মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর ৪১তম মৃতু্যবার্ষিকী আজ। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তির মহানায়ক।
জাতির এ কৃতী সন্তানের ৪১তম মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে তার জন্মস্থান সিলেটসহ দেশের বিভিন্নস্থানে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ১৯১৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর একটি মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ওসমানীর পৈতৃক নিবাস বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলাধীন দয়ামীর গ্রামে। ওসমানীর পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ও মাতা জোবেদা খাতুন ছিলেন দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক ও জননী। তিনি ছিলেন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। শৈশবে ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকেই। কোনো স্কুলে ভর্তি না হয়ে, ঘরে বসে বসেই তার বিদুষী মায়ের অনুশাসন এবং যোগ্য গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাংলা ও ফার্সি ভাষায় ওসমানী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৯ সালে ১১ বছর বয়সে ওসমানীকে আসামের গৌহাটির কটনস স্কুলে ভর্তি করা হয়। কটনস স্কুলে পড়াশোনা শেষ করার পর মায়ের ইচ্ছায় ১৯৩২ সালে সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। এই স্কুল থেকে ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং ইংরেজিতে কৃতিত্বের জন্য 'প্রিটোরিয়া অ্যাওয়ার্ড' লাভ করেন।
১৯৩৪ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি ১৯৩৬ সালে আইএ পাস করেন। ১৯৩৮ সালে বিএ পাস করেন।
১৯৩৯ সালে ভূগোলে এমএ প্রথম পর্ব পড়ার সময় ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ছাত্র হিসেবে সব সময়ই ওসমানী অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা এবং কর্তব্যপরায়ণতা তার চারিত্রিক গুণাবলি বিশেষভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছাত্রজীবনেই ওসমানীর মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ছাপ ফুটে ওঠে। যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউ.ও.টি.সি'র (ইউনিভার্সি্িট অফিসার্স ট্রেনিং কোর) সার্জেন্ট নিযুক্ত হন। ওসমানী ১৯৩৯ সালে জুলাই মাসে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪০ সালে ৫ অক্টোবর দেরাদূন সামরিক একাডেমি থেকে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে আর্মির কিং কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৪১ সালে ১৭ ফেব্রম্নয়ারি ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং যোগ্যতার বলে তিনি ১৯৪২ সালে ফেব্রম্নয়ারি মাসে ব্রিটিশ আর্মির সর্ব কনিষ্ঠ মেজর হন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে নজীরবিহীন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বার্মার রণাঙ্গনে স্বতন্ত্র যান্ত্রিক পরিবহণে এক বিশাল বাহিনীর অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সালে ওসমানী তার পিতার ইচ্ছা পূরণে আইসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা প্রদান করলে, একই সালে ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বতন্ত্র দেশ বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভূত হয়। ১৯৪৭ সালে ৭ অক্টোবর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ওসমানীকে ১৯৫৫ সালে ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনা সদর অপারেশন পরিদপ্তরে জেনারেল স্টাফ অফিসার নিয়োগ করা হয়। এখানে তাকে ১৯৫৬ সালে ১৬ মে মাসে কর্নেল পদে পদোন্নতি প্রদান করে ডেপুটি ডাইরেক্টর এর দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। এ সময় আন্তর্জাতিক সংস্থা সিয়াটো ও সেন্টোতে ওসমানী পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ওসমানী দক্ষতার সঙ্গে ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্নেল পদে কর্মরত থাকাকালীন ওসমানী একজন স্বাধীন চেতা বাঙালি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রম্নয়ারি কর্নেল পদে থাকা অবস্থায় অবসরে যান ওসমানী। পরবর্তী সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন ওসমানী। তিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন ওসমানী। মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে পালন করেন অতুলনীয় ভূমিকা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল ওসমানী।
১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রম্নয়ারি ৬৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। সিলেটে হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার সংলগ্ন গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।