মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
ব্যাংক ডাকাতি

বান্দরবানে যৌথ অভিযান শুরু

রুমা ও থানচিতে ৪ মামলা থানচির পরিস্থিতি থমথমে পরিবারের কাছে ফিরেছেন অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার পরিস্থিতি পরিদর্শনে আজ যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
যাযাদি ডেস্ক
  ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
বান্দরবানে সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিরুদ্ধে শুক্রবার যৌথ সাঁড়াশি অভিযানে পুলিশ সদস্যদের সতর্ক অবস্থান -সংগৃহীত

বান্দরবানে পাহাড়ের নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিরুদ্ধে শুক্রবার থেকে যৌথ সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছের্ যাব। এ দিন বেলা ১১টায়র্ যাব বান্দরবান জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সেনাবাহিনী,র্ যাব, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ এই অভিযান কেএনএফ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত চলবে। সন্ত্রাসীদের দমনে পাহাড়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরের্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের সহকারী পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দু'টি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমত, টাকা লুটপাট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, সক্ষমতা প্রদর্শন করা।

কেএনএফ তাদের সমর্থক ও প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দেখাতে চাইছে, তারা যথেষ্ট শক্তিশালী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই লক্ষ্যে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কাজ করছিল। কিন্তু সেই সুযোগে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, অস্ত্র লুট, পুলিশ ক্যাম্পে গুলিবর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালিয়েছে।

এদিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের শাখার অপহৃত ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছের্ যাব। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়র্ যাবের ইন্টেলিজেন্স টিমের সদস্যরা ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকায় ড্রোন দিয়ে দুষ্কৃতকারীদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করে। পরে তাদের সঙ্গে যেকোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে। আমাদের চেষ্টা ছিল ম্যানেজারকে অক্ষত উদ্ধার করা। এ জন্য যা যা করা প্রয়োজন আমরা করেছি। তারা ম্যানেজারকে রুমার বেথেলপাড়ায় একটি স্থানে রেখে গেলে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। তদন্তের গোপনীয়তার কারণে আমরা সেই স্থানের নাম এখন উলেস্নখ করছি না। পরে রাতেই তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

তিনি আরও বলেন, গত ২ এপ্রিল তারা (কেএনএফ) রুমায় মসজিদ, ব্যাংক, উপজেলা পরিষদে হামলা চালায়। তারা পরিকল্পিতভাবেই এই হামলা চালায়। তাদের টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই তারা এসেই ব্যাংক ম্যানেজারকে খুঁজতে থাকে। প্রথমে ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন অস্বীকার করলেও পরে সবাইকে জিম্মি করে, জিজ্ঞাসাবাদ করে নিজাম উদ্দিনকে শনাক্ত করে। ব্যাংক ম্যানেজারের কৌশলের কারণে সেদিন ব্যাংকের ভল্টের কোনো চাবি তারা পায়নি। তারা ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে। পরে আশপাশের পরিস্থিতি দেখে তারা ব্যাংক ম্যানেজারের মুক্তিপণের জন্য ১ কোটি টাকা দাবি করেছিল। তবে ব্যাংক ম্যানেজার টাকা দেননি বিধায় তাকে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে পাড়ার বাইরে দিয়ে পাহাড়ি পথে নিয়ে যায়। তারা তাকে স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়। তাকে নিরাপদে উদ্ধার করার জন্য বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে অপরাধীদের শনাক্ত করতে সিসিটিভি ফুটেজ ও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সম্মিলিত সাঁড়াশি অভিযানে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। লুট করে নেওয়া ১৪টি অস্ত্র উদ্ধারসহ তাদের নির্মূল করা হবে।

রুমা ও থানচিতে ৪ মামলা : এদিকে বান্দরবানের রুমা এবং থানচিতে ব্যাংকের টাকা ও অস্ত্র লুট এবং ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনায় চারটি মামলা করা হয়েছে। রুমায় তিনটি ও থানচিতে একটি মামলা করা হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে শুক্রবার থানচি থানার ওসি জসীম উদ্দিন বলেন, রুমা কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার লাচি থোয়াই মারমা বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ৩০ থেকে ৪০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। সোনালী ব্যাংক ম্যানেজারকে মামলা করতে থানায় আসতে বলা হয়েছে।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রায়হান কাজেমী জানান, ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে রুমায় তিনটি ও থানচিতে একটি মামলা করা হয়েছে।

থানচির পরিস্থিতি থমথমে : এদিকে দু'টি ব্যাংকে হামলা, অস্ত্র লুট, অপহরণ ও গোলাগুলির ঘটনার পর বান্দরবানের থানচি উপজেলা সদরে শুক্রবার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। বন্ধ ছিল থানচি বাজারের বেশির ভাগ দোকানপাট। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে গেছেন অনেক নারী ও শিশু।

অন্যদিকে থানচি এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি ও পুলিশের সতর্ক পাহারা দেখা গেছে। পুলিশ বলছে, নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আতঙ্কের কোনো কারণ নেই।

এ দিন দুপুরে থানচি উপজেলা সদরের ব্রিজের মাথায় গিয়ে দেখা যায়, চাঁদের গাড়ি করে এলাকা ছাড়ছেন অনেকে। সেখানে কথা হয় স্থানীয় টিঅ্যান্ডটি পাড়ার বাসিন্দা জুলি আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, দিন দিন গোলাগুলির ঘটনা বাড়ছে। ছোট দুই ছেলেমেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে। তাই তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে বান্দরবান সদরে চলে যাচ্ছেন। জুলি আক্তারের সঙ্গে থাকা রিনা আক্তার বলেন, তিনিও সন্তানদের নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

সদরের ব্রিজের মাথা এলাকা থেকে বান্দরবান সদরগামী চাঁদের গাড়ি ছাড়ে। সেখানে প্রায় আট ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা গেছে, পাঁচটি চাঁদের গাড়ি করে যাওয়া যাত্রীদের বেশির ভাগ এলাকা থেকে চলে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে বেশি নারী ও শিশুরা।

থানচি উপজেলা সদরের ইউপি চেয়ারম্যান অং প্রম্ন মোরং বলেন, নারী ও শিশুরা আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন পরিচিতজনের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।

কাপড়ের দোকানদার নুরুল আলম বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে তিনি যখন গুলির শব্দ পান, তখন ভয়ে দোকান ছেড়ে চলে যান। ১০ মিনিট পর আবার এসে দোকান বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকেন। গোলাগুলি বন্ধ হওয়ার পর বাসায় যান। ভয়ে সকাল থেকে আর দোকান খোলেননি তিনি। দুপুরে বিজিবি নামার পর দোকান খুলেছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, এই বাজারে ২৪০টি দোকান রয়েছে। শুক্রবার দুপুরে ১৫ থেকে ২০টি দোকান খোলা দেখা গেছে। বাকিগুলো ছিল বন্ধ।

থানচি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, তারা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

এদিকে পরপর দু'টি গোলাগুলির ঘটনায় থানচি বাজারের ব্যবসায়ীদের কেনাবেচা কমে গেছে। বাজারের তরমুজ বিক্রেতা মোহাম্মদ সাকিব বলেন, গোলাগুলির ঘটনার আগে তিনি ৪০ থেকে ৫০টি তরমুজ বিক্রি করতেন। কিন্তু আজ (শুক্রবার) মাত্র দু'টি বিক্রি করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন বাজারে লোকজন নেই।

শুঁটকি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মুসা জানালেন একই কথা। তিনি বলেন আগে দৈনিক ১০ হাজার টাকার শুঁটকি বিক্রি করতেন। এখন দুই হাজার টাকারও বিক্রি করতে পারছেন না।

থানচি থানায় কথা হয় সহকারী পুলিশ সুপার এসপি জুনায়েদ জাহিদীর সঙ্গে। তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। তিন থানায় তদারকের জন্য একজন করে এএসপি এসেছেন।

থানচি থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, গোলাগুলির পর থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। অতিরিক্ত আরও ১০০ পুলিশ সদস্য থানায় আসছেন। লোকজনের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানান তিনি।

পরিস্থিতি পরিদর্শনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাচ্ছেন আজ

এদিকে নতুন করে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। যাদের সন্ত্রাস আর লুটপাটের কারণে আতঙ্কে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। বান্দরবানে সশস্ত্র হামলা ও ব্যাংকে লুটপাটের পর বর্তমানে সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তাই সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি পরিদর্শনে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

শুক্রবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মো. শরীফ মাহমুদ অপু জানান, শনিবার (আজ) ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে বান্দরবানে যাবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

মন্ত্রী বান্দরবানের রুমাসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করবেন। এ সময় তিনি বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। শনিবার দুপুরে বান্দরবান সার্কিট হাউসে মতবিনিময় শেষে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন তিনি।

ঢাকা থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে যাবেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।

প্রসঙ্গত, বান্দরবানের দুই উপজেলায় মঙ্গলবার রাতে ১৭ ঘণ্টার মধ্যে দু'টি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা, অস্ত্র লুট ও অপহরণের ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠী। পরে গভীর রাতে আলীকদম উপজেলায় পুলিশ ও সেনাদের একটি যৌথ তলস্নাশি চৌকিতে হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। তবে কারা গুলি চালিয়েছে, এ বিষয়ে পুলিশ স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। যদিও এর আগে মঙ্গলবার রাতে বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ এবং পুলিশ ও আনসারের ১৪টি অস্ত্র লুটের ঘটনায় কেএনএফ জড়িত বলে বলা হয়েছিল। এদিকে রুমা থেকে অপহৃত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিন প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছাড়া পেয়েছেন।

২০২২ সালের মাঝামাঝিতে সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকায় তৎপরতা শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে সমতলের জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া জঙ্গিগোষ্ঠীকে পাহাড়ের গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই বছরের অক্টোবরে কেএনএফ ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে র?্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্মিলিত অভিযান পরিচালনা করে। পরে কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ২৯ মে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ৫ নভেম্বর ও গত ৫ মার্চ দুই দফা কমিটির বৈঠকে কেএনএফ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড না করার প্রতিশ্রম্নতি দেয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে