সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন

উৎসব নেই, সবার হাতে বইও নেই!

বই ছাপায় বিলম্বের কারণ সম্পর্কে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহেদ উদ্দিন মাহমুদ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, গল্পের একেবারে শেষ ছাড়া যেমন ষড়যন্ত্রকারী কে তা বোঝা যায় না, এখানেও তেমন। যে কেউ হতে পারে
যাযাদি রিপোর্ট
  ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
উৎসব নেই, সবার হাতে বইও নেই!
উৎসব নেই, সবার হাতে বইও নেই!

সারা দেশে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হলেও বছরের প্রথমদিনের সেই পরিচিত বই উৎসব এবার দেখা যায়নি। উৎসব ছাড়াই আংশিকভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির কিছু বই সরবরাহ করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই পৌঁছায়নি, যা শিক্ষার্থীদের মনে হতাশা তৈরি করেছে।

মিরপুরের রশীদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাবেয়া আক্তার সকালে বই নিতে স্কুলে আসলেও, মেয়েটিকে ফিরতে হল খালি হাতে। এবারে নতুন বই 'দেওয়া হবে' এমন খবর স্কুল থেকে না জানানো হলেও, আগের কয়েক বছরের অভ্যাসের বশে বুধবার সকাল সকাল মায়ের সঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল রাবেয়া।

1

এই শিক্ষার্থী বলেছে, 'সব সময় প্রথম দিন বই নিতে আইতাম; একারণে আইছি। নতুন বইয়ের আনন্দই আলাদা, খুলে দেখতাম, গন্ধ নিতাম। কিন্তু আজকে আর ওইরকম আগের মত কিছু হইল না।'

রাবেয়ার মা গৃহিনী উম্মে কুলসুম জানালেন, কবে নতুন বই পাওয়া যাবে, স্কুল সেই তথ্য জানাতে পারছে না। তিনি বলেন, 'এমনিতেই বইয়ে নাকি পরিবর্তন আসবে, তাও যদি দেরি হয় তাইলে তো পোলাপানের পড়ালেখার সমস্যা হবে।'

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে বছরের প্রথম দিন স্কুলে স্কুলে উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার রেওয়াজের শুরুটা হয়েছিল ২০১০ সালে, যা দেখা গেছে ফেলে আসা বছরেও।

তবে ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই চক্র ভেঙেছে, এবার স্কুলগুলোতে সেই আয়োজন নেই। নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে সব নয়, কোনো কোনো বিষয়ের পাঠ্যপুস্তুক তুলে দিতে পেরেছেন শিক্ষকরা।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) আগেই জানিয়েছিল বছরের প্রথম দিন এবার নতুন কোনো পাঠ্যবই হাতে পাবে না প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ; যাদের এজন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত।

প্রাথমিকের অন্য শ্রেণির মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই হাতে পাবেন আরও কয়েকদিন পর। আর মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা জানুয়ারির শুরুতে কিছু বিষয়ের বই পাবেন। তবে এবার বছরের প্রথম দিনই সব পাঠ্যবইয়ের সফট কপি অনলাইনে প্রকাশ করবে এনসিটিবি।

পলস্নবীর এমডিসি মডেল ইন্সটিটিউট এর নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গণিত, ইংরেজি, বাংলা এই তিনটি বই পেয়েছে।

স্কুলটির নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফিফা চৌধুরী সারাহ বলে, 'বাকি বই কবে পাব এগুলা বলেনি। একটু আগে পেলে পড়তে ইজি হত। এখন একটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে, কবে সব বই পাব তা নিয়ে। ব্যপারটা দুঃখজনক বলার যায়, সব বই পেয়ে গেলে রুটিন করে সিলেবাস শেষ করার পস্ন্যান করতে পারতাম।'

এবার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাবর্ষের নবম শ্রেণির বইয়ের উপর ২০২৬ সালে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।

এমডিসি মডেল ইন্সটিটিউট এর দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী লাবিবা আয়েশা রহমান বলে, 'অন্যান্য বছর দুই বছরে একটা বই শেষ করে পরীক্ষা দিতে হত। এবার আমাদের একবছরে আবার নতুন বই পড়তে হবে। তার মধ্যে সব বই পাচ্ছি না, কবে পাব জানি না। ইনফরমেশন গ্যাপ থেকে যাবে। দ্রম্নত সময়ে তো সিলেবাস শেষ করা যাবে না।'

রশীদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবদাস বারুরী সরকার বলেন, তার স্কুলে গণিত, ইংরেজি আর বাংলা বই এসেছে। সকালে শ্রেণিকক্ষে ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক বারুরী সরকার।

তিনি বলেন, 'উপস্থিত বাচ্চাদের দিয়ে দিয়েছি। যেদিন সরকার সব বই ছাড়বে তখন বাকিগুলা দেব। হয়ত সপ্তাহ খানেক দেরি হবে, এর বেশিও হতে পারে।'

বই পায়নি অনেক স্কুল:মিরপুর ১২ নম্বরের কিডস ক্যাম্পাস স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। তবে স্কুলটিতে গিয়ে কোন শিক্ষার্থীর আনাগোণা দেখা যায়নি। আগামী সোমবার স্কুলটি খুলবে। তখন শিক্ষার্থীদের পুরনো বইয়ের উপরই ক্লাস নেওয়া হবে বলে জানান স্কুলটির প্রধান শিক্ষক রাজিয়া সুলতানা।

তিনি বলেন, 'আমরা তো বই পাইইনি, দেব কী করে? বাচ্চারা ক্লাসে আসলে তাদের বেসিক নলেজ দিতে হবে। বই পেতে দেরি হলে একটু তো অসুবিধা হবেই। পুরনো বইই পড়াব, শিখলে তো অসুবিধা নাই।'

প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় মিরপুরের লিটল ফ্লাওয়ার্স স্কুলে। এ স্কুলটিরও কোন শিক্ষার্থী নতুন বই হাতে পায়নি।

লিটল ফ্লাওয়ার্স স্কুলের হিসাব রক্ষক উম্মে সাদিকা বলেন, 'বই তো দেয়নি সরকার। ৫ তারিখে স্কুল খুললে পুরাতন বই দিয়ে পড়ানো হবে। তারপর সরকার যখন নতুন বই দেবে তখন নতুন বই দিয়ে ক্লাস হবে।'

বই বিতরণ নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে :শিক্ষা উপদেষ্টা

এদিকে,অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছেন, বই বিতরণ নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে।ষড়যন্ত্রকারীরা বই বিতরণে নানাভাবে বাধা দিয়েছে। যারা এসব করেছে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ সময় নতুন বছরের প্রথম দিনে দেশের সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিতে না পারায় শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।

বুধবার 'পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন ও মোড়ক উন্মোচন' অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

পাঠ্যবই ছাপার কাজটা যুদ্ধের মতো হয়েছে জানিয়ে ঠিক কবে নাগাদ সব বই ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া যাবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রম্নতি দিতে অপারগতা জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, 'পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান বলছেন ১৫ জানুয়ারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলছেন ৩০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই দেওয়া যাবে। আমি কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো কমিটমেন্ট দেবো না। পাঠ্যবই কবে ছাপা শেষ হবে, তা নিয়ে আমি কিছু বলবো না। বই ছাপার প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে কিছু কথা বলবো। আমি মনে করি, পাঠ্যবই ছাপার কাজটা এবার শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের মতো হয়েছে।'

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'প্রথম সমস্যাটা হলো- আমরা বিদেশি বই ছাপাবো না। তারপর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে অনিবার্য কারণে। তাতে বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। যখন কাজ শুরু করা হয়েছিল, সেটা অনেক দেরিতে হয়েছে। অনেকগুলো বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। রাজনীতিতে নিরপেক্ষ বলে কিছু থাকে না, দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষ সবকিছু যেন বইয়ে থাকে, সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'শিশুদের কাছে বই যাবে, সেটা ভালো কাগজে ছাপা না হলে তো হয় না। সেজন্য উন্নতমানের ছাপা, উন্নত মানের কাগজ ও মলাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া এনসিটিবিতে আগে যারা কাজ করেছেন, তাদের অনেককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের বসানো হয়েছে, তারা অভিজ্ঞ। কিন্তু মুদ্রণ শিল্প সমিতির যে নেতা, তাদের সঙ্গে কীভাবে বোঝাপড়াটা করতে হয়, এটা তাদের অভিজ্ঞতায় নেই। সেটা করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও এর মধ্যে ঢুকতে হয়েছে।'

পাঠ্যবই নিয়ে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, 'গল্পের একেবারে শেষ ছাড়া যেমন ষড়যন্ত্রকারী কে তা বোঝা যায় না, এখানেও তেমন। সেটা সরকারের কেউ হোক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হোক, এনসিটিবির হোক, মজুতদার হোক, সিন্ডিকেট হোক। মানে যে কেউ হতে পারে। তবে এখনই আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে আমরা একচেটিয়া ব্যবসা কমিয়ে আনবো। এটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।'

এবার পাঠ্যবই দেরিতে দেওয়া হলেও মান ভালো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বই দিতে এবার বেশ খানিকটা দেরি হচ্ছে, সেজন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এটা সত্যি দুঃখজনক।'

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'তবে একটা বিষয় আমরা বলতে চাই, বই একটু দেরিতে পেলেও সেটা ভালো বই পাবেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে যাবে না। তেমন বই আমরা দিচ্ছি না। এটা নিশ্চয় ভালো দিক।'

নতুন যে শিক্ষাক্রম আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয় জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, 'অনেকে সমালোচনা করছেন কেন পেছনের শিক্ষাক্রমে ফিরে গেলাম আমরা। আমি মনে করি, যে শিক্ষাক্রম করা হয়েছিল নতুন করে, সেটাতে থাকলে শিক্ষার্থীরা আরও পশ্চাৎপদে যাওয়া হতো।'

তিনি বলেন, 'দুই বছর এ শিক্ষাক্রম চালিয়ে গেলে সেখান থেকে ফেরার উপায় ছিল না। সেটা সহজও হতো না। সেজন্য আমরা সাময়িকভাবে পেছনের শিক্ষাক্রমে গেছি। এটা আবার এগিয়ে নেওয়ার কাজ করা হবে। এবার কিছু পরিমার্জন হয়েছে। আগামীতে আরও পরিমার্জন করা হবে। যাতে শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিকতার কোনো ঘাটতি না থাকে।'

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার শিক্ষাবিষয়ক বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ড. এম আমিনুল ইসলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম, এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রমুখ।##

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে