ভ্যাট ফাঁকি রোধে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) ও ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন স্থাপনসহ দফায় দফায় নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর বেশিরভাগই সফলতার মুখ দেখেনি। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা ভোক্তার কাছ থেকে নির্ধারিত হারে ভ্যাট আদায় করলেও তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে এর একটি বড় অংশ নিজেদের পকেটস্থ করছেন। এ কাজে সহায়তা করে ভ্যাট আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ হাতিয়ে নিচ্ছেন। অথচ দুর্নীতির এসব বড় ফাঁক বন্ধ না করেই ভোক্তার ঘাড়ে বাড়তি ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দিতে সম্প্রতি নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও ঊর্ধ্বমুখী হলেও সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
তাদের ভাষ্য, ভ্যাট আদায় বাড়াতে হলে সবার আগে ফাঁকি রোধে শক্তিশালি ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে ভ্যাট ফাঁকির সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ভ্যাটের হার যতই বাড়ানো হোক না কেন তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাভবান হবেন ব্যবসায়ী ও ভ্যাট আদায়কারী কর্মকর্তারাই। আর বাড়তি ভ্যাটের বোঝায় ভোক্তারা চিড়েচ্যাপ্টা হবেন। তাই ভ্যাট বাড়ানোর আগে এর ফাঁকি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন তারা।
যদিও ভ্যাট ফাঁকি রোধে এনবিআর বরাবরই সোচ্চার এবং ভ্যাট ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। তবে তাদের এ দাবির সঙ্গে বাস্তবতার যে যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে তা বিগত সময়ের বিভিন্ন ভ্যাট ফাঁকির তথ্য এবং ভ্যাট আদায়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে।
এনবিআরের ভ্যাট আদায়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৪৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ মাসে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। আর প্রতিটি ভ্যাট কমিশনারেটে ভ্যাট আদায়ের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
শুধু নভেম্বরের ভ্যাট তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রংপুর ভ্যাট কমিশনারেট ছাড়া প্রতিটি ভ্যাট কমিশনারেট নভেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। একক মাস হিসেবে নভেম্বরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ভ্যাট কমিশনারেটগুলো আদায় করেছে ১০ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। শুধু নভেম্বরে ভ্যাটে ঘাটতি তৈরি হয়েছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।
ভ্যাট আদায় কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক কমিশনার জানিয়েছেন, ভ্যাট কমে যাওয়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আগে অডিট ও প্রিভেন্টিভের মাধ্যমে বেশকিছু রাজস্ব আহরণ করায় এক ধরনের শ্লথগতি দেখা দিয়েছে। এনবিআরের সিলেক্টেড প্রতিষ্ঠান ছাড়া এসব কার্যক্রম নেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া বর্তমান সার্বিক ব্যবসায়িক পরিস্থিতিও ভ্যাট আদায়ের অনুকূলে নয়।
তবে তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, উলেস্নখিত সময়ে প্রতিটি পণ্য ও সেবায় ভোক্তার কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত হারেই ভ্যাট কেটে রাখা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকলেও তা স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসে। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত নভেম্বরে ভ্যাটে ঘাটতি তৈরির বিষয়টি অনেকটাই অযৌক্তিক।
এদিকে ভ্যাট আদায়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য ট্র্যাক ও সঠিকভাবে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালু করলেও কাঙ্খিত সাফল্য আসেনি। ব্যবস্থা চালু করার এক বছরের মধ্যে প্রত্যাশিত সাফল্য না পাওয়ায় রাজস্ব বোর্ডকে বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ভ্যাট প্রশাসনে গতি ফেরাতে এবং ভ্যাট আহরণ বাড়াতে ২০০৮ সালে সরকার ইলেকট্রনিক্স ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) মেশিন চালু করেছিল। সেই প্রকল্প সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে ইএফডি নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিল এনবিআর। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এখন খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায়ে খুঁজছে বিকল্প উপায়।
২০১৮ সালে অত্যাধুনিক ইএফডি মেশিন বসানোর পরিকল্পনা নেয় এনবিআর। তবে শুরুতেই বাধে জটিলতা। এনবিআরের সিদ্ধান্ত ছিল, খুচরা ব্যবসায়ীদের এককালীন ২০ হাজার ৫৩৩ টাকা বা তিন মাসের কিস্তিতে ইএফডি মেশিন ভেন্ডরদের কাছ থেকে কিনতে হবে। এতে ব্যবসায়ীদের সাড়া না পাওয়ায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সংস্থাটি। ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে বিনামূল্যে মেশিন সরবরাহে প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসের সঙ্গে ২০২২ সালের নভেম্বরে চুক্তি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কাঙ্খিত সংখ্যক মেশিন স্থাপন করতে পারেনি।
এনবিআর সূত্র জানায়, ৫ বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৩ লাখ ইএফডি ও এসডিসি (সেলস ডাটা কন্ট্রোলার) ডিভাইস স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে ২০২২ সালের নভেম্বরে জেনেক্সের সঙ্গে চুক্তি করে এনবিআর। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রথম বছরে ৩০ হাজার ডিভাইস বসানোর কথা ছিল। অথচ এই সময়ের মধ্যে জেনেক্স ডিভাইস বসিয়েছে ১৫ হাজার ৯৯৫টি। এর মধ্যে ৮ হাজার ডিভাইসের ক্ষেত্রে এনবিআরের স্পেসিফিকেশন না মেনে আমদানি নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়।
এদিকে শুধু রেস্টুরেন্ট খাতে ভোক্তার কাছ থেকে আদায়কৃত ভ্যাটের বড় অংশই যে সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না তা এনবিআরের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, মনিটরিং ও সক্ষমতার অভাব এবং ভ্যাট আদায়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ভ্যাট ফাঁকি রোধে বড় ধরনের ফাঁক থাকার কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতি বছর রেস্টুরেন্ট থেকে যৎসামান্য ভ্যাট আদায় করতে পারছে। যদিও এ খাতে ভোক্তার কাছ থেকে বিপুল অংকের ভ্যাট আদায় হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) মোট দেশ উৎপাদন বা জিডিপিতে হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতের অবদান জানতে ২০২২ সালে একটি জরিপ চালায়। জরিপের তথ্য মতে, ২০০৯-১০ সালে যেখানে দেশে হোটেল-রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার, সেখানে ২০২১ সালে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩৬ হাজারে। এক দশকে জিডিপিতে মূল্য সংযোজন বেড়ে হয়েছে আট গুণ। এক দশক আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে মূল্য সংযোজন হয়েছিল মাত্র ১১ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে হোটেল-রেস্তোরাঁ খাত থেকে মূল্য সংযোজন হয়েছে ৮৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা।
ভ্যাট আইন অনুযায়ী, পণ্য ও সেবার বিপরীতে গ্রাহকদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে প্রতি মাসে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর দায়িত্ব। কিন্তু অনেক রেস্টুরেন্ট ভ্যাট আদায় করলেও সরকারি কোষাগারে জমা দেয় না। বছর দুয়েক আগে এনবিআর ভ্যাট ফাঁকি রোধে রাজধানীজুড়ে নিয়মিত অভিযান চালালে নামিদামি অনেক রেস্টুরেন্টের ভ্যাট ফাঁকির চাঞ্চল্যকর তথ্য জনসমক্ষে আসে। গুলশানের পূর্ণিমা রেস্টুরেন্ট, মাদানি অ্যাভিনিউ'র শেফস টেবিল, ধানমন্ডির স্টার রেস্টুরেন্ট, গুলশানের খানা খাজানা, দ্য মিরাজ, র'ক্যানভাসের মতো রেস্টুরেন্টকে জরিমানা করা হয়। তবে ক'দিন না যেতেই সেই সাড়াশি অভিযান ঝিমিয়ে পড়ে।
সম্প্রতি সরেজমিনে খিলগাঁও ও ভাটারা এলাকার কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার অধিকাংশ রেস্টুরেন্টে ভ্যাট নেওয়া হয় না। আবার অনেক রেস্টুরেন্ট নিজস্ব সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভ্যাট আদায় করছে। তবে সেই ভ্যাটের খুবই সামান্য অংশ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হচ্ছে। ভ্যাট আদায়ের দায়িত্বে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তারা ব্যবসা চালাচ্ছে। বিক্রির তথ্য গোপন করতে মোবাইল ব্যাংকিং বা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে বিল নেওয়া হচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কোনো সদুত্তোর পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে তাদের খোঁড়া যুক্তি- জনসচেতনতা ছাড়া ভ্যাট আদায় বাড়ানো সম্ভব নয়। কারণ মাঠপর্যায়ের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় ছাড়াও শিল্প-কলকারখানা থেকে ভ্যাট আদায়ে কাজ করতে হয়, রিটার্ন যাচাই-বাছাই ছাড়া আরও অনেক কাজ থাকে। তাই তার পক্ষে সার্বক্ষণিক মনিটরিং দুরূহ ব্যাপার। ভোক্তারা এগিয়ে না এলে সিস্টেম দিয়ে কখনোই শতভাগ ভ্যাট আদায় করা যাবে না।
তবে বেশকিছু রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ভোক্তার কাছ থেকে আদায়কৃত ভ্যাটের একটি সামান্য অংশ সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছেন। তবে ভ্যাট আদায়ে দায়িত্বরত রাজস্ব কর্মকর্তাদের বড় অংকের উৎকোচ দিতে হচ্ছে। তবে এতেও তাদের সঙ্গে অবৈধ চুক্তিতে না গেলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের ইচ্ছে না থাকলেও তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে হচ্ছে।
এদিকে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্সের (ভ্যাট) ম্যানুয়াল পদ্ধতির অডিট বন্ধ করে দেওয়ায় নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভ্যাট আদায়ে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এ সুযোগে অনেক অসাধু প্রতিষ্ঠান রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ নিচ্ছে। খোদ এনবিআরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তা স্বীকার করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যবসায়ীদের হয়রানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট কমিশনারেটগুলোর অভ্যন্তরীণ অডিট ও প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে এনবিআর। সংস্থাটি বিভিন্ন ভ্যাট কমিশনারেটে অটোমেটেড পদ্ধতি বাস্তবায়ন না করেই ম্যানুয়াল অডিট বন্ধ করতে চিঠি দিয়েছে। এনবিআরের এই চিঠিতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল অটোমেটেড পদ্ধতি অডিট সিলেক্টিভিটি কার্যক্রম চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত এনবিআরের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানকে অডিটের জন্য নির্বাচন করা যাবে না। যদিও দীর্ঘদিন ধরে এনবিআরের ভ্যাট কমিশনারেটগুলোর যেসব প্রতিষ্ঠান অডিট করা প্রয়োজন, তা সংশ্লিষ্ট কমিশনারের নির্দেশে নির্বাচন করা হতো। এনবিআরের এ ধরনের নির্দেশনা জারি হওয়ার পর ভ্যাট কমিশনারেটের অডিট কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। এ ছাড়া ভ্যাট কমিশনারটের অভ্যন্তরীণ প্রিভেন্টিভ কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ রয়েছে। এতে ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন খোদ ভ্যাট কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, অডিট নিয়ে কিছু হয়রানির অভিযোগ থাকলেও বড় অঙ্কের ভ্যাট আদায় হয়েছে। অথচ এ ধরনের নির্দেশনার পর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভ্যাট আদায়ের গতি কমেছে। এ ছাড়া বড় ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নানা ধরনের চাপ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন একাধিক ভ্যাট কর্মকর্তা।
ম্যানুয়াল অডিট বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নতুন পদ্ধতি চালু না করেই ম্যানুয়াল পদ্ধতি বন্ধ করা হয়েছে। মূলত ব্যবসায়ীদের অভিযোগের ভিত্তিতে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। তবে এনবিআরের অনুমোদন সাপেক্ষে অডিট করা যাবে। সেক্ষেত্রে জটিলতা আরও বেড়েছে। আর অডিট ও প্রিভেন্টিভ কার্যক্রমে গতি না থাকায় ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এদিকে ভ্যাট ফাঁকি রোধে বড় ধরনণর ফাঁক থাকায় বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠান যে বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে, তা বেশকিছু অনুসন্ধানেই বেরিয়ে এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-ভ্যাট) দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজস্ব কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে উচ্চমূল্যে সিগারেট বিক্রি করে এবং সেই অনুযায়ী কর না দিয়ে আইন ভঙ্গ করেছে দেশের একক সর্বোচ্চ করদাতা ও শীর্ষ তামাকপণ্য কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশ লিমিটেড। চার অর্থবছরে একই পন্থায় ৩৭৯ কোটি টাকা মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
রাজস্ব বোর্ডের এলটিইউ-ভ্যাট বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটি এই কৌশলে ১৬৯ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেয়। পরবর্তীতে কোম্পানিটির আগের অর্থবছরগুলোর মজুত পণ্যের তথ্য নেন কর্মকর্তারা। তখন জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরেও কোম্পানিটি ৮৮ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দিয়েছে ৫৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ৩০৯ প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৪১ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি চিহ্নিত করেছে। বড়মাপের এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই ভ্যাট রিটার্নে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন ও প্রকৃত অডিটের তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। পণ্য বেচাকেনা, উৎপাদন, লাভ-লোকসানসহ আয়-ব্যয়ের সব হিসাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
এসব প্রতিষ্ঠান একাধিক অডিট রিপোর্ট তৈরি করেছে। প্রকৃত অডিট রিপোর্ট গোপন রেখে মিথ্যা হিসাব দিয়ে তৈরি অডিট রিপোর্টের সঙ্গে মিলিয়ে ভ্যাট রিটার্ন দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যাংকিং লেনদেনে রয়েছে প্রকৃত হিসাব। সম্প্রতি ভ্যাট গোয়েন্দাদের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে ফাঁকির এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ভ্যাট ফাঁকির ৩০৯ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সিগারেট, সিরামিক, মোবাইল, অটোমোবাইল, তৈরি পোশাক খাত ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, ওষুধ, ইলেট্রনিক্স, কোমল পানীয়, ব্যাংক, সিরামিক, টয়লেট সোপ, প্রাকৃতিক গ্যাস, আবাসন, ইলেট্রনিক্স, জুতা-স্যান্ডেল, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী, পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, ওষুধ বিক্রয়কারী, ডায়াগস্টিক ও ক্লিনিক বেশি।
ব্যাংক দখলের জন্য দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রম্নপের আরও ১০ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), যার পরিমাণ ১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের তদন্তে ভ্যাট ফাঁকির এই তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এস আলমের যেসব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে, সেগুলো হলো এস আলম স্টিলস, চেমন ইস্পাত, এস আলম রিফাইন্ড সুগার, এস এস পাওয়ার, এস আলম পাওয়ার পস্ন্যান্ট, এস আলম প্রোপার্টিজ, এস আলম কোল্ড রি-রোলিং মিলস, মাসুদ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, এস আলম ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং মিলস, এস আলম সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ।
এ ছাড়া কয়েক মাসে একই ভ্যাট কমিশনারেট এই শিল্পগোষ্ঠীর অপর দুই প্রতিষ্ঠান এস আলম ভেজিটেবল অয়েল ও এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছিল। বিষয়টি এখন আদালতে গড়িয়েছে। সব মিলিয়ে এই পর্যন্ত এস আলম গ্রম্নপের ১২ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পেয়েছেন ভ্যাট কর্মকর্তারা।