুইজিশনের কোনো সুযোগ নেই। রিকুইজিশনের নামে পুলিশ টাকা নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে এবং রিকুইজিশন করা গাড়ির চালক হেলপারদের খাবার বাবদ

বরাদ্দকৃত টাকা না দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

তবে চালকদের অভিযোগ, পুলিশের বরাদ্দ করা টাকা দিয়ে একজন লোকের দুই বেলা খাবার ও নাশতা হয় না। নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হয়। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করার কোনো জায়গা নেই। পরিবহণ মালিক সংগঠনগুলো পুলিশের সঙ্গে প্রতিবার নির্বাচনে বৈঠক করে খোরাকির টাকার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এবার কোনো বৈঠক হয়নি। তাই খোরাকির টাকা পাওয়া নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে চালকদের মনে। আর এমন বিশৃঙ্খলায় 'আতঙ্কে' আছেন অন্যরা। ফলে রাস্তায় গাড়ি চালাতে অনেকে অপারগতা প্রকাশ করছেন।

আমিনবাজারে কথা হয় বাসচালক জাফরের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমার গাড়ি এখনো আটকায়নি। তবে আতঙ্কে আছি, কখন সার্জেন্ট সিগন্যাল দেয় আর গাড়ি রিকুইজিশন করে।'

সরকারি কাজে আতঙ্ক কেন? -এমন প্রশ্নের জবাবে জাফর বলেন, 'শুনেছি টাকা-পয়সা ঠিকমতো দেয় না। আর থাকাও অনেক কষ্ট। বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে পাঠায়। এজন্য ভয় লাগে। এর চেয়ে বাস চালানো বন্ধ রেখে ঘরে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত ঘুমাব।'

খিলগাঁওয়ের ভাড়ার মাইক্রোবাস চালক মো. ইসমাইল জানান, সপ্তাহখানেক আগে সাভারে পুলিশ তার হাইয়েস মাইক্রোবাস আটকে কাগজপত্র নিয়ে গেছে, ধরিয়ে দিয়ে গেছে একটি রিকুইজিশন সিস্নপ। আগামী ৫ থেকে ৮ জানুয়ারি পুলিশের নির্দেশ মতো তাকে ডিউটি করতে বলা হয়েছে।

এর আগের নির্বাচনে রিকুইজিশন ডিউটি করার অভিজ্ঞতা থেকে ইসমাইল বলছেন, তেল খরচ, ড্রাইভারের খোরাকি ও ভাড়া হিসেবে নগদ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের সেই টাকাটা দেওয়া হয় না। তবে তার গ্যাসের গাড়িতে গ্যাসের পাশাপাশি ট্যাংক ভরে তেল দিয়ে দিয়েছে গত দু'বার। ইসমাইলের ভাষ্য, তাদের এলাকার ভাড়ায় চালিত অনেকে গাড়ির মালিক 'টাকা দিয়ে ম্যানেজ' করেছেন। তবে শর্ত হচ্ছে নির্বাচনের আগে পরের ওই চারদিন গাড়ি বের করা যাবে না।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সব মিলিয়ে পুলিশের গাড়ি আছে ১১ হাজার ৯২৩টি। এর মধ্যে মোটর সাইকেল ৬ হাজার ৪৪৫টি। বাকি ৫ হাজার ৪৭৮টি যানবাহন দিয়ে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে পুলিশ। যানবাহন সংকটের কারণে পুলিশের অনেক কর্মকর্তাকে অনেক সময় গাড়ি ভাড়া করে বিভিন্ন স্থানে অভিযানে যেতে হয়। এছাড়া নিজ থানা এলাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সার্বক্ষণিক টহল দেওয়ার জন্য গাড়ি রিকুইজিশন করতে হয় সারা বছরই। রিকুইজিশন করা ফিটনেসবিহীন লেগুনায় পুলিশের টহলদৃশ্য খুবই পরিচিত।

এখন কেবল পুলিশ নয়, জেলা প্রশাসনসহ ভোটের দায়িত্বে থাকা সব সংস্থার জন্যই গাড়ি রিকুইজিশনের ভার পড়েছে পুলিশের ওপর।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, নির্বাচনের প্রয়োজনে বিভিন্ন বিভাগের চাহিদা অনুযায়ি বাস, ট্রাক, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, পিকআপ রিকুইজিশন করা হচ্ছে সারা দেশেই।

ঢাকা মহানগরে কত গাড়ি রিকুইজিশন করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরই মধ্যে নির্বাচনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। রিকুইজিশন চলমান রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়ি রিকুইজিশন করা হবে।

'ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ১০৩-ক ধারায় যানবাহন রিকুইজিশন সম্পর্কে বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, পুলিশ কমিশনারের লিখিত আদেশবলে যে কোনো যানবাহন সাত দিনের বেশি নয়- এমন সময়ের জন্য রিকুইজিশন করা যাবে, যদি তা জনস্বার্থে প্রয়োজন পড়ে। আর কোনো যানবাহন রিকুইজিশন করা হলে গাড়ির মালিককে নির্ধারিত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

ওই অর্থ দেওয়া হয় না বলে যে অভিযোগ চালক-মালিকরা করছেন, তা মানতে রাজি নন মুনিবুর রহমান। তার ভাষ্য, সরকারি যা নিয়ম রয়েছে, সে আনুযায়ী টাকা দেওয়া হয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী সেই অঙ্কটি কোন গাড়ির ক্ষেত্রে কত, কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেও তা জানা যায়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পরিবহণ) জ্যোতির্ময় সরকার বলেন, নির্বচানের সময় বিভিন্ন জায়গায় বাড়তি ডিউটি করতে হয়। এই কাজ করতে গিয়ে যে পরিমাণ যানবাহন দরকার সেটা না থাকায় রিকুইজিশন করতে হচ্ছে। এটা প্রতি নির্বাচনের সময়ই হয়ে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে