সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে রোযা রাখার জন্য সাহরি খাওয়া সুন্নাত। রাতের শেষাংশ ও ফজরের পূর্ব সময়কে আরবিতে 'সাহর' বলা হয়। আর ঐ সময়ের খাওয়াকে 'সাহরি' বলা হয়। অনেকেই ভুল বা অজ্ঞতাবশত একে 'সেহরি' 'সেহেরি' বলে থাকেন। 'সেহের' থেকে 'সেহেরি' হয়। আর 'সেহের' মানে যাদু। যা এক্ষেত্রে মোটেই সাযুজ্যপূর্ণ ও শোভনীয় নয়। খাদিমুর রাসুল হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে করিম সালস্নলস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম ইরশাদ করেছেন, 'তোমরা সাহরি খাও। কেননা এতে বরকত রয়েছে' (বুখারি, মুসলিম)। হযরত আবদুলস্নাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রহমতের নবী সালস্নলস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম ইরশাদ করেছেন, 'সাহরি খেয়ে রোযা রাখার জন্য শক্তি অর্জন করো, আর দিনের (দুপুরের) সময় আরাম করে রাতের ইবাদাতের জন্যে শক্তি হাসিল করো' (ইবনে মাজাহ্)। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, কিছুই না খেয়ে রোযা রাখা মাকরুহ। কেননা, এতে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ইবাদাতে শিথিলতা আসে। আর ইবাদাতে শিথিলতা আসা মানেই সাওমের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়া। 'সাওমে বেছাল' (অর্থাৎ কিছুমাত্র না খেয়ে একাধারে কয়েকদিন রোযা রাখা) উম্মতের জন্যে হারাম। কেননা এটা নূরনবীরই (দরুদ) বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। হাদিসে পাকে আছে- আলস্নাহর প্রিয় রাসূলের (দরুদ) প্রতি উৎসর্গকৃত কিছু সাহাবি প্রিয়নবী (দরুদ) এর অনুকরণে 'সাওমে বেছাল' শুরু করেন। কিন্তু একাধারে কয়েকদিন পানাহার না করার ফলে তাদের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। উম্মতের দরদী দয়াল নবী (দরুদ) এ কথা জানতে পেরে তাদের বললেন, কেন তোমরা এরূপ করলে? উত্তরে উক্ত সাহাবিগণ আরজ করলেন- ইয়া রাসূলালস্নাহ্ (দরুদ)! আপনি যেহেতু 'সাওমে বেছাল' করছেন, তাই আমরা আপনার অনুকরণে সেই 'সাওমে বেছাল' রাখার জন্য উৎসাহী হয়েছি। আলস্নাহর প্রিয় রাসূল সালস্নলস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম বললেন- 'আইয়ুকুম মিছলী, ইউতয়িমুনী রাব্বী ওয়া ইউস্কীনী' অর্থাৎ- তোমাদের মধ্যে আমার মতো কে আছো? আমাকে আমার প্রভু পানাহার করান (মিশকাত শরীফ)। এই হাদিস শরিফ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আলস্নাহর নবীর (দ.) সঙ্গে কেউ তুলনীয় নয়। আলস্নাহর নবী ও মাসূমগণ ছাড়া কেউই মানবীয় দুর্বলতা ও ক্ষুধা-তৃষ্ণা থেকে মুক্ত নয়। আলস্নাহর নিকট মর্যাদা ও নৈকট্যে, শারীরিক ও আত্মিক ক্ষমতায় পৃথিবীর কেউই নবী ও মাসূমগণের সমকক্ষ নয়। সুবহানালস্নাহ্!
আলস্নাহ পাক সাহরির শেষ সময় বর্ণনা করে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, অর্থাৎ- 'আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ না রাতের কালো রেখা হতে ঊষার সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়' (সূরা বাকারা :১৮৭)। এখানে রাতের কালো রেখা বলতে 'সুবহে কাযিব' এবং ঊষার সাদা রেখা বলতে 'সুবহে সাদিক' কে বুঝানো হয়েছে। এজন্য দেরি করে সাহরি খাওয়া মুস্তাহাব এবং এতে সাওয়াবও বেশি। কিন্তু এমন দেরি করা যাবে না, যাতে সুবহে সাদিকের সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিছু কিছু রোযাদার ফজরের আযান না দেওয়া পর্যন্ত পানাহার করতে থাকেন। আবার কেউ কেউ ঘুম থেকে দেরিতে উঠলে ফজরের আযান দেওয়ার সময় তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে নেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, মনে রাখবেন, এতে রোযা হবে না। কেননা পানাহার বন্ধ করার শেষ সময় 'ফজরের আজান' নয়, বরং সুবহে সাদিকের পূর্বেই পানাহার বন্ধ করতে হবে। বলা বাহুল্য, ফজরের আজান দেওয়া হয়, সুবহে সাদিকের পরেই। তাই এ বিষয়ে প্রত্যেক রোযাদারের সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সুবহে সাদিকের পর কিছু খেয়ে রোযা রাখা আর উপবাস থাকা একই কথা। এরূপ ক্ষেত্রে রোযা হয়ই না। তাই পরবর্তীতে সেই রোযার কাযা আদায় করতে হবে।
সাহরিতে উপাদেয়, মানসম্মত তথা প্রোটিন ও ক্যলরিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া মুস্তাহাব ও উত্তম। কারণ ভৌগলিক অবস্থানভেদে ১৪-২২ ঘন্টা পর্যন্ত রোজা রাখতে হয়। তাই এমন খাবার খেতে হবে, যাতে দীর্ঘক্ষণ উপবাস থাকলেও যেন শরীর দুর্বল হয়ে না পড়ে। আর শরীর দুর্বল হয়ে পড়লে রোযা রাখা যেমন কষ্টকর হয়, তেমনি নামায, কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠ এবং অন্যান্য ইবাদাতেও অলসতা এবং দুর্বলতা এসে যায়। মনে রাখবেন, যে সব শুভক্ষণে আলস্নাহর দরবারে মানুষের দোয়া কবুল হয়, তার মধ্যে সাহরির সময়টি অন্যতম। মাহে রমজান ছাড়াও অন্য সময়ে এই সাহরির মুহূর্তটি দোয়া কবুলের জন্য নির্ধারিত। হাদিস শরীফে আছে, 'আলস্নাহ তায়ালা রাতের শেষাংশে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে বিশেষ তাজালস্নী করে ঘোষণা করেন- 'কে আছো আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করবো। কে আছো আমার কাছে জীবন-জীবিকা চাচ্ছো? আমি তাকে জীবন-জীবিকা দান করবো। কে আছো আমার কাছে রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য প্রত্যাশী? আমি তাকে শেফা দান করবো। এভাবে আলস্নাহ পাক সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত বান্দার একেকটি সমস্যার কথা বলে তা সমাধানের নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতিটি বান্দাকেই আহ্বান জানাতে থাকেন, তার কাছে চাওয়ার জন্য (মিশকাত শরিফ)। কিন্তু ঘুমের ঘোরে অচেতন বান্দার সময় কোথায় দয়াল প্রভুর ডাকে সাড়া দেওয়ার? আলস্নাহর প্রিয় বান্দা যারা, বিশেষত আলস্নাহর ওলীগণ এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগান যথাযথভাবে। তারা আরামের ঘুমকে হারাম করে সেই মূল্যবান সময়টাকে তাহাজ্জুদ নামায, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির আজকার, দরুদ শরিফ পাঠ ও দোয়া-মোনাজাতে কাটিয়ে দেন। ফলে তারা লাভ করেন আলস্নাহর রহমতের অজস্র ফল্গুধারা, মাগফিরাতের বারিরাশিতে ধুয়ে-মুছে সাফ-সুতরো হয়ে যায় তাদের তনুমন। আলস্নাহর নূরের আলোয় আলোকিত হয় তাদের হৃদয়াকাশ। বদলে যায় তাদের ললাট লিখন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, একটু চেষ্টা করলে, একটু সতর্ক হলে এবং একটু উদ্যোগী ও উদ্যমী হলে আমরাও পারি সেসব সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে। আপনার আমার খালিক মালিক মহান আলস্নাহ পাক অহর্নিশ আমাদের ডাকছেন। আসুন, তার ডাকে সাড়া দেই। আলস্নাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন। বিহুরমাতি রাহমাতুলিস্নল আলামীন সালস্নলস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম।
আবছার তৈয়বী: লেখক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ।